মিঠুন চাকমা, বাংলাদেশ, ৮ ফেব্রুয়ারি#
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ জাতিগতভাবে নিজেদের ‘বাঙালি’ বলেই পরিচয় দিয়ে থাকে। কিন্তু দেশের মধ্যে অন্য জাতিসত্তার জনগণও রয়েছে। তাদের অবস্থানের ইতিহাস স্মরণাতীতকাল ধরে। ১৬ কোটি জনসমষ্টির তুলনায় হয়তো এই ভিন্ন জাতি বা ভাষাভাষী জনগণের সংখ্যা এক শতাংশরও কম। কিন্তু তারপরও তাদের অস্তিত্ব যে রয়েছে তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। এবং দেশ নির্মাণে এই ক্ষুদ্র জনসমষ্টির ভূমিকা বেশি বই কম নয়।
এবার প্রসঙ্গে আসি, শাহবাগের লড়াই বা অন্য যে কোনো লড়াইয়ে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বা জাতির পাশাপাশি অন্য জাতিসত্তার জনগণও সবসময় একীভূত হবার চেষ্টা করেছে। শাহবাগের লড়াইয়েও তারা সক্রিয় থাকার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই লড়াইয়ের শ্লোগানের সবগুলোতে কণ্ঠ মেলালেও যখনই ‘জয় বাংলা’ বা ‘তুমি কে, আমি কে — বাঙালি, বাঙালি’ বলা হয়েছে তখনই তারা এই শ্লোগানের সাথে একাত্ম হতে পারেনি। কারণ তাদের ভিন্ন জাতিসত্তার অস্তিত্বের চেতনাবোধের জন্য।
এই শ্লোগান দেওয়ায় ভিন্ন জাতিসত্তার জনগণের আপত্তি থাকলেই যে তা বন্ধ করার আহ্বান জানানো সমীচীন হবে তা মানার মতো কথা নয় হয়তো। একটি বৃহৎ জাতি তার জাতিচেতনাকে লালন করবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই শ্লোগানের আড়ালে যখন থাকে ‘ছদ্ম জাত্যাভিমান’, যখন থাকে ‘জাতিবিদ্বেষ’ তখন কিন্তু এই শ্লোগানকে নিছক সাদামাঠা শ্লোগান হিসেবে ভাবা যায় না, ভাবা সম্ভব বা সমীচীনও নয়।
আমরা দেখেছি ১৯৭১ সালের পর শেখ মুজিব যখন রাঙামাটিতে নির্বাচনী ভাষণ দিতে যান তখন তিনি পার্বত্য জুম্ম জনগণকে ‘বাঙালি জাতিতে প্রমোশন’ দিয়ে দেবার কথা ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘোষণার কারণেই পার্বত্য জনগণ সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে জাতিসত্তার অধিকার আদায়ের কথা চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছিল।
স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে প্রণীত দেশ পরিচালনার মূলনীতি সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিসমূহের কথা লেখা হয়নি। গত ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে জাতি হিসেবে বাঙালি বলা হয়েছে। সংবিধানের প্রথম ভাগের ‘প্রজাতন্ত্র’ অংশে লেখা রয়েছে,’ (২) বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’। এই সংবিধানের মাধ্যমে অন্য জাতির অস্তিত্বের কথা পুরোদস্তুর অস্বীকার করা হল, অথবা অন্য জাতির জনগণকে বানানো হল কার্যত দ্বিতীয়/তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে।
আজ এই ফ্যাসিস্ট সংবিধান নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য কেউ করছে না। উপরন্তু নতুন যে লড়াই নতুন প্রজন্ম শুরু করেছে সেখানেও আমরা দেখছি এই ‘জয় বাংলা’ বা ‘তুমি কে, আমি কে — বাঙালি, বাঙালি’ শ্লোগান।
অনু লিখন says
আপনার লেখা ভালো লাগলো । পিনাকীদাদা কিন্তু ফেবুতে এই নিয়ে লিখেছিলেন । আপনাদের নিয়ে কিন্তু নতুন প্রজন্মের চিন্তাভাবনা অনেক ইতিবাচক । আমরা চাই সবাই মিলে একটি সহিষ্ণু সমাজ গড়ে তুলতে । কিন্তু এই আন্দোলনে হয়ত এই শ্লোগান থামবে না । ভবিষ্যতে আশা করি বিষয়টি নিয়ে সবাই ভাববে ।
Mithun Chakma says
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
লেখালেখি করি আসলে এই নতুন প্রজন্মের ইতিবাচক মনোভাব যাতে আরো দৃঢ় হয় তার জন্য। আমার এই লেখা যদি বাংলাদেশের মুল মিডিয়ায় প্রকাশ করতে পারতাম তবে বোধহয় আরো ভালো হতো। আরো অনেকে জানতো এই বিষয়টি নিয়ে। আমরা জানি এই শ্লোগানটি এখন বন্ধ হবে না। এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে জাতীয়তার চেতনা থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ মনেকরি। কিন্তু অন্য জাতিসত্তার মতামতকে গুরুত্ব দিলে এই চেতনা বাড়বে বই কমবে না বলেই আমার মত।
আপনাকে আরেকবার অসংখ্য ধন্যবাদ
Mithun Chakma says
উপরের লেখাটি আমি ফেসবুকে শেয়ার করার সময় নিচের বক্তব্য লিখে শেয়র করি। সকল পাঠকদের জানার সুবিধার্থে আমি তা যোগ করলাম।
“লেখাটি আমি বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় প্রকাশের জন্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু কেথাও প্রকাশ করা হয়নি। সংবাদ মন্থন ওয়েবসাইট লেখাটি প্রকাশ করার জন্য তাদের ধন্যবাদ। লেখাটিতে বাক্য বিন্যাস-শব্দ চয়ন ইত্যাদির নানা দুর্বলতা থাকতে পারে কিন্তু লেখার মধ্যে যে বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা হয়েছে তা আমার মতে অনেক গুরুত্ববহ। ব্লগসাইট ব্যতীত অন্য ওয়েবে প্রকাশ না করায় আমার মনে হয়েছে বাক স্বাধীনতা, অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে অনেকে অনেক কিছু বাগাড়ম্বর করলেও তাদের মধ্যে থাকা ..ইজম কে তারা ছুড়ে ফেলতে পারেনি।”