উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে ৯০ শতাংশ নম্বরও আজ এই রাজ্যের পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়। টাকার দামের সাথে সাথে নম্বরের দাম কেমন হারে কমেছে ভাবুন। অথচ আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে যখন ৭ পয়সায় কোয়ার্টার পাউন্ড রুটি বা ১০০ গ্রাম মুড়ি পাওয়া যেত, তখন উচ্চমাধ্যমিকে ছেলে ষাট শতাংশ নম্বর বা ফার্স্ট ডিভিশন পেলেই বাবা-মায়েরা আহ্লাদে আটখানা হতেন। তখন সায়েন্স ও কমার্স বিভাগের পাশাপাশি হিউম্যানিটিস বলে আলাদা একটা বিভাগ ছিল যেটা আজ আর্টস নামক একটা নাক-সিঁটকানো শব্দে খুব অবহেলাভরে উচ্চারিত হয়। এবং তা হওয়ার একটা কারণ তৈরিও হয়ে গেছে। এই তৈরি হওয়ার পেছনে সমাজ তথা রাষ্ট্রের ভূমিকা কেমন ও কতটা সে আলোচনায় না গেলেও ওই ভূমিকা যে ছিল তা অস্বীকার করা যায় না। একটা উদাহরণ দিই। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে সায়েন্স, আর্টস ও কমার্স বিভাগের প্রতিটিতে প্রথম দশজন স্থানাধিকারীর নাম আলাদা আলাদা করে ছাপিয়ে দেওয়া হত।
এরকম স্থান-নির্ণয় ও ভালো ছেলেদের নাম ছাপানো ঠিক কিনা তা আলাদা বিতর্ক। কিন্তু আমরা দেখলাম, কী করে এবং কখন যেন ওই প্রথা উঠে গিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে সব বিভাগ মিলিয়ে প্রথম কুড়িজনের নাম ঘোষণা করা চালু হয়ে গেল। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রথম কুড়িজনের মধ্যে সায়েন্স ছাড়া অন্য দুই বিভাগের কৃতি ছাত্র-ছাত্রীর নাম আসা মুশকিল হয়ে গেল — কারণ কমার্স ও আর্টস বিভাগে সায়েন্সের তুলনায় সাধারণত নাম্বার কমই ওঠে। অতএব, ণ্ণসায়েন্স না পড়লে হবে না ভালো ছেলে’ — এর প্রতিষ্ঠা অনেকটা আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে।
আজ তা এতদূর যে আর্টস গ্রুপের দামি সাবজেক্ট ইকনমিক্স বা অর্থনীতি নিয়ে যাদবপুরের মতো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হয় তারা প্রায় সবাই সায়েন্স বা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে আসা ছাত্রছাত্রী। খুব কমই আছে যারা ইকো-স্ট্যাট-ম্যাথসের মতো নম্বর উদ্রেককারী আর্টস বিভাগ থেকে ঢুকেছে। অন্যদিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন (একটু কমা) কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপকরা চিন্তিত হয়ে পড়ছেন যে তাঁদের বিভাগে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কেন কমে যাচ্ছে। অর্থনীতির মতো বেশ দামি বিষয়েই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে বাংলা, দর্শন, ইতিহাসের মতো অন্যান্য বিষয়গুলোর (অবশ্যই ইংরাজি বাদ দিয়ে, কারণ এই বিদেশি ভাষার দাম আমাদের অভিশপ্ত দেশে সর্বত্র ও সর্বসময় বেশি) কী অবস্থা বোঝাই যাচ্ছে।
এই যে দামি বিষয় বলছি, তা অবশ্যই টাকার দামে এবং নম্বরেরও দামে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, যারা বেশি নম্বর পায়, তারা বেশি চাকরি পায়। যারা খুব বেশি নম্বর পায় তারা খুব বড়ো চাকরি পায় এবং খুব তাড়াতাড়ি পায়। চাকরি বড়ো হওয়ার সঙ্গে টাকা বেশি হওয়ার সম্পর্ক বলে দিতে হয় না। অতএব বিষয় শিক্ষার মূল চাহিদা হল ওই বিষয়ে বেশি নম্বর পাওয়া। পরীক্ষার নম্বর বিষয় শিক্ষার মাপকাঠি কিনা এরকম কঠিন প্রশ্নে যাচ্ছি না। কিন্তু বড়ো টাকার জন্য বড়ো চাকরি, বড়ো চাকরির জন্য বড়ো নম্বর, বড়ো নম্বরের জন্য বিজ্ঞান পড়া একটা স্বতঃসিদ্ধ প্রণালী হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা পঞ্চাশ বছর আগে ছিল না। তখন অবশ্য জয়েন্ট এন্ট্রান্স নামক যন্ত্রণাদায়ক পরীক্ষা ও ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর জন্য অভিভাবকদের পাগলামিরও এতটা রমরমা হয়নি। যদিও বাংলা অনার্স পড়লে বড়োজোর বাস কন্ডাকটরি পেতে পারিস তার চেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়েই ভর্তি হ — এরকম একটা কথা প্রায় সত্তরের দশক থেকেই চালু হয়ে গেছে। কিন্তু তার জন্য বাবা-মা-মামা-কাকা-জামাইবাবু সহ গুষ্টিশুদ্ধ সবাইকে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের আলাদা কোচিং-ক্লাসের থেকে শুরু করে পরীক্ষাকেন্দ্র বা কাউন্সেলিং হলে দৌড়োদৌড়ি করতে তখনই দেখা যায়নি। সে হতে তো আরও সময় লাগবে। তার আগে প্রতিবেশী ভদ্রলোক তাঁর বড়ো মেয়েকে প্রথম থেকেই ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ হিন্দি ও সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ ইংরেজিতে সাউথ পয়েন্টে ভর্তি করে দিয়ে এসে বলবেন, ণ্ণবাংলা শিখিয়ে কী হবে, কোথাও কাজ পাবে?’ আমার ছাত্র মাধ্যমিকে সায়েন্স বিভাগে ৭৫ শতাংশ নম্বর পাওয়ার পরও আমি যখন বলব, সে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান পড়ার মতো উপযুক্ত নয়, তখন ছাত্রের বাবা জ্যোতিষীকে হাত দেখিয়ে এসে আমাকে জানাবেন যে জ্যোতিষী গণনা করে জানিয়েছেন, ছেলে বিজ্ঞান পড়লে ভালোই করবে। এবং তা সত্ত্বেও আমি পড়াতে রাজি না হলে উচ্চমাধ্যমিকে সায়েন্স পড়িয়ে, প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে তিন লাখ টাকা খরচ করে ভর্তি করে ছাত্রের বাবা গর্বের সঙ্গে সেই খবর আমাকে ফোনে পরিবেশন করবেন, আর মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকে আশানুরূপ ফল করতে না পেরে কোনো কিশোর বা কিশোরী আত্মঘাতী হলে তার নাম আমরা চটপট ভুলে যাব।
অমিতাভ সেন, কলকাতা, ২৯ জুন
Leave a Reply