৫ মে নীলরতন সরকার মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন সোমনাথ। দুরারোগ্য মায়েলোফাইব্রোসিস রোগে আক্রান্ত সোমনাথের কথা আমরা অনেকেই জানতাম। নিয়মিত এই হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগে ওঁর চিকিৎসা চলত। ইদানীং জ্বর আর হেঁচকির উপসর্গ নিয়ে ওঁকে এখানে এনে ভর্তি করা হয়। সেই উপসর্গগুলি কমে গেলেও সোমনাথের অবস্থা অবনতির দিকে যেতে থাকে। ছোটোবেলা থেকে এখানে চিকিৎসার জন্য আসছেন সোমনাথ। এখানকার চিকিৎসক ও অন্য কর্মীরা ওঁর পরিচিত এবং ওঁর প্রতি সহানুভূতিশীল। অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় সোমনাথ মুখ দিয়ে কিছুই খেতে পারছিলেন না। একটানা স্যালাইন চলছিল। ওঁর বাবাকে প্রতিদিন রাতে হাসপাতালেই থাকতে হত। মাকেও দিনের বেশিরভাগ সময় ছেলের জন্য হাসপাতালে থাকতে হত। মায়ের হয়রানি ছিল আরও বেশি। দফায় দফায় হাসপাতালে আসা, আবার বাড়ি ফিরে যাওয়া, ওষুধপত্র কিনতে যাওয়া, সারাদিনই অবিরাম ছোটাছুটি চলতে থাকত।
এপ্রিল মাসে ওঁর ব্লাড-প্লেটলেট কাউন্ট খুব কমে গিয়েছিল। ওঁর শরীরে দারুণ যন্ত্রণার কথা আমাকে টেলিফোন করে জানিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, ‘সোমনাথ আমি তোমার বাড়ি যাব। তোমাদের বাড়ির কাছেই আমার এক ডাক্তার বন্ধু অমিত চট্টোপাধ্যায়ের অসুস্থতার কথা জেনেছি। একসঙ্গেই দু-জায়গায় যাব।’ রক্ত দিয়ে আবার ব্লাড-কাউন্ট বাড়ানো হল। জেনে একটু স্বস্তি পেলাম। কিন্তু তারপরই শুরু হল জ্বর আর নতুন উপসর্গ হেঁচকি। উপসর্গের যা কষ্ট, তাকে ছাপিয়ে যেত ওঁর ভয়। নিশ্চয় শরীরের ভিতরে নতুন কোনো প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে, হয়তো শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো আক্রান্ত হয়ে পড়েছে …
৬ মে রবিবার আমি হাসপাতালে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেদিন এসব ভয়ের কথা হচ্ছিল। আর তারই ফাঁকে ফাঁকে জানতে পারছিলাম ওঁর নতুন ভাবনার কথা। ‘সময় তোমাকে’ পত্রিকার গল্পসংখ্যার কাজ হয়ে গেছে, শুধু ছেপে বেরোনো বাকি। তারপরেই ‘আধুনিক বাংলা ছোটগল্পে মিথ’-এর পরবর্তী অংশ নিয়ে কাজ করবেন সোমনাথ। তার জন্য বেশ কিছু লেখকের সঙ্গে কথা বলেছেন। আর চলছে পড়াশুনা। সন্দীপ দত্তের লিট্ল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি থেকে কিছু জিনিসপত্র জেরক্স করে নিয়ে এসেছেন সোমনাথ। মাঝখানে গোলমাল পাকিয়ে দিল ওঁর শরীর।
সেদিন সোমনাথ হাসপাতালের বেডে শুয়ে বলছিলেন ওঁর ছেলেবেলার কথা। মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকে এই এনআরএস হাসপাতালে আসছেন সোমনাথ। ছেলেবেলায় ছোট্ট শরীর নিয়ে হাত বাড়িয়ে বেডটা আঁকড়ে ধরতেন। ওপরে উঠতে পারতেন না। সিস্টাররা এসে বেডে শুইয়ে দিতেন। এইভাবেই হাসপাতাল আর হেমাটোলজি বিভাগের সঙ্গে ওঁর দীর্ঘ আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল।
মনে পড়ে, সোমনাথ বলেছিলেন, এই হাসপাতালের লাইব্রেরির কথা। সেখানে ওঁর পড়াশুনার কথা। প্রত্যেক ডাক্তারের সঙ্গে ওঁর সম্পর্কের কথা। সকলের নাম আমার মনে নেই।
গতকাল সন্ধ্যায় হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম সোমনাথ ঘুমোচ্ছে। ডানহাতটা শূন্যে তোলা। শরীরটা যেন আরও একটু ছোটো হয়ে গেছে। ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আমি নিঃশব্দে ওয়ার্ডের বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাইরে ওঁর মা তখন একজন হাউসস্টাফকে খুঁজছেন। ওঁর প্লেটলেটের সংখ্যা কুড়ি হাজারে নেমে এসেছে, যেখানে স্বাভাবিক অন্তত দু-লাখ। ছয় বোতল প্লেটলেট লাগবে। আজই একসঙ্গে তা দেওয়া হবে সোমনাথকে। সবটা জোগাড় হয়নি। হাউসস্টাফ প্রেসক্রিপশনে লিখে দিলে মাকে আবার তা খুঁজতে বেরোতে হবে। ওঁর বাবা গিয়েছিলেন নিচে সোমনাথের জন্য জল কিনে আনতে। সঙ্গে নিয়ে এলেন একটা ছোট্ট বোতলে চা। আমাদের প্লাস্টিকের কাপে চা দিয়ে ওঁর মা সেই বোতল থেকেই চা খেতে খেতে কথা বলছিলেন। বললেন, ওঁর সম্ভবত মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। চোখ আর মুখ থেকে রক্ত পড়ছে। হাসপাতালের অন্য বিভাগ থেকে সার্জেন এসে দেখে গেছেন। বাবা বড়ো ডাক্তার এম এস ঘোষের চেম্বারে গিয়ে কথা বলেছেন। ওঁর নাকি লিভারে জল জমেছে আর গল ব্লাডারে স্টোন বড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু অপারেশন করার মতো অবস্থা নেই। আর বোন ম্যারোর অপারেশনটাও করা দরকার। সোমনাথের মা বললেন, অন্যান্য পত্রিকার বন্ধুরাও মাঝেমধ্যে আসছেন। এঁদের মধ্যে ‘ঐহিক’ পত্রিকার তমাল রায় সোমনাথের এই কঠিন সময়ে খুবই আন্তরিকভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
ওঁর শরীরের জটিল অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সেই জটিলতা তো আমি কখনই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারিনি। শুধু বুঝতাম, একটা দীর্ঘ লড়াই চলছে ওঁর সঙ্গে ওঁর প্রায়-বিকল শরীরটার। জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর। সোমনাথ বাঁচতে চেয়েছিল।
আজ সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ সোমনাথ আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন।
জিতেন নন্দী, কলকাতা, ৩০ মে
Leave a Reply