মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিনিকেতন, ৩০ জানুয়ারি#
শান্তিনিকেতনের বিশ্ববিদ্যালয়-অতিরিক্ত যে সমাজজীবন, সেখান থেকে আরও একজন হারিয়ে গেল। এমন একজন যে সেবার কাজে নিবেদিত প্রাণ, উচ্ছ্বল প্রাণশক্তিতে ভরপুর, সকলের প্রিয়জন প্রয়াত শ্যামলী খাস্তগীরের খুব কাছের মানুষ টুটুল, টুটুল রায়। শান্তিনিকেতন তথা বোলপুর চত্বরে ঘুরে বেড়ানো, সকলের কাছে তাড়া খাওয়া, সকলের কাছে পরিত্যক্ত-প্রাণ, মানুষ যাদের ইতরপ্রাণী বলেই সন্তুষ্ট, টুটুল এবং সহযোগী কয়েকজনের তৈরি ‘মৈত্রীভাবনা’ বেশ কয়েকবছর ধরে এদের শুশ্রূষার ভার নিয়েছে, প্রয়োজনে তাদের আশ্রয় দিয়েছে সংস্থার আশ্রয়গৃহ দিয়ে, দৈনন্দিন চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে। আর এই বিশাল কাজটি অত্যন্ত নৈপুন্যে সামলেছে টুটুল।
শান্তিনিকেতনে টুটুলের যোগাযোগ এক প্রজন্ম আগে থেকেই। টুটুলের মা তৃপ্তি রায় শ্যামলী খাস্তগীরের সহপাঠী ছিলেন এখানে। ভূগোল বিভাগের কৃতি ছাত্রী টুটুল কিন্তু উচ্চশিক্ষার পথে যায়নি। তিলতিল করে গড়ে তুলেছে এই সংগঠন। এখানে কুকুর, বিড়াল, হনুমান, যে যেখানে বিপন্ন, সেখানেই সে আগে ছুটেছে। গোটা পশ্চিমবঙ্গে এই নজির বিরল যে প্রায় দুশোর বেশি কুকুরের বন্ধ্যাকরণে টুটুল কৃতকার্য হয়েছিল। তার বাড়িতে গেলেই চোখে পড়ে বেশ কিছু দামি কুকুর। কলকাতা বা শান্তিনিকেতনে অনেকেই সমাজে ওপরে ওঠার লক্ষণ হিসেবে এইসব কুকুর রাখে। পরে যখন তারা অসুস্থ বা বৃদ্ধ হয়ে যায়, তাদের পথে ছেড়ে দেওয়া হয় জীবনযুদ্ধে যুঝবার জন্য। টুটুল এইসব অভাগাদের এনে সুস্থ করে তুলত, কাউকে কাউকে নতুন ঘরও খুঁজে দিত। একবার একটা হনুমানের হাত লাগল বৈদ্যুতিক তারে। কলকাতায় নিয়ে গিয়ে অস্ত্রোপচারের দায়িত্ব টুটুলের। তার জন্য বন্ধুদের কাছে সে অর্থভিক্ষা করেছে। শ্যামলীমাসির কন্যাসমা টুটুল ওঁর জীবনকেই আদর্শ মানত। সাদাসিধে জীবন, আড়ম্বরহীন পোশাক, দেখলেই একমুখ হাসি, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, এই হল টুটুল। সে বরাবরই অন্যদের থেকে আলাদা। সংগীতে তার বিশেষ আগ্রহ, বরাবরই বাউলসংগীত বা অন্যান্য গানের সঙ্গে তার যোগাযোগ। একসময় বহু ছাত্রছাত্রী আসত টুটুলের কাছে, কারণ ভূগোল পড়ানোয় তার জুড়ি মেলা ভার। টুটুলের মা-ও এক অসাধারণ মহিলা। বহুকাল ধরে বর্ধমানের কাছে বামবটতলায় তিনি অনাথ আশ্রম চালাচ্ছেন। আর এদিকে টুটুলের প্রেরণায় চলছিল ‘মৈত্রীভাবনা’।
কোনো এক অমোঘ টানে বাউলসংগীতের প্রতি আকর্ষণে গত বাইশে জানুয়ারি মধ্যরাত্রে একটি অনুষ্ঠান সেরে ঘরে ফেরার পথে ইলামবাজার জঙ্গলের কাছে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সে আমাদের ছেড়ে চলে গেল। একান্ত অকালেই এই যাওয়া। সামনেই একমাত্র সন্তান সায়নের মাধ্যমিক পরীক্ষা। শ্যামলীমাসির ভাবধারায় অনুপ্রাণিত টুটুল ওঁর সমাধিক্ষেত্র তিলুটিয়ায় ওঁর পায়ের তলার জায়গাটা আশ্রমের সদস্য বিশ্বজিতের কাছে ঠাট্টাচ্ছলে বোধহয় চেয়ে রেখেছিল। ওখানেই তাকে সমাধিস্থ করা হল তেইশে জানুয়ারি। চোখের জলে তাকে বিদায় জানালেন ওর জীবনসঙ্গী ব্রতীন এবং তার গুণমুগ্ধ ছেলেমেয়েরা। সেদিন দেখা গেল যুবসমাজের মধ্যে তার প্রভাব কতখানি ছিল। একই দিনে টুটুলের সঙ্গে আহত হয়েছিলেন বিখ্যাত বাউলশিল্পী গৌর খ্যাপা। পরবর্তীকালে তাঁকেও আমরা হারালাম।
শ্যামলীমাসির পায়ের তলায় শুয়ে রইল টুটুল। পড়ে রইল তার আরদ্ধ কাজ।
Leave a Reply