সংবাদমন্থন পত্রিকার বার্ষিক পর্যালোচনা সভা হয়ে গেল ২৮ ডিসেম্বর। তাতে প্রথমে পত্রিকার পরিচালনা নিয়ে একটি রিপোর্ট পেশ করা হয় সম্পাদকের তরফে। তাতে দেখা যাচ্ছে, গত এক বছর পত্রিকা ডাকযোগে পাঠানোর ব্যাপারে কিছু গোলোযোগ হয়েছে। ডাক বিভাগ একের পর এক নিয়ম করছে, যার ফলে নিয়মিত প্রকাশিত পত্রিকাগুলি ডাকমাশুলে যে ছাড় পায়, তার সুযোগ ছোটো ছোটো পত্রিকাগুলোর পক্ষে পাওয়া দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। পত্রিকার সম্পাদক পরিবর্তনের কারণে পত্রিকার রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট দিল্লিতে পাঠাতে হয়েছিল — তাই সেটি দেখাতে না পারায় পত্রিকার ছাড়যুক্ত (প্রতি কপি ২৫ পয়সা ডাকমাশুল) ডাক-রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যায় ২০১৪ সালের শুরু থেকে এবং যে রেজিস্ট্রেশনটি ডাক অফিস দেয়, তাতে ২টাকা ৪০ পয়সা করে লেগেছে একেকটি পত্রিকা পাঠাতে। এইভাবে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাস অবধি চলেছে, এবং ২০১৪ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের পত্রিকা ডাকযোগে গ্রাহকদের পাঠানোই যায়নি। তার ফল হয় দুটো — ১) বেশ কিছু গ্রাহক কমে যায়। ২) পত্রিকার খরচ চালাছে ধার করতে হয়। নভেম্বর মাস থেকে আর একটি নিয়ম করেছে ডাক দফতর — মাঝখানে কোনো সংখ্যা না পোস্ট করলে পরবর্তী সংখ্যাটি থেকে আর ছাড়যুক্ত ডাকমাশুলের সুযোগ নেওয়া যাবে না, তা ফিরে পেতে গেলে আবার ডাক অফিসে গিয়ে আলাদা দরখাস্ত করতে হবে। এর ফলে যাদের কখনো কখনো যুগ্ম সংখ্যা বেরোয় তারাও মুশকিলে পড়েছে। প্রসঙ্গত, ডাক অফিসের এক করণিক একবার সম্পাদকের প্রশ্নের উত্তরে মুখ ফসকে বলেই ফেলেছিলেন, ‘ছাড় দিয়ে আপনাদের ভিক্ষে দেওয়া হচ্ছে …’। সম্পাদক জানান, সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতে এই ছাড়ের সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। সরকারগুলো শিল্পপতি ছাড়া আর কাউকেই ভর্তুকি দিতে চাইছে না। ফলে আমাদের পত্রিকা পাঠানোর অন্যান্য উপায়ের কথা ভাবতে হবে।
পত্রিকা পাঠানো হয় সরকারি ডাক-এ, ক্যুরিয়ারের মাধ্যমে, হাতে হাতে, কয়েকটি স্টলের মাধ্যমে এবং সরাসরি বিক্রি করে। এছাড়া ইন্টারনেটে বেশ কিছু গ্রাহক রয়েছে। ওয়েবসাইট থেকেও অনেকে সরাসরি পত্রিকার খবর পড়ে। এই সংখ্যাটা গত এক বছরে বেড়েছে। সংবাদমন্থন ওয়েবসাইটটি যাতে সহজে, দ্রুতগতিতে এবং মোবাইলে দেখা যায় — তার জন্য ওয়েবসাইটের নকশার কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। এই কাজে সাহায্য করেছেন আসিফ ইকবাল। পত্রিকা ছাপানোর বার্ষিক খরচ ১৬৬০০ টাকার মতো, ক্যুরিয়ার এবং ছাড়যুক্ত ডাকমাশুল বাবদ বার্ষিক গড় খরচ ৪০০০ টাকার মতো। অর্থাৎ মোট খরচ ২০ হাজার ৬০০ টাকা। পত্রিকার বার্ষিক গ্রাহক চাঁদা ৪০ টাকা ধরে যদি ৫০০ গ্রাহকের চাঁদা জোগাড় হয়ে যায় — তাহলেই পত্রিকাটি পাঠকের টাকাতেই চলে যায় — ধার, বিজ্ঞাপণ বা অনুদানের কথা ভাবতে হয় না। কিন্তু গত বছর পত্রিকার ডাকমাশুল বাবদ প্রায় ৬২০০ টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়েছে — যার পুরোটাই ধার। এছাড়া ওয়েবসাইটের নকশার পরিবর্তন বাবদ আরো ১৩০০ টাকা খরচ হয়েছে। এই অতিরিক্ত খরচ সামলানোর জন্য সম্পাদক কিছু কিছু অনুদানের আহ্বান রাখেন পত্রিকার পাঠক, গ্রাহক ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছে। এছাড়া, ইন্টারনেটে গড়ে প্রতিদিন পঞ্চাশের ওপর ‘পেজ ভিজিট’ হয়, যার পঞ্চাশ শতাংশই নিয়মিত পাঠক। এবং এই সংখ্যাগুলো ক্রমশ বাড়ছে। যারা ইন্টারনেটে নিয়মিত পত্রিকার খবরাখবর পড়েন, তাদের কাছ থেকেও নিয়মিত কিছু অনুদানের আবেদন করা যায় কি না, সে বিষয়েও আলোচনা হয়।
পর্যালচনা সভায় এরপর আগত পাঠকেরা বিভিন্ন বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেন। তমাল ভৌমিক বলেন, সম্পাদকীয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকের লেখার কথা। সেটা কি হচ্ছে? এছাড়া, যেহেতু কোচবিহার এবং শান্তিপুর থেকে প্রচুর খবর আসে এবং অনেক নিয়মিত পাঠক সেখানে আছে — তাই ওই দুটো জায়গাতেও পাঠক সভা করার কথা বলেন তিনি। কোনো একটি খবর, যা সংবাদমন্থন বেশ গুরুত্ব দিয়ে করেছে, তার ধারাবাহিক ‘ফলো আপ’ থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। নিউ ব্যারাকপুরের সুনীল হাওলাদার বলেন, আগে তিনি দশটি সংখ্যা নিয়ে বিতরণ করতেন নিজে। গত দু-বছর ধরে জীবিকার কারণে তা তিনি করতে পারছেন না। ডাকযোগে তার কাছে পত্রিকা খুবই অনিয়মিতভাবে পৌঁছয়। আরেকজন গ্রাহক দিবাকরের কাছেও কাগজ খুব অনিয়মিত পৌঁছচ্ছে। ডাক বিভাগের গোলোযোগের কথায় সম্পাদক জানালেন, কলকাতার পরিধিতে যে ঠিকানাগুলো সেগুলোতে খুবই অনিয়মিতভাবে পত্রিকা পৌঁছচ্ছে। সুনীল কাজ করে হোসিয়ারি শিল্পে। সেখানকার বিভিন্ন দিক নিয়ে নিয়মিত তাকে রিপোর্ট দেওয়ার কথা বলেন জিতেন নন্দী। সুনীল অন্যান্যদের দিয়ে রিপোর্ট লেখাতে পারে। কিন্তু তা অন্য কাউকে সংগ্রহ করতে হবে।
ডাকযোগে পত্রিকা নিয়মিত পান তিনি, জানিয়ে পাঠিকা নিবেদিতা দাস বলেন, সংবাদমন্থনে যেসব খবর পাওয়া যায়, তা অন্যান্য কাগজে পাওয়া যায় না। তিনি অন্য একটি পত্রিকার উল্লেখ করে বলেন, পত্রিকা যখন ডাকযোগে গ্রাহকদের পাঠানো হয়, সেই গ্রাহকদের নাম ঠিকানা ঠিক করে লেখা খুবই জরুরি। তা পত্রিকা পৌঁছবার জন্য যেমন জরুরি, তেমনি ঠিকানা বা নামের বানান ভুল পাঠক বা তার বাড়ির লোকের উদ্বেগেরও কারণ হয় কখনো কখনো। তরুণ পাঠক সালমান হেলাল বলেন, আমার কলেজে (দমদম মোতিঝিল কলেজ) সাইকেল গ্যারেজ নতুন করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। কলেজ খুললে তার ছবি তুলে সংবাদমন্থনে একটা খবর করব।
ঝাড়গ্রামের আঙারকুরিয়া গ্রামের অমিত মাহাতো জানান, তিনি সংবাদমন্থন-এর শুরু থেকেই জড়িত ছিলেন তিনবছর। এখানে ওখানে সাইকেল চেপে যেতেন রিপোর্ট আনতে। আগে ক্যুরিয়ার মারফত তার কাছে পত্রিকা পৌঁছত। ২০১৩-১৪ এই দু’বছর তার কাছে ডাকযোগে পৌঁছনোর কথা, কিন্তু ঠিকমতো পৌঁছচ্ছে না। ফলে সংবাদমন্থনের সঙ্গে যোগসূত্র হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে তার রিপোর্ট-ও করা হয়ে উঠছে না। আলোচনা করে ঠিক হয়, তার কাছে ফের ক্যুরিয়ারের মাধ্যমে পত্রিকা পাঠানো হবে।
উত্তর কলকাতার বলাই চক্রবর্তী বলেন, যখন ডাকযোগে কাগজ হাতে পাই, পড়ে মনে হয় একটা চিঠি লিখি। কিন্তু তা মনের মধ্যেই থেকে যায়। যেমন, মাঠে পায়খানা করা নিয়ে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ লিখেছিলেন। আমার মনে হয় মাঠে পায়খানা করাই ভালো। কবীর সুমন মীরাতুন নাহারের বাক স্বাধীনতা বিষয়ে বক্তব্য নিয়ে লেখার ইচ্ছে ছিল। একজন শানওয়ালার কাহিনী ডায়রিতে লিখেও আর পাঠাইনি। একজনের বাড়ির দেওয়ালে টাইলস-এ নানা ধর্মের চিহ্ন দেওয়া ছিল, কিন্তু কিছুদিন পড়ে দেখি ইসলামী টাইলস গুলো খুলে নেওয়া হয়েছে — কেন, তা জানার কৌতুহলও আছে, লিখলেও হয়। তবে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
স্বপনবাবু কিছু সংখ্যায় প্রুফ সংশোধনের ত্রুটির ওপর আলোকপাত করেন। সংবাদমন্থনের প্রুফ দেখে জিতেন নন্দী এবং অমিতা নন্দী। জিতেন বলেন, অনেক সময়ই একেবারে শেষ মুহুর্তে খবরগুলো আসে প্রুফ সংশোধনের জন্য। তাড়াহুড়োতে ভালো করে দেখা হয় না। সেই জন্য তিনি আগে ভাগেই সংবাদ প্রুফ সংশোধনের জন্য পাঠাতে বলেন।
হাওড়ার ব্যাতাইতলার কৃষ্ণেন্দু বলেন, আগে পাঠক ছিলাম, এখন কিছু কিছু লিখি সংবাদমন্থনে। বেশ কিছু কথা সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে। একটি মেয়ের কথা, একজন বাড়ি থেকে খেদানো মানুষের কথা, বাইক দুর্ঘটনার কথা, কানাই বৈরাগীর কথা — তাঁর স্ত্রী … ছিন্নমূল সব মানুষজন। ব্যাতাইতলার ‘বুড়োর বাগান রইল না’ শীর্ষক খবরটি করেছিলেন কৃষ্ণেন্দু। সেটি যে খুব ভালো খবর ছিল, সেকথা অনেকে বলেন। কৃষ্ণেন্দু তার কথায় আগের বছরে বঙ্কিমের লেখা একটি রিপোর্ট, যেটাতে বাইক দুর্ঘটনার শিকার একটি মেয়েকে উদ্ধারের কথা বলা হয়েছিল — তার প্রশংসাসূচক উল্লেখ করে বলেন, বঙ্কিম ঘটনার সঙ্গী হয়ে খবর করে।
বঙ্কিম বলেন, মোটরবাইক দুর্ঘটনার কথা সবাই যদি নানা দিক থেকে পাঠান, তাহলে ভালো হয় — এখন সাইকেল চালানোর কথাটা উঠছে। এই সময় মোটরবাইকের বিপদের কথাটাও বলা দরকার।
সঞ্জয় ঘোষের রিপোর্ট ‘ঠাকুরের আরতির পাখা তৈরি করেন আব্বাসউদ্দিন গাজি’ খুবই প্রশংসিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সঞ্জয় ঘোষ বলেন, যে দোকানে বসে এই আব্বাসউদ্দিন গাজিকে দেখতে পাই, সেই ছেলেটি আগে স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক ছিল। এখন ছেড়ে দিয়েছে। অনেকেই এখন ঠিকমতো টাকাপয়সা দেয় না বলে ছেড়ে দেয়। কথাপ্রসঙ্গে সঞ্জয় ঘোষ বলেন, এখন অনেককে দেখি জয়নগরে বিজেপি/আরএসএস করছে। এরা আগে করত না। এই দিকটা নিয়ে খবর হওয়া দরকার। এ প্রসঙ্গে শমীক বলেন, সৌরিন ভট্টাচার্য তার মতামত দিতে গিয়ে বলেছেন, আরএসএস স্কুলে স্কুলে কী শেখাচ্ছে সেসব নিয়ে খবর করা দরকার। হিন্দু ধর্ম আর আরএসএস-এর হিন্দু জাতীয়তাবাদ যে এক জিনিস নয়, সেসম্বন্ধেও লেখা দরকার। কিছু বইপত্রও পড়া দরকার।
সজল রায়চৌধুরি বলেন, কিছু খবর থাকছে যেগুলো আপাত তুচ্ছ, কিন্তু ভেতরে অনেক কথা থাকে — যেমন, বুড়োর বাগান, বনবাড়ির অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। আবার কিছু লেখার মধ্যে তেমন কিছু কথাই পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, বনবাড়িতে ভরত ছাড়া বাকিরা কেন থাকতে পারলো না, তার চর্চাও করা দরকার। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িকতা সুপ্তভাবে আমাদের মধ্যে কাজ করে। তার কিছু উদাহরনের কথা বললে সেগুলো নিয়ে রিপোর্ট করার কথা বলেন জিতেন নন্দী। এছাড়া আদিবাসী-জনজাতিদের ভাষা নিয়ে রিপোর্টের চাহিদাও ব্যক্ত করেন সজলদা।
শমীক বলেন, বঙ্কিমের সংবাদ-সংলাপ আরও নিয়মিত হওয়া দরকার। যেসমস্ত পাঠকরা তাদের মোবাইল নম্বর দিয়েছেন, সেগুলো বঙ্কিমকে দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি। বলেন, বঙ্কিমকেই ঠিক করতে হবে, কীভাবে পাঠককের সঙ্গে সংলাপটা চালানো যায়।
পঞ্চাদ্রী বলেন, আগে আমি পাঁচটা করে নিতাম, কিন্তু স্থানীয় যোগাযোগ কমে যাওয়ায় এখন আর নিই না। এলাকার লাইব্রেরিগুলোতে দেওয়া যায়। মোটরবাইক দুর্ঘটনা নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে পঞ্চাদ্রী বলেন, যেসমস্ত বাইক আরোহী ট্রাফিক আইনের পরোয়া করে না, তাদের মধ্যে একটা বড়ো অংশ মুসলিম যুবক।
জিতেন বলেন, ধর্মের তোয়াক্কা না করে ন্যায্য কথাটা সরাসরি বলা দরকার। এ প্রসঙ্গে অমিতা নন্দীর একটি রিপোর্ট, ‘পুলিশ নয়, মসজিদ কমিটি সামলায় দুষ্টু ছেলেপিলেদের’ এর কথা উল্লিখিত হয়। এছাড়া আলোচনার কিছুটা সারসংক্ষেপ করে জিতেন বলেন, কিছু কিছু বিষয় নিয়ে আরও কিছু কথা হতে পারে, যেমন সজলদা, সুনীল, অমিত যেসব কথাগুলো তুলল।
আলোচনায় একুশ জন অংশ নিয়েছিলেন।
Leave a Reply