শুভপ্রতিম রায়চৌধুরী, কলকাতা, ২৬ ফেব্রুয়ারি#
গুণ্ডামির চরম নিদর্শন হয়ে থাকল ২২ ফেব্রুয়ারির নিউকোচবিহার স্টেশন। ‘ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি’র নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্তের নেতৃত্বে একদল দুষ্কৃতি মানবাধিকার কর্মী এবং মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম)-এর কোচবিহার জেলা মানবাধিকার কর্মী আজিজুল হক এবং তাঁর সহযাত্রী ছিটমহল অধিবাসীদের ওপর আক্রমণ করে। তাঁদের ‘অপরাধ’ তাঁরা কলকাতায় মাসুম আয়োজিত একটি বই প্রকাশের অনুষ্ঠান এবং সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মাসুম ভারত-বাংলাদেশের কয়েকটি ছিটমহলের ওপর ক্ষেত্রসমীক্ষা করছে। এই সমীক্ষার প্রাথমিক প্রতিবেদন গত ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়। ভিড়ে ঠাসা প্রেস ক্লাবে বইটি প্রকাশ করেন সিকিম হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত। মাসুমের সম্পাদক কিরীটি রায় ছিটমহলের মানুষের মানুষ হিসাবে বাঁচার অধিকারের দাবি তোলেন। বইটির লেখক শুভপ্রতিম রায়চৌধুরী সমীক্ষালব্ধ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন অন্যান্য সমীক্ষকদের পক্ষ থেকে। অনুষ্ঠান শেষে ছিটমহল থেকে আগত মানুষ সাংবাদিকদের সামনে নিজেদের করুণ অবস্থার চিত্র তুলে ধরেন। ছিট মহলে যুযুথান দুই ছিটমহল কমিটির দ্বন্দ্ব ফুটে ওঠে তাঁদের বক্তব্যে, প্রকাশিত বইটির তথ্যে। রাষ্ট্রের অবহেলা ও নির্যাতনের অতিরিক্ত দুটি কমিটির এলাকা দখলের এই লড়াই ছিটমহলের নাগরিকত্বহীন মানুষের জীবনকে করে তুলেছে সঙ্গিন ও সন্ত্রস্ত।
সমীক্ষায় এবং সাংবাদিকদের সামনে তাঁরা দাবি করছিলেন, শুধু মাত্র জমির বিনিময় নয়, আগে তাদের মানবিক অধিকার, দুই দেশের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হক। ছিটমহল বিনিময় যেন তাঁদের সাথে আলোচনা করে স্থির হয়। তাঁরা অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন, একথা বলার জন্যে তাঁদের ছিটমহল নিয়ে রাজনীতি করা ক্ষমতাধরদের বিষনজরে পরতে হবে। তাঁদের আশঙ্কাই সত্য হল।
২২ তারিখ সকাল ১০.১৫ নিউকোচবিহার রেল স্টেশনে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস পৌঁছানোর সাথে সাথেই ঝাঁপিয়ে পরে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ ‘ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি’র কর্তাব্যক্তিরা। অভিযোগ, রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্যই শাসক দলের ঘনিষ্ঠতা এখন ছিমহলের জমি-বাস্তবতা। কোচবিহার কোতওয়ালি থানার পুলিশের উপস্থিতিতেই চলে ছিটমহলের অধিবাসী এবং আজিজুলের ওপর নির্মম প্রহার। পরে আজিজুল এবং ছিটমহলের দুইজন মানুষকে কোতওয়ালি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কোনো ‘মেমো অফ এরেস্ট’ ছাড়াই তাঁদের থানায় আটক করা হয়। সমন্বয় কমিটির নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্ত ‘ফরেনার্স অ্যাক্ট’-এ যাতে পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করে তার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। মাসুমের উকিল তাপস রায় থানায় উপস্থিত হন। কোন অভিযোগে তাঁদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তিনি পুলিশের কাছে তা জানতে চান। উত্তরে পুলিশ ইন্সপেক্টর বলেন তাঁদের ‘রেস্কিউ’ করা হয়েছে। উকিলবাবু যখন জিগ্যেস করেন, কেন প্রহৃত ব্যক্তিদের চিকিৎসা করা হল না এবং কেন ‘মেমো অফ এরেস্ট’ ছাড়াই আটক করা হল তিনজনকে, পুলিশ নিরুত্তর থাকে।
বিকেল ৪টার সময় যখন মাসুম সম্পাদক কিরীটি রায় ইনস্পেক্টর-ইন-চার্জ, মিঃ মিশ্রকে ফোন করেন, তাঁকে জানানো হয়, সকলকেই ফরেনার্স অ্যাক্ট-এর ১৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে থানায় জানতে চাওয়া হয়, কেন তাঁদের গ্রেফতার করা হল। জেলার ম্যাজিস্ট্রেটকে বিষয়টি জানানো হয়, তিনি পুলিশ সুপারের কাছে ঘটনার বিষয়ে জানতে চান। এত কিছুর পর পুলিশ প্রায় ৮ ঘণ্টা বেআইনি আটকের পর তিনজনকে সন্ধ্যা ৭টার সময় থানা থেকে চলে যেতে বলে। থানা থেকে বের হতেই সমন্বয় কমিটির দলবল দুই ছিটমহলবাসীকে ছিনতাই করে নিয়ে যায়। মাথায় মারাত্বক জখম ও অন্যান্য আঘাত নিয়ে আজিজুল ভর্তি হন কোচবিহার হাসপাতালে। উপস্থিত ডাক্তার সিটি স্ক্যান, এমআরআই করানোর নির্দেশ দেন। সন্ত্রস্ত ও মারাত্মক আহত আজিজুল হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও তাঁর সাহস হারাননি।
Leave a Reply