মমি জোয়ারদার , শিলিগুড়,৯ আগস্ট#
প্রত্যেকবছর এই সময়টা এলে খুবই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি- কারন আমাকে প্রায়ই শিলিগুড়ি-কোচবিহার সরকপথে যাতায়াত করতে হয়। প্রথমত বর্ষার হুরু থেকেই কিভাবে যেন রাস্তাগুলো ভাঙতে শুরু করে আর মাঝবর্ষায় এসে এমন অবস্থা হয় যে জলভরা গর্তগুলো মৃত্যুফাদ হয়ে বাস,ট্রাক, ছোট গাড়ি, বাইকযাত্রীদের দূর্ঘটনার কারন হয়ে থাকে। অনেক বাসমালিক বাস নষ্ট হয়ে যাবার আশঙ্কায় সাময়িকভাবে ঐ পথে বাস চালানো বন্ধ রাখেন, ফলে ঐ রূটে বাস কমে যাওয়ায় যে বাসগুলি চলে তাদের ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রীবহন করতে হয়। আর এই ১৩৮ কি.মি রাস্তা যেতে সময় লেগে যায় কম করে ৭ ঘন্টা।
কিভাবে প্রত্যেক বছর ঠিক একই সময়ে এখই রাস্তা চলার অযোগ্য হয়ে ওঠে আর তার কোনও স্থায়ী সমাধান কেন বছরের পর বছর গড়িয়ে গেলেও হয়ে ওঠে না – এই প্রশ্নের উত্তর আদৌ পাওয়া যাবে কি না সেটা জানা নেই। এখন উত্তরবঙ্গবাসীর বিভিন্ন অভ্যেসের মধ্যে এটাও একটা হয়ে গিয়েছে যে জুন মাসের প্রথম থেকে রাস্তা ভাঙতে ভাঙতে জুলাই এর মাঝামাঝি চরম অবস্থায় পৌঁছে যায় আর সেই দুর্ভোগ চলতে থাকে সেপ্টেমবরের শেষ পর্যন্ত। গোটা পঞ্চাশ দূর্ঘটনা আর কয়েকবার অকারন পথ অবরোধে মেলা আশ্বাসের পর রাস্তার কাজ শুরু হয় পূজোর আগে শেষ হয় নভেম্বরে আর ঠিক থাকে মে মাসে বৃষ্টি নামার আগে পর্যন্ত।
৫ই আগস্ট সোমবার শিলিগুড়ি থেকে কোচবিহার আসবো বলে সকাল ৭টা নাগাদ বাসে উঠে পড়লাম, ৮.৩০ নাগাদ জলপাইগুড়ি পেড়িয়ে তীস্তা ব্রিজের কাছাকাছি এসে বাস থেমে গেল। সামনে প্রবল যানজট। বড়গাড়ি তো দূরের কথা ছোট গাড়ির ও যাওয়া অসম্ভব। কিছুক্ষণ বাসে বসে অপেক্ষা করলাম, বাসের অনেক যাত্রী নীচে নেমেছেন, ড্রাইভারকেও দেখা যাচ্ছে না। আমিও নীচে নামলাম, এবারে বোঝা গেল যানজটের আসল কারন। কয়েক হাজার গেরুয়া পোষাক পড়া পূণ্যার্থী জল নিয়ে চলেছেন জল্পেশের মন্দিরের দিকে, শিবের মাথায় ঢালার জন্য। পূণ্যার্থীরা রাতভোর থাকতেই এসে পৌঁছেছেন তীস্তাব্রীজের কাছে ছোট-বড় গাড়ি, টেম্পো, বাস, এমনকি ছোট ছোট পিক-আপ ভ্যান নিয়ে আর গাড়িগুলিকে সেখানে রাস্তার উপর, ব্রীজের উপর রেখে তীস্তা নদীতে নেমেছেন স্নান সেরে ঘটে জল ভরে আবার চলেছেন মন্দিরের দিকে। ব্রীজের দুপাস থেকেই পূণ্যার্থীদের গাড়ি আসার কারনে ব্রীজ ও তার দুপাশের রাস্তা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কয়েক হাজার পূণ্যার্থীকে নিয়ে আসা কয়েক’শ গাড়ি তখন ব্রীজের উপর আর দুপাশের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়ানো। ফলত ভয়াবহ যানজট।
আর স্বাভাবিকভাবেই ঐ যানজটে আটকে পড়া যাত্রীদের নিয়ে কারো কোন মাথাব্যাথা নেই, কোনওদিন থাকেও না। ধর্মের নামে যে কোন কিছুর সাথেই আপোষ করে নেওয়া যায়, কেউ কোন প্রশ্ন করে না। পূণ্য অর্জন সবসময়েই যন্ত্রনার হতে হবে, সে নিজের এ হোক বা অন্যের। বাঁশ দিয়ে রাস্তা আটকে পূজা ঈদ এমনকি মাষান পূজার সাথে রাতভোর জলসার চাঁদাও সংগ্রহ করা যায় জবরদস্তি।আগে এই ব্যাপারটা বাস বা ট্রাক এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তো বাইক, সাইকেল যাত্রীদের এই আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। আর যেহেতু ধর্মের স্ট্যাম্প লাগানো আছে তাই বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে হবে।
ঘণ্টা চারেক পর আবার বাস ছাড়লো, তীস্তা ব্রীজ পেরিয়ে খুব ধীরে চলতে থাকা বাস এবসে ততক্ষণে প্রয়োজনীয় কাজ করার আশা ত্যাগ করেছি। একসময়ে জট কাটলো কিন্তু গাড়ির গতি আর বাড়লো না, ততক্ষণে আবার ভাঙ্গা রাস্তায় ঢুকে পড়েছে বাস। পূন্ডিবাড়ি ঢোকার মুখে আবার রাস্তা বন্ধ, মালবোঝাই ট্রাক বিকল হয়ে রাস্তার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে। কোনমতে একটি গাড়ি চলতে পারে, সেখানেও ছোট গাড়িগুলি যথারীতি বেনিয়মে ঢুকে গিয়ে যাতায়াতের রাস্তাটাই বন্ধ করে ফেলেছে প্রায়। শেষ পর্যন্ত আবার জট কাটলো আবার বাস ছাড়লো কোচবিহার বাসস্ট্যান্ডে যখন নামলাম তখন বিকেল ৪টে। এই ১৩৮ কি.মি. পথ পাড়ি দিতে লেগে গেল ৯ ঘন্টা। ততক্ষনে আমার রাগ, বিরক্তি, ক্ষোভ সম মিলিয়ে একটা নির্লিপ্ত ভাব চলে এসেছে – এটাই আমাদের ভবিতব্য, এটাই আমাদের মেনে নিয়ে চলতে হবে দিনের পর দিন।
Leave a Reply