অমিতা নন্দী, সন্তোষপুর, ২৪ জুলাই#
কলকাতার এক রক্ষণশীল পরিবারে ডাঃ শোভা ঘোষের জন্ম। ‘সারা জীবনটাই একটার পর একটা চ্যালেঞ্জ। মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই প্রথম চ্যালেঞ্জ। … বাবার মতে, মেয়েদের কেবল হিসেব-নিকেশ আর চিঠি লেখার বিদ্যেটুকু থাকলেই যথেষ্ট আর অল্প বয়সে বিয়ে। সেখানে লেখাপড়া শুরু করা, চালিয়ে যাওয়া, মেডিকাল কলেজে পড়তে যাওয়া — প্রতিটি মুহূর্তে যেন ঢেউ ঠেলে ঠেলে এগোনো।’ কলকাতা মেডিকাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করার কয়েকবছর পরে ১৯৫৪ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বিলেতে যান। দশ-এগারো বছর ইংল্যান্ডে থেকে দক্ষ স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ এবং ক্যানসারবিদ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। দেশে ফিরে চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতাল থেকে শুরু করে বহু হাসপাতাল ও নার্সিং হোমের কাজে জড়িয়ে থেকেছেন দীর্ঘদিন ধরে। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের এবং শিশুদের পুষ্টি খাদ্য স্বাস্থ্য এবং রোগ প্রতিরোধের বহুবিধ কার্যক্রমে যুক্ত থেকেছেন। নিজের পেশার পাশাপাশি সমাজের দুঃস্থ-অনাথ মেয়েদের স্বাবলম্বী করে তোলার কাজে ব্যাপৃত থেকেছেন সারা জীবন।
তিনি শুধু একজন চিকিৎসকই ছিলেন না, একজন অত্যন্ত সমাজ-মনস্ক চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ও পড়াশোনা। জাপানের ফুকুশিমায় পরমাণু চুল্লির দুর্ঘটনায় অত্যন্ত আলোড়িত হন, পরমাণু বিদ্যুতের বিরুদ্ধে তাঁর স্পষ্ট মত ছিল। মন্থন সাময়িকী এবং সংবাদমন্থন পত্রিকার তিনি নিয়মিত উৎসাহী পাঠক ছিলেন। তাঁর বেশ কিছু লেখাও এই দুই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, মূলত ‘সত্যবতী’ ছদ্মনামে। তাঁর অত্যন্ত প্রিয় চড়াই পাখিরা কোথায় কেন হারিয়ে গেল তা জানার জন্য একসময় তিনি খুব উৎসুক হয়ে আমাদের বলেছিলেন আসানসোল থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকার ওই বিশেষ সংখ্যাটি জোগাড় করে দিতে। পত্রিকাটির সব কপি শেষ হয়ে যাওয়ায় তার জেরক্স-কপি হাতে পেয়ে শিশুর মতো আনন্দ। কে বলে তিনি ‘বৃদ্ধা’? তাঁর শরীরের বয়স হয়েছিল, মনের নয়। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সেই লড়াকু মনেরই পরিচয় তিনি দিয়ে গেলেন।
মৃত্যুর উপলক্ষ্য একটা দুর্ঘটনা। বাড়িতে পুজোর সময় মোড়ায় বসে তিনি যখন ধুনো জ্বালছিলেন, সামনে পুরোহিতমশাই তখন পুজোয় ব্যস্ত। পরিচারিকাকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর অসুস্থ মাকে খাওয়ানোর জন্য। মাত্র দশ মিনিট সময়। পরনের সিন্থেটিক শাড়িতে আগুন লেগে গেছে বোঝার পর এতটুকু চেঁচামেচি হইচই না করে স্নানঘরে গিয়ে শাওয়ার খুলে আগুন নেভান, ঘরে এক ঢিলেঢালা পোশাক পরে নিজেই প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করেন। ততক্ষণে শরীরের ৬০-৭০ ভাগ অগ্নিদগ্ধ। ইতিমধ্যে ওই পরিচারিকা এবং ওঁর স্নেহধন্য এক ব্যক্তি এসে পড়েন। নিজেই ফোন করে কাউকে কাউকে খবর দেন এবং ওঁকে চিকিৎসার জন্য কোনো নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে বলেন। দুপুর একটায় দুর্ঘটনাটি ঘটে, সন্ধ্যা ৬টার পর তিনি জ্ঞান হারান। তার আগে নিজেই পুলিশকে বয়ান দেন এবং ওই বীভৎস দহনজ্বালা সহ্য করেন, এতটুকু কাতরোক্তি শোনা যায়নি। পরদিন দুপুর একটায় শেষ হয় তাঁর লড়াই।
তাঁর জীবন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে আর তাঁর মরণের সময়েও তিনি আমাদের শিখিয়ে গেলেন কীভাবে সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়।
POROMESH ACHARYA says
, adhaeran, amar shradha janai