সঞ্জয় ঘোষ, জয়নগর মজিলপুর, ৩০ নভেম্বর#
রাসযাত্রার সময়, এটা জয়নগর মজিলপুরে বোঝা যায় রাসযাত্রার দু-তিনদিন আগে থেকে। যখন মজিলপুর দত্তবাজারে শোলার কদমফুল পাখি নিয়ে শোলাশিল্পীরা বিক্রি করতে আসে। আর বাজারের ভর্তি তলির সাথে ফুল, পাখি হাতে লোকেদের বাড়ি ফিরতে দেখা যায়। জানি না রাসের সঙ্গে শোলার কদমফুল, কাকাতুয়া, টিয়ার সম্পর্ক কতদিনের। মন্দিরবাজার থানার বাজারবেড়িয়া গ্রামের কর্মকার পাড়ার বুদ্ধিশ্বর কর্মকার (৪২) দত্তবাজারে বাসরাস্তার একপাশে নানারকম ফুল নিয়ে বসেছিলেন। রাস্তার উল্টোদিকে কাছেই ওনার স্ত্রী ভগবতী (৩৬) শোলার কদমফুল নিয়ে বসেছেন। বুদ্ধিশ্বরের বাবা ছিলেন পেশায় কামার অর্থাৎ কর্মকার। কিন্তু বুদ্ধিশ্বরের যখন কাজ করার বয়স হল, বাবা মারা গেলেন। তাই কামারের কাজ শেখা হল না তার। তার তিন ছেলেমেয়ে সৌরভ (১৩) অষ্টম শ্রেণীতে, সুপর্ণা (৯) চতুর্থ শ্রেণীতে ও সুবীর (৭) দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াশুনা করে। বুদ্ধিশ্বরের চাষের জমি নেই। তাঁরা শ্বামী স্ত্রী এই শোলার কাজ ছাড়া অন্য কোনও কাজ করেন না।
সারা বছর তাঁরা মালিকের অর্ডার অনুযায়ী নানারকম ফুল ইত্যাদি তৈরি করেন। দেখলাম, সূর্যমুখী, ছোটো গোলাপ, সহ সাত আট রকমের ফুল রয়েছে তার পসরায়। বললেন, অর্ডার পেলে যেকোনও ফুলের নকল তারা তৈরি করতে পারেন। ডোমজুড়, ধর্মতলা, ইন্ডিয়ান অয়েল প্রভৃতি অঞ্চলের মালিকের কাছে তারা মাল দেন। এসব মাদ্রাজ বন্দর দিয়ে জাপান ইউরোপ প্রভৃতি বিদেশি অঞ্চলে চলে যায়। শোলার কাজের ওপরে নির্ভর করে তাঁর পাঁচজনের সংসার চলে। গড়ে মাসিক আয় পাঁচ হাজার টাকা। পাঁচজন লেবার দিয়ে কাজ করান, মালিকদের অর্ডারি কাজ পুরো করতে। এক হাজার ফুল পিছু দু’শ টাকা দেন লেবারদের। একটা ফুল তৈরি করতে এক টাকা পঞ্চাশ পয়সা খরচ হয়। বিক্রি হয় দু’ টাকা কুড়ি পয়সায়। সত্তর পয়সা লাভ থাকে। সারা বছর মালিকের কাজ বাদে শুধু রাসে এদিকে আসেন, আর লক্ষ্মীপূজোর সময় কলকাতায় শোলার ফুল বিক্রি হয়।
বাজারবেড়িয়া গ্রামে প্রায় দুশ পরিবার শোলার কাজ করে সংসার চালাচ্ছে বলে তিনি জানালেন। এদের কারো কারো কিছু জমি আছে। দশ বারো বছর ধরে বুদ্ধিশ্বর শোলার কাজ করছেন। শোলার কাজের আদি গ্রাম মহেশপুর থেকে দু’টি মেয়ের এই গ্রামে বিয়ে হলে তাদের থেকে শিখে শোলার কাজ শুরু হয়। চৌদ্দ পনেরো বছর আগে শাসন গ্রাম থেকে শনের দড়ি এনে মিলিটারির জন্য জাল তৈরির কাজ করতেন তারা। পরে শোলার কাজ শুরু হলে ওই শনের কাজ উঠে শ্যাওড়াফুলিতে চলে যায়। মাছবাজারের উল্টোদিকে সচিনদার চালার গায়ে রাস্তার ধারে কাকাতুয়া টিয়া ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মহেশপুরের বড়ো হালদার পাড়ার অরূপ হালদার (২২)। পাঁচ ভাইবোন ও বাবা মা নিয়ে সাত জনের সংসার তাদের। চারবিঘে ধান জমি থেকে বছরের খোরাকি হয়। মাসে শোলার কাজে গড় আয় হয় চার হাজার টাকা। সাদা কাকাতুয়ার দাম কুড়ি টাকা। এরকম আরও কয়েকটি পরিবার আশেপাশে শোলার ফুল পাখি বিক্রি করছে। এক বৃদ্ধ বললেন, আগে একজন মাত্র শোলার ফুল নিয়ে আসত। এখন অনেকে আসছে।
Leave a Reply