রঘু জানা, মানিকতলা হাউসিং এস্টেট, কাঁকুড়গাছি, ৬ এপ্রিল#
আজ সকালে একটা দরকারে কালিন্দি যেতে হয়েছিল। ভিআইপি রোড লেকটাউন থেকে বাঁদিকে ঢুকে যশোর রোডের দিকে যাবো, দেখি ফুটপাথ কেটে রাস্তা চওড়া করা হচ্ছে। রাস্তা প্রশস্তিকরণ ও সৌন্দর্য্যায়নের কাজটি মমতা ব্যানার্জির অনুপ্রেরণায়, বিধায়ক সুজিত বসুর উদ্যোগে ও পূর্তবিভাগের তত্ত্বাবধানে চলছে। একথা জানানোর জন্য বিরাট বড়ো ব্যানার ফ্রেম করে লাগানো হয়েছে। বেশ কতগুলো বড়ো বড়ো বহুদিনের পুরনো গাছগুলোকে উপড়ে ফেলা হয়েছে। ভাঙা ফুটপাতের মাপ দেখে মনে হলো, হেঁটে যাতায়াতের খুবই অসুবিধা হবে। অথচ রাস্তার গায়ে লেকটাউন গার্লস স্কুল। গার্লসকলেজ ও এখানে। স্কুল বসা বা ছুটির সময় অবস্থাটা কীরকম দাঁড়াবে কে জানে।
ইদানিং রাস্তায় অলিতে গলিতে জনপ্রতিনিধিদের এত এত কাজের হিসেব, খতিয়ান দেখতে দেখতে খুব মুষড়ে পড়ি। এমনকি গলির একান্ত কলতলাও বাদ যায় না। সেখানেও প্রস্তরফলকে তাদের কাজ ও নাম খোদাই থাকে। মুষড়ে পড়ি এই জন্য যে এই সব কর্মযজ্ঞ ও সেগুলির প্রচারের ভারে ও দাপটে কোনো প্রশ্ন তোলার জায়গা আর পাওয়া যাচ্ছে না। ফুটপাত যে এভাবে কেটে ছোটো করা হচ্ছে, এটা কি নিয়ম মেনে করা হচ্ছে? একটা রাস্তা ও সংলগ্ন ফুটপাতের অনুপাতটা কি ঠিকভাবে মানা হচ্ছে? ফুটপাত ছোটো করে রাস্তা চওড়া হলে লাভ কী? চালু লাভ একটা, সেটা হলো, মোটরগাড়ির জন্য আরো জায়গা বাড়লো। কিন্তু যে হারে মোটরগাড়ি কেনার হিড়িক ও সংখ্যা বাড়ছে, তাতে এই লাভ বছরখানেকের মধ্যেই নতুন গাড়ির পেটে চলে যাচ্ছে। আগে লেকটাউনের এই রাস্তার দু-দিক দিয়ে বাস ও গাড়ি চলাচল করত, গাড়ির ভিড় বাড়ার জন্য রাস্তাকে একমুখী করা হয়েছে। তাতেও এ রাস্তায় জ্যামজটের সুরাহা হয়নি। এখন ফুটপাত কাটো। এভাবে কত ফুটপাত হাপিস হলো তার ইয়ত্তা নেই।
রাস্তার মাঝ বরাবর বুলেভার্ডগুলোকে ধ্বংস করা হলো। আমাদের এখানেই উল্টোডাঙা হাডকোর মোড় থেকে ফুলবাগান পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ ফুট চওড়া বুলেভার্ডগুলো ছিল বড়ো বড়ো গাছের ছায়া, পাতা আর মায়ায় ভরা। রাস্তার দু-ধারে বারো চোদ্দ ফুট চওড়া ফুটপাতে মোটা গুঁড়িওয়ালা গাছের সারি ছিল। নিজের ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে যখনই প্রায়শই বিকেলবেলায় উল্টোডাঙা থেকে কাঁকুড়গাছি হাটিয়ে নিয়ে যেতাম, সে যেতে যেতে পথে গাছগুলোকে জড়িয়ে ধরত। এটা তার এক খেলা ছিল। বেশিদিন নয়, বছর পনেরো আগের কথা। এখন এপথে দু-জন পাশাপাশি কথা বলতে বলতে চলা যায় না। বুলেভার্ডগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। মৌলালির মোড় থেকে সিআইটি রোড ধরে পার্ক সার্কাস পর্যন্ত বুলেভার্ডের কথা মনে পড়ে। এখন গাছের বদলে দাঁড়িয়ে থাকে ধোঁয়া ধুলি ছড়ানো গাড়ির সারি।
আমাদের ছোটোবেলায় লেকটাউনে জয়া সিনেমা হলে বন্ধুরা মিলে সিনেমা দেখতে যেতাম, মজা করে বলতাম ‘জয়াদি ডাকছে’। তখন ওই রুটে বাস চলাচল হয়নি। চুয়াল্লিশ নম্বর বাসে চেপে ভিআইপি লেকটাউন নেমে হেঁটে যেতে হত। ফেরার সময় কাঁকুড়গাছি পর্যন্ত পুরো পথটা হেঁটেই ফিরতাম। হল থেকে বেড়িয়ে গল্প করতে করতে ফিরছি। নিজেদের মধ্যে কেউ মারলো চাঁটা, কেউ বা ধাক্কা। কেউ কারো পেছনে কষে এক লাথি। কেউ ছিটকে, কেউ দৌড়ালাম। কখনো বা কাঁধে কাঁধে হাত রেখে সিনেমার গান মুখে নিয়ে ফিরছি। এসব করার অবকাশ আমরা প্রশস্ত ফুটলাথে পেয়েছিলাম। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেঁচে থাকার সেই মুহুর্তগুলি নানাভাবে দখল হয়ে গেল। সৌন্দর্য্যকরণের নামে ফুটপাত ছোটো হয়, তবু এই উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো জায়গা নেই।
বছর চারেক আগে লালবাজারে ডীসি ট্রাফিকের ঘরে একটা বৈঠক ছিল। আমরা যারা কলকাতায় সাইকেল চালানোর নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে প্রতিবাদ আন্দোলনে সামিল হয়েছিলাম, তারা সকলে মিলে ওই মিটিং এ হাজির হয়েছিলাম। ডিসি আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন, যে কলকাতায় মাত্র ছয় শতাংশ রাস্তা। মোটরগাড়ির গতিবেগ ঠিক রাখার জন্য কলকাতার রাস্তায় সাইকেল চালানো যাবে না। বুঝুন ব্যাপারখানা। আমরা বললাম, সে কলকাতায় জ্যামজটের জন্য গাড়ির বিপুল সংখ্যাই দায়ী। লালবাজার যেন সেই সংখ্যাটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ডিসি শুনিয়েছিলেন, এটা ওনাদের বিবেচনাধীন। এই সেদিন এক মন্ত্রীড় কাছে গেছিলাম। মানুষজনের রাস্তা পারাপারের জন্য ফুটব্রীজ বা আন্ডারপাসের সিঁড়িগুলোতে সাইকেল সহজে ওঠানামার জন্য সরু প্যাসেজ বা ব্যবস্থা রাখা হোক। কথার মাঝে ওনার মুখেও শুনলাম, কলকাতার মাত্র ছয় শতাংশ রাস্তা। এই পরিসংখ্যানটা গত তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে শুনে আসছি।
Leave a Reply