কুশল বসু, কলকাতা, ১৪ ফেব্রুয়ারি#
ইউরোপ জুড়ে অর্থনৈতিক সঙ্কট আরও ঘনীভূত হওয়ার মধ্যেই ঘোর সঙ্কটে থাকা গ্রীসে প্রায় ৩৬ শতাংশ ভোট পেয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে ‘সিরিজা’ নামে একটি বামপন্থী জোট — যারা গ্রীসের চিরাচরিত বামপন্থী পার্টি ‘পাসোক’-এর মতো ‘গ্রীক জনগণের কৃচ্ছসাধনের মধ্যে দিয়েই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব’ — এই তত্ত্বে মোটেই বিশ্বাস করে না। জানুয়ারির শেষদিকে হওয়া নির্বাচনের পর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে এই নয়া জোট ক্ষমতা হাতে নিয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন আলেক্সি সিপারাস। এই বামপন্থী জোটের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে দক্ষিণপন্থী, কিন্তু কৃচ্ছসাধন বিরোধী আরেকটি ছোটো পার্টি ‘স্বাধীন গ্রীস’। যেটি বিদায়ী শাসক দল এনডি থেকে কৃচ্ছসাধনের প্রশ্নে ভেঙে বেরিয়ে এসে তৈরি হয়েছিল ২০১২ সালে।
গ্রীসের অর্থনৈতিক সঙ্কটের মূল উৎস সেখানকার ধনিক শ্রেণী। দশকের পর দশক ধরে তারা দেশের সম্পদ লুঠ করেছে। আর সরকার ইউরোপের ব্যাঙ্কগুলো থেকে ধার করে দেশ চালিয়েছে। এইভাবে বিদেশী ঋণের পরিমাণ দেশের মোট উৎপাদনের চেয়ে বেশি হয়ে গেলে গ্রীস গাড্ডায় পড়ে। তখন ওই ইউরোপিয়ান ব্যাঙ্ক, আইএমএফ রা মিলে গ্রীসের জন্য ফের একপ্রস্থ ঋণের ব্যবস্থা করে ২০১০ সালে, চ্ছ্রপ্রথম বেইলআউট প্যাকেজ’-এর মধ্যে দিয়ে। শর্ত দেওয়া হয়, পেনশন তুলে দিতে হবে, মধ্যশ্রেণীর ওপর চড়াহারে কর বসাতে হবে, সরকারি চাকরি কমাতে হবে ইত্যাদি। অর্থাৎ কৃচ্ছসাধন করতে হবে। গ্রীসের প্রতিষ্ঠিত দুই রাজনৈতিক দল এনডি এবং পাসোক এইসব শর্ত মেনে নেয়। কিন্তু গ্রীসের ব্যাপক মানুষ এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে শুরু করে। সদ্য গজিয়ে ওঠা বামপন্থী জোট সিরিজা বিভিন্ন নির্বাচনে জনসমর্থন পেতে শুরু করে।
কিন্তু একের পর এক বেইলআউট প্যাকেজ নিয়েও গ্রীসের অর্থনীতির হাল ফেরেনি। ফলে একটি তৃতীয় বেইলআউট প্যাকেজ ২০১৫ সালের মার্চ মাসে চালু হওয়ার কথা ছিল, আরও বেশি কৃচ্ছসাধনের শর্ত মেনে নিয়ে। এর ব্যাপক বিরোধিতা দেখে শাসক এনডি-পাসোক জোট আগেভাগেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ডাক দেয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনপ্রস্থ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন যথাযথভাবে সম্পন্ন না হওয়ায় গ্রীক সংবিধান মেনে দশদিনের মধ্যে সরকার ভেঙে দিয়ে দেশে সাধারণ নির্বাচন ঘোষিত হয়।
সরকার গঠনের সময় সিরিজা ঘোষণা করেছে, তারা ইউরোপিয়ান ব্যাঙ্কগুলোকে ঋণের বেশিরভাগটাই শোধ করবে, কিন্তু গ্রীসের অর্থনৈতিক হাল ফিরলে তবে শোধ করা হবে। নতুন করে আর ঋণ তারা নেবে না। দেশের গরিব-নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে কৃচ্ছসাধন থেকে মুক্ত করা হবে। পেনশন ফিরিয়ে আনা হবে। সরকারি চাকরি বাড়ানো হবে। কম বেতনের চাকরিগুলিতে বেতন বৃদ্ধি করা হবে। নিম্ন আয়ের মানুষদের কর ছাড়ের আওতায় আনা হবে। ঋণশোধের দরকষাকষি করার সময় তারা ইউরোপিয়ান ব্যাঙ্কগুলির সাথে বসবে, কিন্তু আইএমএফ-এর সাথে বসবে না। আগের সরকারগুলির আমলে নেওয়া বেইলআউট প্যাকেজের কোনো শর্ত এই সরকার মানবে না। আগের বেইলআউট প্যাকেজগুলো নেওয়া কেন হয়েছিল, তার তদন্ত হবে। একইসাথে তারা ঘোষণা করেছে, তারা ইউরো মুদ্রা থেকে বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে চায় না। কারণ, তাতে গ্রীস এবং ইউরোপ — দুয়েরই ক্ষতি।
তবে ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ও ধনবান রাষ্ট্রগুলি, যেমন জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতির ধারণা, গ্রীসের নয়া সরকার যে সমস্ত নীতি নিচ্ছে, তাতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে তাদের নিষ্কৃতি ও ঋণ শোধ না করার ঘোষণা কেবল সময়ের অপেক্ষা।
ইউরোপিয়ান ব্যাঙ্ক গ্রীসের ওপর চাপ বাড়িয়ে চলেছে নানাভাবে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুন তৈরি হওয়া পার্টিগুলো (যেমন স্পেন-এর পোডেমস) সিরিজাকে সমর্থন করছে।
Leave a Reply