১২ই ডিসেম্বর, অমিত মাহাত, লালগড়#
সে সময় মাওবাদি হিড়িক। লাশ পড়ছে। গাঁয়ে পাড়ায় তখন অলিখিত সান্ধ্য আইন। আলোহীন। নিস্পন্দ গ্রাম।মন চাইছিল না। বাইরে পা রাখি। তবুও রাখলাম। আমার মামা বাড়ির পাশে ছেঁড়াবনি গ্রামে মেলা যখন – সাইকেল সহযোগে বেড়িয়ে পড়লাম। আলোহীন রাতের গ্রামে আলোয় খোঁজে।
বৈশাখের গাজনে এবার অন্যবারের মত পুরুলিয়া আসেনি। আসেনি বাঘমুন্ডির গতবারের দল। এবার নিজেরাই নাচবে। গঙ্গাধরপুর ছো নৃত্য দল। জঙ্গল মহলে সমাদৃত এবার সিধু কানহু। সাঁওতাল বিদ্রোহ। মনে জায়গা করে নিয়েছে এই পালাটি।
ঢোল নাগরা সহরতে পালা শুরু হল।
ছোটনাগপুর পাহাড় সংলগ্ন গ্রাম। আদিবাসিরা জঙ্গল কেটে বাসযোগ্য ও চাষযোগ্য জমি করেছে। কখনো ঠিকাদারি লাইনের আড়কাঠি বাবুরা আসে। তাদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির জন্য নিয়ে যায়। কখনও রেল লাইন পাতার কাজে। কখনো বা পাহাড় কাটানোর কাজে। কখন ও মাটি কাটার কাজে।
এইভাবে বেশ চলছিল। শান্তিপ্রিয় এই কালো মানুষ গুলোর নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যাপন। এই সময়ই দুর্যোগের মেঘ ঘনাল আদিবাসি মহল্লায়।
ওদের কাঁচা রোজগারের গন্ধে লুব্ধ হল সেখানকার দেশীয় জমিদার ও মহাজনেরা। নজরে পড়ে গেল আদিবাসি কিশোরী ও যুবতী স্ত্রীদের ভরন্ত শরীর।
তবুও এ ছিল সহনীয়। সীমা ছাড়াল ব্রিটিশ পুষ্ট কুখ্যাত মহেশ দারোগা। লুন্ঠিত হতে থাকল নারীর নারীত্ব। মাটিকাটা মানুষ গুলোর শান্তি বিঘ্নিত হল। দেখলাম অত্যাচারিত আদিবাসিদের। চোখে জল এসে যাচ্ছিল। যেন লালগড় দেখছি এদের দক্ষ অভিনয়ে। নামল ইংরেজ সেনা। চার দিক দিয়ে ঘিরে ফেলল আদিবাসি গ্রাম। অসংখ্য পুরুষ ও নারী মারা গেল পুলিসি এনকাউন্টারে।
সেদিনের সেই এনকাউন্টারে মৃত ভাই বোনের রক্তে শপথ নিল সিধু কানহু। পাশে দশ হাজার স্বজাতি জনেরা। ভগনাডিহির মাঠ ভরে গেল। আমার মনে হল পড়ে থাকা মৃতদেহ গুলোর একটা যেন রাজারাম মান্ডি। একটা তার ছেলে লক্ষিন্দর এবং গোপীনাথ সরেন। স্পষ্ট দেখলাম লাল মোহন টুডুকে। আল জমিনে পড়ে রয়েছে তার লাশ।
মুক্তমঞ্চে তখন হুল হুল রব। হুলা। হুলসাই সেঙ্গেল। সিধু কানহু মেতেছে ওদের নিজস্ব উৎসবে। চলছে নাচ গান। অতর্কিতভাবে ছুটে এল পুলিস বাহিনী । দেখলাম। তীর ধনুক আর গুলি বারুদের অসম লড়াই। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল রক্ত, মৃত্যু। ভোরের রক্তস্নাত সূর্য্য উঠল তার পর।
Leave a Reply