সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, ৩০ নভেম্বর#
তৌসিফের বাড়ির লোকেরা
— কুরবানির ক-দিন আগে থেকেই চৌমণ্ডলপুরের মারপিট হচ্ছিল তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে। আমাদের গ্রামের লোকেরা (তৃণমূলের) সেখানে যাচ্ছিল। তো গ্রামের লোকেরা শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী লোকেরা বলে, ওদের গ্রামের মারামারি, ওদের গ্রামের লোকেরা বুঝে নেবে। ওদের ভয়ে মেয়েছেলেরা কেউ বেরোতে পারছে না। ওটা এমনকী আমাদের এলাকাও নয়, মঙ্গলডিহি এলাকা। আর আমাদের এলাকা বাতিঘর। কিন্তু তাদের গায়ে হাত দেয় ওরা। ওরা খালি বাইশজন, গ্রামের মধ্যে। তাদের মধ্যেই মেম্বার, তাদের মধ্যেই সবকিছু। বুদ্ধিজীবী শিক্ষিত লোকেদের গায়ে হাত দেওয়ার ফলে গ্রামের সব লোক একদল হয়ে যায়, বিজেপি জয়েন দেয়। তখন ওরা নিজেরাই গ্রামের বাইরে চলে যায়। … আসল কথা, একশো দিনের টাকা নিয়ে ঝামেলা। ১৩টা পুকুরের টাকা দেয়নি। গরিব মানুষরা কাজ করেছে। তাদের টাকাগুলো ওরা দেয়নি।
— যখন গ্রামের লোকেরা একশো দিনের টাকা না পাওয়া নিয়ে বলতে যায়, তখন ওরা অত্যাচার করে। পিস্তল দেখায়। বলে তোরা বলতে পারবি না। তখন সবাই একদল হল, বিজেপি জয়েন দিল। ওরা গ্রামছাড়া হয়ে গেল। তারপর ওরা সেনাবাহিনী নিয়ে, গুণ্ডাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করে গ্রামে ঢুকবে বলে এল। তো সেই গ্রামে ঢুকতে গিয়েই দুটো লোক মারা গেল।
— আমাদের এখন প্রাণটাকে নিয়ে ভয়। মিডিয়া এখন কী বসিয়ে নেয় কার মুখে তা বলা মুশকিল।
— দুটো পঞ্চায়েতই (চৌমণ্ডলপুর আর মাকড়া) বিজেপি হয়ে গিয়েছে। আর সদাই (চৌমণ্ডলপুর গ্রামের, গ্রেপ্তার হওয়া সদাই শেখ, যিনি মাস তিনেক আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন) আছে বলে গ্রামগুলো ভালো আছে। ও সত্যিকারের ভালো লোক। ও আছে বলে গ্রামগুলো এখনও শান্ত আছে। ও না থাকলে মেয়েরা ঘর থেকে বেরোতে পারত না।
ময়না বিবি
তৌসিফ আমার ছোটো ভাই। আমরা পরপর তিনটে বোন, তারপর তিনটে ভাই। ও (তৌসিফ) সবার ছোটো। বড়ো জেঠুর তিনটা মেয়ে, ওর ছেলে নেই। আর মেজো জেঠুর চারটা মেয়ে একটা ছেলে। আমাদের পরিবারের চোদ্দটা ভাইবোনের মধ্যে ও সবার ছোটো। … ও রাস্তার কাজে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার পথে ওকে মেরেছে।
আমাদের গ্রামে ছেলেরা থাকতে পারছে না। রাত তিনটে থেকে পুলিশে গোটা গ্রাম ধাওয়া করছে, মাঠের মধ্যেও। যাকে পেরেছে তাকেই ধরছে, বাচ্চা ছেলে ফাইভ সিক্সে পড়ে, তাকেও তুলে নিয়ে গিয়েছে। সিউড়িতে কলেজে পড়ে একটা ছেলে, নাজমুল নাম, হাতে বই তার। বিকেলে গ্রামে এসেছে মেস থেকে। আব্বার শরীর খারাপ দেখা করতে এসেছিল। তখন ভোর পৌনে ছ-টা হবে। দেখেছে বাড়িতে একটা ছেলে রয়েছে, তুলে নিয়ে গিয়েছে। তারপর আবার ছেড়ে দিয়েছে। তবে এখন গ্রামের কেউ গ্রেপ্তার হয়ে নেই। কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। তৌসিফের খুনের ঘটনাতেও কেউ হয়নি, বা ওদের যে মারা গেছে, মোজাম্মেল, তার জন্যও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। ছেলেরা কেউ ভয়ে গ্রামে থাকতে পারছে না, লুকিয়ে থাকছে। রোজ পুলিশ আসছে। ক্যাম্পগুলো রয়েছে ইস্কুলে (প্রাথমিক বিদ্যালয়)। আজ সকালেই তিনগাড়ি এসেছিল, একটা জালগাড়ি, দু-গাড়ি টাটাসুমো। দিন তিনেক আগে মাঠে ধাওয়া করেছিল। ধান ছিল ভালো ছিল, দেখতে পেত না ওরা। এখন ধান কাটা হয়ে গেছে।
ওই মোজাম্মেলই (তৃণমূলের) লোক এনেছিল বাইরে থেকে। … না, ওকেও গ্রামের লোকে মারেনি। বাইরের লোক যারা এসেছিল, তারা বেরোতে পারছিল না। তখন ওকে মেরে বেরোয়। আমার ভাইটাকেও যেমন মেরে বেরোয়। ও রাস্তার কাজ করছিল। যারা এসেছিল, তারা দেখল, পেছন থেকে তাড়া করেছে, আমরা বেরোতে পারব না। তখন দেখল গ্রামের ছেলে, দে ওকে মেরে দে, গ্রামের লোক তাহলে ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকবে, সেই ফাঁকে আমরা পালিয়ে যাব। … পুলিশ তাদেরই ধরেছে, যাদের ধরলে তৌসিফের কেসে সাক্ষী না পাওয়া যায়। যেমন আমার এক ভাই আছে, সে বিজেপি নেতা। আরেক জন আছে, সে বিজেপি নেতা।
(রেগে গিয়ে) মুসলমানরা বিজেপি করছে কেন? যদি বাধ্য না হবে? মমতা যদি এত ভালো কাজ করেই গেছে, তাহলে মুসলমানরা কেন বিজেপি করছে? সেটাই তো সবাইর বুঝার দরকার আছে। নিশ্চয়ই কুনো একটা আঘাত ঘটেছে। বিজেপি তো একটা হিন্দু লোক। হিন্দু পার্টি। তাহলে ওকে আনবার কুনু দরকার ছিল না। নিশ্চয়ই একটা ব্যাঘাত ঘটেছে। মুসলমান হয়ে যদি কেউ মুসলমানের বেইমানি করে, তাহলে সেই মুসলমান তাকে করবেও না। ওই সিদ্দিকুল্লা চৌধুরি যে তৃণমূলকে নিয়ে এল, তারপর খুব যে সুখে রেখেছে, মাকড়া গ্রাম কিন্তু সুখে নেই। আমি বলছি, আমি আল্লার কাছে গুনাহ হই হব, কিন্তু নাম ধরেই বলব।
ঢালাই রাস্তার কাজ কন্ট্রাক্টরকে করতে দিচ্ছিল না তৃণমূলের নেতারা। হবে না, চলবে না করছিল। হুমকি ধমকি। পাথর বালি ফেলতে দেব না। তারপর সাত-আট লাখ টাকায় কন্ট্রাক্ট হয় কন্ট্রাক্টারের সঙ্গে, তারপর রাস্তাটা হয়। চারটে না পাঁচটা পুকুর খনন ছিল, তারপর নালা ঝাড়া যেটা হয় গ্রামে, জল নিকাশের ব্যবস্থা — তারও চারদিন পাঁচদিন — সেসবের টাকা দেয়নি। ওরা এমন কুড়া চালাইত, বাঘ ছাগল যেমন একঘাটে জল খায়, সেরকম করেছিল। সবার জবকার্ড ওরা নিয়ে নিয়েছিল। তৃণমূলের লোকেরা যে টাকা মেরে খেয়েছে, ওদের বাড়ি পুড়েছে, কিন্তু অমন তিন চারটে বাড়ি করতে পারে।
মোজাম্মেলের পরিবার দু-লাখ টাকা পেয়েছে, দুবরাজপুর থেকে নিয়ে এসেছিল, মারা গেছিল, সুলেমান — সেও দু-লাখ পেয়েছে। সেও পেল দু-লাখ, আমার নিষ্পাপ শিশু ভাই মারা গেল — তার জন্যও দু-লাখ। আমার আব্বা তো রাজ্যপালের সম্মানের জন্য টাকাটা নিয়েছে, নিত্থ না তো টাকাটা।
এখন গ্রামের সব লোক এদিকে (বিজেপির দিকে)। মোজাম্মেল মারা যাওয়ার পর মাটি কুড়ার লোক ছিল না। ওদের মাটি পর্যন্ত কুড়তে চাইছিল না গ্রামের লোক। আমাদের লোকেরা তদারকি করে গোর দিয়েছে। তদারকি করেছে আমাদের শাহজাহান আর আজাহার। তারা তৃণমূল পার্টি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করতে লাগল। ধান মাপার ব্যবসা। সারা বছর কাজ থাকে। সুবিধা না পেলে ও পার্টিতে থাকবে কেন সে। পার্টি না করলে খেতে পাবে না তা তো নয়।
(গলা নামিয়ে) অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলে, অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে পেত না এই লোকেরা। এত ভালো, এত যে শিক্ষিত পরিবার। ওই পরিবারে এত নোংরামো, এত অত্যাচার যে সহ্য করা যায় না। যতই বলো ভাই, একটা নোংরামির কাজ, যতই বড়ো হও তুমি, কেউ সেটা প্রশ্রয় দেবে কি? আস্তে আস্তে সবাই বলবে, মুখ ফুটবে, ফুটবে না? রাতদুপুরে কারোর বাড়ির জানলা ধরে যদি উঠার চেষ্টা করো, কি কারণে, সে তো বলবেই। এই বাড়ির দরজায় বসে আছিস, তার স্বামী নেই, সে তো বলবেই। বোম বারুদ এনে রাখছিস পাশের গ্রামে মারামারি করতে যাওয়ার জন্য। এই মোর আব্বার দুই দুটো ছাগল চলে গেল, আমার একটা গেল। আমরা সাহস করে ছাগল বাইরে রাখি, যে লোক রয়েছে, পার্টি অফিসের লোক রয়েছে। ছাগল কটা থাউক। কুন লোক নিল সেটা? এ বলতে গেলে … ভাই (তৌসিফ) বলেছিল। (মারামারি শুরু হওয়ার) দু-দিন আগে বলল, এই করবি, অই করবি, বিজেপি করবি — তুদের ছাগল কে নেছে না নেছে আমরা কী করি জানব?
মোজাম্মেল-এর এক দিদি, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
মিডিয়াকে আমি কিছু বলব না। আমার কিছু বলার নেই। আমরা খুবই চাপে আছি। যা ঝড় গেছে, আমাদের পরিবারের ওপর দিয়েই গেছে। আমার একটা ভাই মারা গিয়েছে। আমাদের বংশের একটা খুঁটি ছিল। মরা মুখটাও দেখতে পাইনি, মাটিও দিতে পারিনি। কিছু লোক মাটি দিয়ে দিয়েছে। দুই ভাই হাসপাতালে ছিল। আমার বাড়ি ক্যানেল পারে। আমার বাড়ি সব ভাঙচুর করে শেষ করে দিয়েছে। টিভিতে যদি দেখে থাকেন দেখবেন নীল সাইকেল ভাঙা কল চেয়ার …। ওই বাড়ি আমরা ঢুকিনি, এখানে আছি। ভাই মারা যাওয়ার পর আমি কেস করি। আমাকে কেস তুলতে হবে বলে গ্রামে ঢুকতে দিয়েছিল। কত চাপ। আমি কেস তুলিনি। সবাই বলছে, মোজাম্মেলের বাড়ির লোক মুখ খুলছে না কেন মিডিয়ার সামনে। কেন খুলছে না বুঝতেই পারছেন। … এই তো আজকেই এসে আবার বলল। যেতে বলল। আমি বলেছি, ঠিক আছে। কেষ্টদা বলে দিয়েছেন, তুই যাবি। আমাদের কেষ্টদা, মন্ত্রী, রাণাদা, এমনকী মমতাদিও ভালোবাসেন। কঠিন ভালোবাসেন। আমরা ছোটো থেকেই কংগ্রেস করতাম। আমাদের আব্বা কংগ্রেসের পনেরো বছর প্রধান ছিল। আমরা তৃণমূল কংগ্রেসের। জিন্দেগিতে অন্য কোনো পার্টি করি না, করবও না। এটা কিন্তু একশো পারসেন্ট। এখন আমাদের অশান্তি চলছে। এখন আমরা রাজনীতিতে যাচ্ছি না। আমাদের একটা ভাই, মানে আমাদের গাঁয়ে সবার সেরা। আমাদের ছত্রিশটা চল্লিশটা লোক ফ্যামিলির, তার মধ্যে মোজাম্মেল সেরা। তাকেই ওরা মেরে দিয়েছে। তার গুণের শেষ ছিল না। কারোর বাড়ি ভাত চড়েছে কিনা সেটা দেখেছে, কারোর মেয়ের বিয়ে হয়েছে কিনা সেটা দেখেছে। আমার ভাই এরকম। সেই ভাই চলে গিয়েছে, তাই আমরা এখন রাজনীতিতেই যাব না। আবার যদি ঝুট ঝামেলা মিটে যায় …। কুরবানির একদিন আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। কুরবানির পরের দিন বেড়ে যায়।
মোজাম্মেলের ছেলে নেই। দুই মেয়ে। বড়ো মেয়েটার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোটোটা নাইনে পড়ে। মোজাম্মেল আমার ভাই, আমার চেয়ে অনেক ছোটো। বত্রিশ বছর বয়স। আপনি তার ছবিটা যদি দেখেন, কলকাতা থেকে তুলে নিয়ে এসেছে, দেখলে বলবেন বিয়ে হয়নি এখনো। আমরা সরিয়ে রেখেছি ছবিটা। দেখলে বুক ফেটে যাচ্ছে। আমাদের পারিবারিক চাষবাস। ভাই আমার কাঠ ব্যবসা করত। ফার্নিচারের ব্যবসা করত। অনেক বাগান লিজ নেওয়া ছিল। ভাইয়ের বিঘে তিনেক জমিও ছিল।
কালকেও শুনেছি ছাতরাবান্দিতে গণ্ডগোল হয়েছে। কিন্তু আমরা সেসব কিছু শুনিনি। আমরা এখন রাজনীতিতে নেই।
Leave a Reply