জয়চন্দ্র ঘোষ, কল্যাণী, ১১ মার্চ#
সম্প্রতি ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড ৭৬টি হলস্টেইন ষাঁড় (যাদের বয়স ৬ মাস থেকে ১ বছর, গড়ে ওজন ৩০০ কেজি) বিদেশ থেকে আমদানি করেছে। দেশি গরুর মান (দুধের পরিমাণ) বাড়ানোর জন্য ভারত সরকার এই ষাঁড়গুলি আমদানি করেছে। ৪০টি চেন্নাইয়ের জন্য, বাকি ৩৬টি কলকাতার জন্য। আপাতত ষাঁড়গুলি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত শেডে রাখা হবে। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্ট থেকে বিমানে আনা হয়েছে। বিভিন্ন ষাঁড় খামারে পাঠানো হবে। পরবর্তীকালে বীজ সংগ্রহ করে প্রজনন করা হবে। সরকারি তরফে জানানো হয়েছে, এই ষাঁড়ের দুধ উৎপাদন-ক্ষমতা (মায়ের উৎপাদন) গড়ে ৩০ কেজি।
১৯৬০-এর দশকে সবুজ বিপ্লবের কাজ শুরুর কয়েক বছর পরেই শ্বেত বিপ্লবের কাজ শুরু হয়ে যায়। উদ্দেশ্য ছিল দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। বিদেশ থেকে অধিক দুধ উৎপাদক গো-বীজ বা বিশুদ্ধ জাতের হলস্টেইন, জার্সি, ব্রাউন সুইস রেড ডেইন জাতের ষাঁড় আমদানি শুরু করা হয়। বিদেশি ষাঁড়গুলির দৈনিক দুধ উৎপাদন-ক্ষমতা গড়ে ২৮-৩০ লিটার।
আমাদের দেশে ২৫-৩০ রকমের প্রজাতির গরুর মধ্যে সাইওয়াল, সিন্ধি, গীর, হরিয়ানা, থারপারকার, সিরি, রাঠি, মালভি, দেওনি, হালিকান ইত্যাদি ১০-১২টি প্রজাতির মান নির্দিষ্ট। সাইওয়াল গড়ে ৭-৮ কেজি (২১৫০ কেজি দুধ ৩০০ দিনে), সিন্ধি গড়ে (রেড সিন্ধি) ৫৪০০ কেজি দুধ ৩০০ দিনে, গীর ১৮০০ কেজি দুধ ৩০০ দিনে, হরিয়ানা ১৪০০ কেজি দুধ ৩০০ দিনে। অন্যান্য প্রজাতির গরু তৈরির জন্য সারা দেশে কেন্দ্রীয় গো-বীজ সংগ্রহশালা (ভারতবর্ষে প্রায় ৭৮টি অঞ্চলে, প্রত্যেক জেলায় ২টি করে) স্থাপন করা হয়। ষাঁড় খামার তৈরির জন্য সর্বভারতীয় স্তরে গবেষণা কেন্দ্র তৈরি হয়। হরিয়ানার হেসারঘাটা, কার্নাল, পশ্চিমবঙ্গের হরিণঘাটায় তৈরি হয় অল ইন্ডিয়া কো-অর্ডিনেটেড রিসার্চ প্রজেক্ট অন ক্যাটল (AICRP).
সামগ্রিকভাবে শ্বেত বিপ্লবের প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় দেশি প্রজাতির গরুর সঙ্গে বিদেশি প্রজাতির ষাঁড়ের শঙ্করায়ন। এর ফলে বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে ষাঁড় আমদানি করা হয়।
প্রথমদিকে ১০-১২ বছরে শঙ্করায়নের ফলে দুধ উৎপাদন বেশ ভালোমাত্রায় বেড়ে যায়। প্রথম/দ্বিতীয় (F1/F2)প্রজননে দেশি গরুর সঙ্গে বিদেশি ষাঁড় (যথা হলস্টেইন, জার্সি, ব্রাউন সুইস) মিশ্রণের ফলে প্রায় ৪-৫ গুণ দুধ উৎপাদন বেড়ে যায়। শঙ্করায়নের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো নীতি না থাকায় নানা ধরনের বিপর্যয় ঘটতে থাকে। একই দেশি জাতের গরুর রক্তে জার্সি, হলস্টেইন জাতের ষাঁড়ের রক্ত মিশে যাওয়ার ফলে ২/৩টি প্রজননের পরে নানারকম রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলি নানারকম ওষুধ বাজারে আমদানি করে। চাষিরা ওষুধ কিনতে বাধ্য হয়। বেশ কিছু ব্লক বা গ্রাম সাময়িকভাবে ১০-১২ বছরে দুধ উৎপাদনে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। সরকারিভাবে বিশেষ পশু-পালন সহায়ক প্রকল্প চালু হয়। সাময়িকভাবে শঙ্করায়নের ফলে কৃত্রিম গো-প্রজনন কেন্দ্রগুলির জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। প্রতিটি গ্রামেই এই কেন্দ্র খোলা হয়।
সর্বভারতীয় স্তরে এধরনের একটি প্রকল্প চালু করার আগে ভারতীয় কৃষি গবেষণা পরিষদের বিজ্ঞানীদের জেনে নেওয়া দরকার ছিল বিদেশি ষাঁড় ও দেশি গরুর শঙ্করায়ন কতটা ফলপ্রসু ও দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। এবিষয়ে কোনো গবেষণা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি।
নব্বইয়ের দশকে উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগ করে হিমায়িত গো-বীজ দ্বারা গো-প্রজনন চালু হয়। বাচ্চা জন্মানোর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। প্রজনন বৃত্তান্ত, উৎপাদনমাত্রা সহ কোনো তথ্যই ঠিক মতো না পাওয়ার ফলে শঙ্করায়নের গতি হ্রাস পায়। দীর্ঘদিন ধরে যদি এভাবে শঙ্করায়ন চলতে থাকে, তবে দেশীয় প্রজাতির গরুর চরিত্র হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
শুধুমাত্র গরুর ক্ষেত্রেই এই চিত্র নয়। প্রাণী সম্পদের অন্যান্য পর্যায়ে যথা মুরগি, ছাগল, হাঁস, শূকর প্রভৃতি এধরনের ভুল শঙ্করায়ন বা বিদেশি মডেলের ফলে সাময়িক লাভ হলেও পরবর্তী প্রজননে দেশি প্রজাতির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে রোগের মাত্রা ভালোভাবে বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে প্রাণী পালনে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ভালো জাতের প্রাণী তৈরি হচ্ছে না।
মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। হলস্টেইন ষাঁড় কেনা হয়েছে, কিন্তু ভারতীয় আবহাওয়ায় এই ধরনের হলস্টেইন ষাঁড় আদৌ উপযুক্ত নয়। কারণ এরা হল্যান্ড, ডেনমার্ক, জার্মানি প্রভৃতি ঠান্ডার দেশের। দেখা যায়, ২ বা ৩টি প্রজননের পর এধরনের ষাঁড় দিয়ে কোনো কাজ হয় না, পাশাপাশি দেশীয় প্রজাতিগুলির ক্ষতি হয়ে যায়।
শঙ্করায়নের বিপদ নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এর বিকল্প পথ কী?
Leave a Reply