১৫ এপ্রিল, খায়রুন নেসা, শুভ্রা ভট্টাচার্য ও খুসনাহার খাতুন, মহেশতলা#
আমাদের এখানকার বস্তিগুলোতে শিশু-বিবাহ দিন দিন বাড়ছে। কখনও বাবা দেখে দিচ্ছে, আবার কখনও ছেলেমেয়েরা নিজেরা প্রেম করে বিয়ে করছে। বিশেষ করে এই গার্ডেনরীচ এলাকা ও মহেশতলায় মেয়ে সুন্দর হোক বা না-হোক, কম বা বেশি বয়সি হোক, ছেলের বাড়ির লোকেরা মেয়ের বাড়ির কাছে ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা ডিমান্ড করছে। এটা মুসলমানদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যাচ্ছে। এটা আসলে পণ, কিন্তু বলা হয় যৌতুক — আপনার মেয়েকে খুশি হয়ে দেবেন! আবার এটাও বলে, শুধু ক্যাশটাই দেবেন, আমাদের আর কিছু লাগবে না! কিন্তু মেয়েকে যে দেবে, সে তো খাট-বিছানা, কিছু গয়না দেবেই। মুসলমান পরিবারে বেশিরভাগ ঘরেই এখন বিয়ের সঙ্গে রেজিস্ট্রি হয়। সেটাকে বলে কাবিলনামা। তাতে লেখা থাকে মেহের, চলতি ভাষায় দেনমোহর। একজন ছেলের সঙ্গে যে একজন মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, তাতে মেয়ের সিকিউরিটি কী? ওই মেহের হচ্ছে সিকিউরিটি। ছেলের বাড়ি থেকে মেয়েকে হাজার-এক টাকা বা পাঁচশো-এক টাকা দিয়ে দেয় দেনমোহর হিসেবে। এছাড়া কাবিলনামায় লেখা হচ্ছে, এত টাকা বিয়ের যৌতুক হিসেবে দেওয়া হল। পণ বা ছেলের বাড়ির ডিমান্ড হিসেবে কিন্তু লেখা হচ্ছে না।
পণ নেওয়ার পরেও কিন্তু বেশিরভাগ মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে শান্তিতে থাকছে না। যেহেতু অল্প বয়সে বিয়ে হচ্ছে, পরিণত বুদ্ধি নয়, তাই মেয়েরা সেখানে অ্যাডজাস্ট করতে পারছে না। তার ওপর শাশুড়ি-শ্বশুর বা স্বামী মানসিক অত্যাচার করছে। যারা দেখেশুনে বিয়ে দিচ্ছে তার চেয়েও বেশি নিজেরা যারা ভালোবাসা করে বিয়ে করছে, সেখানে এইসব হিংসার ঘটনা ঘটছে। ধরা যাক, প্রেম করে বিয়ে হল, সেখানে কিছু যৌতুক পেল না, পরে ঘর করতে গিয়ে সেখানে তার ওপর ডিমান্ড হচ্ছে, এই এই জিনিস বা এত টাকা তোমার বাবাকে দিতে হবে। না দিতে পারলে তার ওপর মানসিক বা শারীরিক অত্যাচার হচ্ছে। যে স্বামী সে তো বাচ্চা, তার হয়তো কোনো ইনকাম নেই, বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীল। তখন দেখা যাচ্ছে, তার এই বউকে ছেড়ে দিয়ে অন্য মেয়ের প্রতি আসক্তি বাড়ছে। এর ফলে বাড়ছে সাংসারিক অশান্তি।
আমাদের এলাকার বস্তিগুলোতে শিশু-বিবাহ বেশি দেখা যাচ্ছে। মেয়ে হোক বা ছেলে হোক বারো বছর থেকে শুরু হয়ে যাচ্ছে। ষোলো-সতেরো বছর বয়সে ছেলেরা অনেকেই বিয়ে করে নিচ্ছে। বস্তির বাইরে মধ্যবিত্ত এলাকায় কিন্তু এই সমস্যা কম। বাবা-মায়ের ধারণা হচ্ছে, আমার মেয়ে বড়ো হচ্ছে, কোথায় কী করে বসবে, কার সঙ্গে পালিয়ে যাবে, তার চেয়ে বরং দেখেশুনে একটা বিয়ে দিয়ে দিই। এইসব বিয়ে স্থানীয় স্তরেই হয়। অনেক সময় কোনো ছেলে হয়তো কর্মসূত্রে এখানে এসেছে, তাকে দেখেশুনে তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল। কিংবা গ্রামে থাকে আত্মীয়, তার সঙ্গে যোগাযোগ করে পাত্র দেখে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এখানে কিন্তু প্রশাসন বা আইন-কানুন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও কিছুই করতে পারছে না। প্রশাসনের কাছে গেলে তারা বলে, আপনারা ভবানীভবনে চাইল্ড-ম্যারেজ সেলে গিয়ে কথা বলুন। অথচ মেয়েরা এইসব বস্তিতে আগের চেয়ে বেশি পড়াশুনা করতে যাচ্ছে। ছেলেদের তুলনায় সেখানে মেয়েদের লেখাপড়ার হারটা বেশি। আগে মা-বাবারা ছোটো ছোটো মেয়েদের কাছে আরও ছোটো বাচ্চাদের রেখে কাজে চলে যেত। এখানে আমরা নন-ফর্মাল এডুকেশনের মাধ্যমে মেয়েদের অক্ষর জ্ঞান করিয়েছি। এরপর যখন এদের স্কুলে ভরতি করতে যাওয়া হল, স্কুল-কর্তৃপক্ষ বলত, ওই বস্তিতে তো চোর-ডাকাত থাকে, আমরা ওদের নেব না। এর সঙ্গে লড়াই করে করে আজ কিছু ছেলেমেয়ে বস্তির বাইরের স্কুলগুলোতে পড়তে যাচ্ছে, দু-একজন মাধ্যমিকও দিচ্ছে। কিন্তু তখন সেই মেয়ের পরিবারের ওপর চাপ আসছে, তোর মেয়ে বুড়ি হয়ে গেছে, আর বিয়ে-থা হবে না। ফলে তখন সেই মেয়েদের আরও কিছু করার ইচ্ছা থাকলেও বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
Leave a Reply