অতীত জীবনের কত কথাই না আজ ভুলে গেছি তার ঠিক নেই। কত দুঃখ-আশা-আকাঙ্ক্ষা বিজড়িত মনে রাখার মতো ঘটনার কথা যা বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে চিরজীবনের মতো, যা আর কোনোদিনই স্মৃতির পর্দায় একটুও দাগ কাটবে না। কিন্তু এত কিছু হারিয়ে ফেলার মাঝেও, সান্ত্বনার প্রতীক হিসাবে টুকরো টুকরো অনেক ঘটনার আবছা ছবিগুলি মনের গভীরে থেকে থেকে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো জ্বলে ওঠে বই কি।
তেমনি এক ঘটনার কথা। বেশ মনে পড়ে বদরতলা বাজারের মোড়ে বাদল ঘোষের দোকানে, বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে, আট আনার মতো মজুরি গণ্ডা রোজগার করে উঠে পড়লাম। যাত্রা শুনতে যাব মুদিয়ালিতে, মুকুন্দদাসের স্বদেশী যাত্রা। একটানা বেশ কিছুদিন ধরে প্রতিদিন ১৭/১৮ ঘণ্টা মেহনতের পর ওই একটি দিনই, একটু সকাল সকাল কাজ অর্থাৎ বিড়ি বাঁধা বন্ধ করেছি, যাত্রা শুনতে যাব। তাই একটা পানও খেয়েছি, ট্যাঁকে অষ্টগণ্ডার মতো পয়সাও রয়েছে। কাজেই কেমন যেন বাঁধা ধরা জীবনযাত্রার ব্যতিক্রম। যেন, একটা মাদকতাপূর্ণ আমেজ, একটা ফুর্তি ফুর্তি ভাব। আমি যেন ওই মুহূর্তের জন্য একটা কেউকেটা, এই রকমের অবাস্তব অনুভূতি। পথ চলছি আর গুনগুন করে একটা গান ধরেছি —
ওমা, অন্ধকারে ভয় করে মা
আলো ধর মা কই মা উমা —
একবার আমায় কোলে নে মা
ঘুমাই মা তোর অভয় কোলে।
একে সন্ধ্যার ফুরফুরে বাতাস, তায় গানের সুর পূরবী — গানের ভাষার সঙ্গে মনের ভাবখানাও যেন কী জানি কীভাবে ঠিক ঠিক মিলে গেছে। মনে হচ্ছে যেন চতুর্দিকে কেবলই অন্ধকার আর অন্ধকার। জমাট-বাঁধা গহিন কালোর মধ্যে আশার আলো নেই একা চলতে, কেবলই ভয় — অস্থিরতা, ব্যাকুল আবেদন, হ্যাঁ চাই — চাই খানিকটা সাহস — একটু অবসর, বিশ্রাম, ঘুমের আ-কা-ঙ্ক্ষা। আপন মনে দুটি ছত্র গাইতে গাইতে কখন যে যাত্রাতলায় পৌঁছে গেছি হুঁশ নেই যেন। সহসা কানে বাজল অভয় মন্ত্রের মতো জলদগম্ভীর আশ্বাস বাণী —
কি ভয়, কি ভয় কিই ভঅঅঅয়!
অমল আনন্দে নাচো ধীর ছন্দে
বল্রে কালী মাইকী জয়।
যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। প্রস্তাবনা গীতি গাইছে পতাকাবাহী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। ‘মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরি মন’। যাত্রার আসরের মধ্যে চলেছে যেন এক দুঃসাহসী যুগান্তকারী অভিযান। হাজার হাজার শ্রোতা আশ্চর্য নিঃস্তব্ধতায় রুদ্ধশ্বাসে শুনছে সেই অপূর্বশ্রুত স্বদেশি যাত্রা। আসরের এক কোণে আমিও বসে গেলাম যাত্রা শুনতে। তন্ময় হয়ে শুনলাম মুকুন্দদাসের যাত্রা পথ পালা। যাত্রা শুনতে শুনতে যেন এক কল্পলোকে চলে গেল আমার মন। যেখানে নেই দুঃখ, নেই লাঞ্ছনা, নেই মানুষে মানুষে হানাহানির বিষাক্ত নিশ্বাস। যেখানে বয়ে চলেছে আনন্দ আর অফুরন্ত আনন্দের গতিশীলা মন্দাকিনী। আজও হৃদয়ের তন্ত্রীগুলিতে থেকে থেকে বেজে ওঠে স্বর্গীয় মুকুন্দদাসের সেই মরণবিজয়ী গান —
সাবধান সাবধান
নামিয়া আসিছে ন্যায়ের দণ্ড
বজ্রদীপ্ত মূর্তিমান
সাবধান সাবধান … ইত্যাদি।
সে বোধ হয় ১৯৩৩ সাল বা ওই রকমের কাছাকাছি কোনো এক সময়ের ঘটনার কথা। গন্গনে আগুনের উত্তাপে জংধরা লোহার মরচেগুলো যেমন ছেড়ে যায়, আমারও মনের অনেক ময়লা অনেক গ্লানি মুকুন্দদাসের গানের আগুনে ঠিক সেইভাবে যেন পুড়ে পরিষ্কার হয়ে গেল। দারুণ উৎসাহে অনেকগুলি গান মুখস্থ করে ফেললাম। গাইতে শুরু করলাম হাটে মাঠে বাজারে দোকানে, ইয়ার বন্ধুদের তাসের আড্ডায় আর বীণাপাণি ব্যায়াম সমিতির ক্লাব ঘরে। হায় মুকুন্দদাস! আজ যদি তুমি বেঁচে থাকতে তবে দেখতে পেতে তোমার গানের সুরগুলোর কী বিকৃতিই না ঘটিয়েছে আজকালকার সিনেমার পরদায়! কিন্তু থাক সে কথা —
জীবনের মোড় ঘুরতে শুরু করল। গান গাই আপন মনে, জনতা দাঁড়িয়ে শোনে। গানের ছন্দ, ভাষা, ভাবাবেগ, সুর আর তার সাথে নিজের শোষিত জীবনের রূঢ় অভিজ্ঞতার অনুভূতি সব যেন মিশে একাকার হয়ে যায়। গান জমে ওঠে। লোক জমে যায় মাঠে-ঘাটে-দোকানে সর্বত্র। আর একটা গাও, আর একটা গাও — চাহিদা আরও চাহিদা। আর পেছুনোর উপায় নেই। জনতার এই স্বতঃস্ফূর্ত দাবি আমাকে যেন ঠেলে নিয়ে চলল কোন অজানা এক রহস্যময় পথে। কিন্তু হায়, কোথায় পাব অত গান? মুকুন্দদাসের যে কয়খানা গান একটু আধটু গাইতে পারি তার সংখ্যা তো অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, অথচ ওই ধরনেরই গানের চাহিদা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। একদিকে জনগণের গান শোনার আগ্রহের ক্রমবর্ধমান চাপ, অপরদিকে আমার নিজের গান পরিবেশনের আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও শক্তির সীমাবদ্ধতা। এই দুই-এর সংঘাতের ফলে, আমার মানসপটে কবি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা যেন উঁকি ঝুঁকি মারতে শুরু করল। যেন নিজের অজ্ঞাতসারেই কী জানি কেমন ভাবে মুখ দিয়ে সহসা বেরিয়ে এল ছন্দ —
জনতা যে গান চায়
সে গান পাব কোথায়
কোথা পাব গুরু
হায় মুকুন্দদাস
করিতে ‘তোমা’ প্রকাশ
ব্রত করি শুরু
বাঃ — চমৎকার ছন্দ তৈরি হয়ে গেল তো! জেগে উঠল একটা উজ্জ্বল আশা, একটা আত্মবিশ্বাস। এমন মনে করে চেষ্টা করলে গান তো নিজেই রচনা করতে পারি। মোটামুটি দিক একটা পাওয়া গেল বটে, কিন্তু পথ? কই?
তখন জাতীয় ক্ষেত্রে চলেছে একটা চরম হতাশার যুগ। গান্ধিজি তথা জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিদেশি বর্জন — বিলাতি কাপড় পোড়ানোর ধ্বংস যজ্ঞ, লবণ আইন অমান্য, ‘হরিজন উদ্ধার’ ইত্যাদি আন্দোলনের পর অনেক রক্তক্ষয় আর অনেক — অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এসে জাতি যেন থমকে দাঁড়িয়েছে, পথ খুঁজছে। চাই মুক্তি — অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক মুক্তি আর সাংস্কৃতিক মুক্তি।
বোধ হয় ১৯৩৭ সাল, জনতার চাহিদার চাপে দু-একখানা গান নিজেই রচনা করার চেষ্টা করলাম। লিখলাম, কাটাকুটি করলাম আবার লিখলাম। আবার — আবার — নাঃ কিছুতেই যেন মনের মতো হয়ে উঠছে না। হঠাৎ একদিন আমার এক প্রতিবেশী কারখানার শ্রমিক নীলমণি মালা অর্থাৎ আমাদের নীলমণিদা, আমাকে টেনে নিয়ে গেল মালাপাড়ার নদীর ধারে জেলেডিঙিতে। গিয়ে দেখি, সন্ধ্যার ফুরফুরে হাওয়ায় আধা আলো আধা অন্ধকারে, ওপরে বসেছেন প্রায় জনকুড়ি লোক। মিটিং হচ্ছে। গ্রুপ মিটিং। বক্তা জনৈক বহিরাগত যুবক। সৌম্যমূর্তি, সতেজ কণ্ঠ, ওজস্বিনী ভাষা, সুস্পষ্ট বক্তব্য। তিনি তাঁর বক্তব্য শুরু করেছেন মধুর সুরে একখানি গান গাওয়ার মধ্যে দিয়ে।
ওরে টুটলো নেশা ধনীর আশা
ধনিক বণিক শোষণকারী
(এই) শোষণ রাজে করেছে
উঠেছে আজ সাম্যের বাণী
সুরের মূর্ছনা সৃষ্টি করেছে যেন এক নিঃশব্দ থমথমে পরিবেশ। সবাই শুনছে রুদ্ধশ্বাসে সেই গান, সেই সুর আর তার সাথে সাথে গ্রাম্য কথক ঠাকুরের ভঙ্গিমায় তার সহজ সরল প্রাণস্পর্শী ব্যাখ্যা, রাজনৈতিক ব্যাখ্যা, যা শোষিত শ্রেণীর মুক্তির অমর বাণী হয়ে বেরিয়ে আসছে বক্তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে।
ওরে আর কতকাল ধনিকের দল
এমন সুখে কাটাবি কাল
চলেছে ছন্দের পর ছন্দ, চলেছে বর্ণনার পর বর্ণনা আর তার ব্যাখ্যা। অত্যন্ত সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার নির্যাসটুকুকে যেন নিঙড়ে নিঙড়ে বের করেছে ওই ব্যাখ্যার যাঁতাকলে। যন্ত্রচালিতের মতো তন্ময় হয়ে আমিও বসে গেলাম একপাশে। তখনও চলছে গান, চলছে ব্যাখ্যা। আজন্ম সংস্কারের বজ্রবাঁধনগুলোর ওপর যেন পড়ছে বজ্রের মতন এক একটা ভাঙনের আঘাত —
(ওরে) ধর্ম সমাজ জাতি পরকাল
এ সকলই শোষণের কল
তুমি আমি মরি মিছে ভাই
মজা লোটে ওই ধনী
চমকে উঠি — অ্যাঁ — ধর্ম! — সমাজ — জাতি! — পরকাল! তবে কি সব মিথ্যে? — এ বলে কিরে বাবা! সব ধাপ্পা? সব জালিয়াতি? মানুষকে বঞ্চিত করার জন্য! তবে কি? তবে কি? — নিজের মাথাটা চেপে ধরি, সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে, এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আর ভাবতে পারছি না। তখনও চলছে গান আর চলেছে তার ব্যাখ্যা —
নূর-নবি নামাবলী
ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল এ সকলই
(তোদের) কর্মফলের দিয়ে ধোঁকা
গড়েছে ওই শোষকশ্রেণী
মিটিং শেষ হল, তখন রাত সাড়ে এগারোটার মতো। দীর্ঘ পাঁচটি ঘণ্টা কোথা দিয়ে যে কেটে গেল কিছুই বুঝতে পারলাম না। সকলে উঠে পড়েছে, যে যার ঘরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, আমিও উঠেছি যাওয়ার জন্য, পা বাড়িয়েছি, আগ্রহের আতিশয্যে হঠাৎ চেপে ধরলাম যুবকের হাত। আমাকে, আমাকে শেখাতে হবে গান, শেখাতে হবে রাজনীতি, শেখাতে হবে আন্দোলন করার আদব-কায়দা। যুবক বিমূঢ়, আমিও তন্ময়। সস্নেহে আমার কাঁধের ওপর হাতটি রেখে বললেন, ভাই কমরেড। তোমাদের মতন কর্মীই তো আজ দরকার। দেশের আজ বড়োই দুর্দিন কমরেড। সামনে আসছে কঠোর সংগ্রামের যুগ। শ্রেণী সংগ্রাম, আপোসহীন শ্রেণী সংগ্রাম। চোখে মুখে সেদিন তাঁর যে সংগ্রামী সংকল্পের বহ্নিশিখা দেখেছিলাম তা জীবনে ভোলবার নয়। পরিচয় নিয়ে জানলাম নব আগন্তুকের নাম নিত্যানন্দ চৌধুরী। পরবর্তীকালে যিনি একাধারে শ্রমিক নেতা ও কম্যুনিস্ট নেতা হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। সেদিনকার মতো যে যার ঘরে ফিরে এলাম।
পরদিন প্রত্যুষে, আমার সমবয়সী বন্ধুরা ডাকাডাকি করছে সরস্বতী পুজোর চাঁদা আদায় করতে যেতে হবে। পুজোর মাত্র আর কয়েকটা দিন বাকি। আমাদের ক্লাবে ঠাকুর আনতে হবে। তিন পাড়ার তিন ঠাকুরের মধ্যে প্রতিযোগিতা, কে কত বড়ো আর উঁচু ঠাকুর আনতে পারে তারই কমপিটিশান। কাজেই চাঁদা সবচেয়ে বেশি তুলতে হবে বৈকি। তার ওপর টুকিটাকি পঞ্চশস্য, মঙ্গলঘট, মেটে প্রদীপ থেকে শুরু করে মায় ঢাক ঢোলের জোগাড় ইত্যাদি নানান কাজ। বন্ধুরা আমায় ছেঁকে ধরল, তাদের সঙ্গে বেরুতে হবে, এক্ষুনি বেরুতে হবে। আমার কানে তখনও গানের সেই সুর যেন বাজছে,
ধর্ম সমাজ জাতি পরকাল
এ সকলই শোষণের কল।
পুজোর বাকি কয়টা দিন বন্ধুবান্ধবের সাথে মিলে খুউব খাটা-খাটনি করতে লেগে গেলাম। ধুমধাম করে আমাদের ক্লাবের অর্থাৎ বীণাপাণি ব্যায়াম সমিতির পুজোটা করতেই হবে। সারাদিন পুজোর কাজে ঘুরি আর রাত্রে লিখি গান। নতুন নতুন গান চাই। গাইতে হবে — পুজো প্যান্ডেলে। চেষ্টা সফল হল। রচনা করে ফেললাম পুরো দুখানা গান, গাইলাম পূজা মণ্ডপে। সঙ্গে সঙ্গে মুকুন্দদাসের গানগুলিও।
ওরে পূজা যদি করবি তোরা
মায়ের পূজা আগে কর
ধরবি যদি বিশ্বপিতার
মায়ের চরণ আগে ধর
(ও যার) চরণ তলে স্বর্গ মিলে
ভয় কি সে মা অভয় দিলে
আয়রে চলে মায়ের ছেলে
মায়ের চরণতলে পড়।
পৃথিবীটাকেই যেন মাতৃরূপে কল্পনা করে ফেলেছি, আর বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণীকেই মুক্তিযুদ্ধের নেতা হিসাবে মনে মনে বরণ করে নিয়েছি।
পুত্র যাহার বিশ্ব জুড়ে
বন্দী সে মা দস্যুকরে
(ওরে) রক্ত নিশান উচ্চে ধরে
মুক্ত তারে সবাই কর।
হে অমৃতের সন্তান, সর্বশক্তির আধার সর্বহারা ওঠো, জাগো! এগিয়ে চলো। তোমরা যদি মনে করো এই অপমান, এই লাঞ্ছনা, এই পরাধীনতা কিছুতেই মেনে নেব না, তা হলে,
মুক্তি যদিই হয় প্রয়োজন
(ওরে) শক্তি পূজার কর আয়োজন
(তোদের) প্রাণের শক্তিই আদ্যাশক্তি
তারেই সবাই সজাগ কর।
চমৎকার! গান দারুণ জমে গেছে। নিজের সাফল্যে নিজেই যেন গর্বিত। আগেও লোকে আমার গান শুনেছে, বহু শুনেছে, কিন্তু আজকের গানে যেন একটা নতুনত্ব কিছু তারা খুঁজে পেয়েছে। গান শেষ হয়ে গেছে কিন্তু তবুও হারমোনিয়ামের সুর বেজেই চলেছে।
সেই সুর সেই তাল মাত্রা বজায় রেখে আবার ধরলাম। এবার ভাষা যেন কীভাবে জুগিয়ে গেল। ধরলাম —
মহাশক্তি জাগুক প্রাণে —
জ্বলুক অনল ত্রিভুবনে —
জাগুক রে আজ মজুরের দল
কাঁপুক বিশ্ব চরাচর।
বাঃ — আমি কী হয়ে গেলাম রে বাবা অ্যাঁ? নিজের গৌরবে নিজেই যেন ফেটে পড়ছি। তাহলে তো তাহলে তো চেষ্টা করলে একদিন আমিও কবি বা কবিয়াল হতে পারব? —
ইতিমধ্যে কমরেড নিত্যানন্দ চৌধুরী মেটেবুরুজ এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন আসানসোলে, কয়লাখনি-মজুরদের আন্দোলন পরিচালনার জন্য। তখন আসানসোলে চলেছে খনি শ্রমিকদের তীব্র আন্দোলন, চলেছে ধর্মঘট। খনি মালিকদের তরফ থেকে চলেছে ধর্মঘট ভাঙার নানান কুটিল চক্রান্ত। শ্রমিকদের লৌহদৃঢ় প্রতিরোধের সামনে মালিকদের চক্রান্ত পর্যুদস্ত। ক্ষিপ্ত মালিকের চক্রান্তে কমরেড চৌধুরীকে হত্যা করার জন্য মালিকের নির্দেশে তাঁর ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেবার চেষ্টা হয়। বিপদের ঝুঁকি নিয়ে তরুণ কর্মী কমরেড সুকুমার ব্যানার্জী চলন্ত গাড়ির সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং প্রাণদান করেন। রানীগঞ্জের মাটি সুকুমারের রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। এইভাবে সে যাত্রা কমরেড নিত্যানন্দ চৌধুরীর জীবন রক্ষা হয়, একটা উদীয়মান তরুণ কর্মীর জীবনের বিনিময়ে। এই গৌরবোজ্জ্বল দুঃসংবাদ যখন পেলাম একটা বর্ণনাতীত অস্থিরতা, একটা প্রতিহিংসালিপ্সা যেন আমাকে চঞ্চল করে তুলল। কিছু একটা করতেই হবে, এই ধরনের জেদ যেন আমাকে পেয়ে বসল, কিন্তু কোন্ পথে? কমরেড চৌধুরী আসানসোলে চলে যাওয়ার পর থেকেই মানসপটে একটা শূন্যতা অনুভব করছিলাম। অনুভব করছিলাম রাজনৈতিক জ্ঞানের দৈন্য। রাজনৈতিক জ্ঞান ছাড়া, শ্রেণীসচেতন একটা সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া কিছুতেই যে সত্যিকার বিপ্লবী গান রচনা করা সম্ভব নয় এই সত্যও অনুভব করছিলাম মর্মে মর্মে। ওই সময়েও আজকের মতো কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সংগঠন হয়তো গড়ে ওঠেনি কিংবা উঠলেও খুব প্রাথমিক পর্যায়ে। তাই দেখি এখানে ওখানে বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু কিছু বিপ্লবী গ্রুপের এলোমেলোভাবে স্রেফ প্রচার অভিযানের কাজ চলছিল। গ্রুপগুলির মধ্যে আবার কম্যুনিজমের সংজ্ঞা সম্পর্কে পরস্পরের মধ্যে প্রচণ্ড মতপার্থক্য দেখা দিত, যা প্রকাশ পেয়েছিল তখনকার দিনের ওই গ্রুপগুলি কর্তৃক পৃথক পৃথক ভাবে প্রচারিত মার্ক্সপন্থী, মার্ক্সবাদী, গণনায়ক, প্রজার কথা, ছাত্রদল প্রভৃতি সাপ্তাহিক, পাক্ষিক বা মাসিক পত্রিকাগুলির মধ্যে। যাই হোক, ওই সমস্ত পত্রিকাগুলি আমি নিয়মিত পড়তে শুরু করলাম। বলা বাহুল্য, তাতে প্রচুর রাজনৈতিক জ্ঞানের খোরাক পেয়েছিলাম, যা পরবর্তী কালে চলার পথে আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছে।
তখনও বিড়ি বাঁধি। অন্যান্য আর পাঁচজন বিড়িমজুরের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কও বজায় রয়েছে, কিন্তু তবুও ওই অবস্থার মধ্যেও নিজে নিজেই কেমন যেন বদলে যাচ্ছি দ্রুতগতিতে। চিরাচরিত একঘেয়ে জীবন, শুধু বিড়ি বাঁধা আর বিড়ি বাঁধা, আর প্রাণান্তকর পরিশ্রমের ফাঁকে ফাঁকে, টুকরো টুকরো অবসরে, হত গল্প গুজব, যৌবনের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির অপমৃত্যু ঘটানোর কৃত্রিম প্রয়াসে নানা অশালীন আলোচনা ও আচরণে সান্ত্বনা লাভ ইত্যাদি বদ অভ্যাসগুলি যেন ধীরে ধীরে কেটে যেতে লাগল। গড়ে উঠতে লাগল এক নতুন জীবন, নতুন আলো, নতুন ধ্যান-ধারণা।
১৯৩৯ সাল। দিকে দিকে গড়ে উঠেছে কম্যুনিস্ট পার্টি। পার্টির সংগঠক-হিসাবে আমাদের সেই প্রিয় নেতা কমরেড নিত্যানন্দ চৌধুরী আবার ফিরে এসেছেন মেটেবুরুজে আমাদের মধ্যে। তাঁর নেতৃত্বে নতুন উদ্যমে শুরু হল পার্টি গড়ার কাজ। তখন কম্যুনিস্ট পার্টি বেআইনি। তিনি আত্মগোপন করে কাজ শুরু করেছেন। আমার সঙ্গে যোগাযোগ হল, তখন আমি বেশ কয়েকখানা গান রচনা করে ফেলেছি, হাটে বাজারে গাইতেও শুরু করেছি। আমার গান শুনে কমরেড চৌধুরী আমার পিঠ চাপড়ে খুব উৎসাহ দিলেন। এবং তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও সুপারিশে আমি ১৯৩৯ সালের শেষের দিকে কাজের মাধ্যমে স্থান পেলাম কম্যুনিস্ট পার্টির মধ্যে।
১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলেছে পুরোদমে। আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিকায় চক্রশক্তির বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির চলেছে মরণপণ লড়াই, চলেছে আরও তীব্র লড়াইয়ের প্রস্তুতি। ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি ঘোষণা করেছে ‘এ যুদ্ধ জনযুদ্ধ’। তীব্র গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছে পার্টিকে আইনি করার জন্য। শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের চাপে পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়েছে। কলকাতায় ও আশেপাশে জাপানিরা বোমা ফেলতে শুরু করেছে। দেশরক্ষার ডাক এসেছে পার্টির তরফ থেকে। আমি তখন পুরোদস্তুর পার্টির কর্মী, আর সাংস্কৃতিক কর্মীও বটে। তাই লিখে ফেললাম একখানি পুরো নাটক মুক্তির ডাক । যাত্রার নাটক। রিহার্স্যাল হল, কমরেড চৌধুরী খুব উৎসাহ দিতে লাগলেন। শেষে একদিন অভিনয় হল, বদরতলা রথতলার মাঠে। হাজারখানেক শ্রোতার উৎসাহব্যঞ্জক অভিনন্দনের মধ্য দিয়ে সাফল্যমণ্ডিত হল মুক্তির ডাক যাত্রাভিনয়। কমরেড নিত্যানন্দ চৌধুরী হাসিমুখে বললেন, বাঃ তুমি যাত্রা করতেও তো ওস্তাদ দেখছি। আচ্ছা, তরজা-টরজা গাইতে পারো? — ভাবলাম এবার তরজা গাইতে হবে।
মাত্র কয়েকদিন পরের ঘটনা। স্থান নৈহাটি।১ বিশাল জনসমাবেশ। দুধারে কয়েকটা সুসজ্জিত তোরণ। দেওয়ালে দেওয়ালে বিশাল জনসমাবেশের সুদৃশ্য পোস্টার। কম্যুনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি কমরেড পি সি যোশি আসবেন। সভাশেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অংশগ্রহণে আইপিটিএ — শ্রেষ্ঠাংশে — বিনয় রায় ও সম্প্রদায়। তখন সবেমাত্র গড়ে উঠেছে, কম্যুনিস্ট পার্টির কালচারাল ইউনিট আইপিটিএ-র একটি ছোট্ট গ্রুপ। সারা বাংলায় চলেছে তখন যুদ্ধজনিত সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষ। আমিও গেছি পার্টির নির্দেশে ওই মঞ্চে তরজা গান শোনানোর জন্য। বলা বাহুল্য কমরেড নিত্যানন্দ চৌধুরীর হস্তক্ষেপ ছাড়া, ওই রকম মঞ্চে গান করার সুযোগ পাওয়া আমার পক্ষে ছিল আকাশকুসুম কল্পনা। সভাশেষে শুরু হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আইপিটিএ-র গান হল পরপর কয়েকখানা। এরপরই আমার পালা, আমি উশখুশ করছি, ভয়ও হচ্ছে। বুকের ভেতর গুরগুর করছে, কুলকুল করে বেরুচ্ছে ঘাম, ভিজে যাচ্ছে গেঞ্জি, ভিজে যাচ্ছে জামা। কমরেড নিত্যানন্দ চৌধুরী মাইক-এর সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, হ্যালো, আপনাদের সামনে মেটেবুরুজের একজন বিড়ি শ্রমিক — ব্যাস, আমি কেঁদে ফেলার মতো অবস্থায় জড়সড়। ইত্যবসরে আমার নাম ঘোষণা করা শেষ হয়ে গেছে। মনে মনে কয়েকবার ভগবানকে ডেকে নিলাম। মুহূর্তের জন্যে আমার কম্যুনিস্টত্ব হারিয়ে ফেললাম। বুকে থুতু দেওয়া, আঙুল কামড়ানো প্রভৃতি পল্লিগ্রামের প্রচলিত তুকতাকগুলো সেরে নিয়ে সটান উঠে গেলাম মঞ্চে। আমার রোগনা রোগনা চেহারা আর গেঁইয়া গেঁইয়া দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে লোক হোহো করে হেসে উঠল। আমি একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে মুখখানা কাচুকুঁচু করে উইংস-এর পাশ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছি। গতিক দেখে কমরেড চৌধুরী আবার মাইক ধরলেন। জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘আপনারা হাসবেন না। শ্রমিক শিল্পী, আপনাদের গৌরব, কম্যুনিস্ট পার্টির গৌরব’ — সমগ্র সভা নিস্তব্ধ। ‘গাও, আমি রয়েছি ভয় কী?’ বললেন কমরেড চৌধুরী। আমি গান ধরলাম।
আজকে হেথা দুচার কথা
দেই এবার বলে।
দুঃখেতে হায় বুক ফেটে যায়
প্রাণের কথা বলতে গেলে।
নৈহাটিতে আসার পথে
দেখে এলাম কলকাতাতে,
পেটের জ্বালায় ফুটপাতেতে
(মরছে) কত মা আর কত ছেলে।
জোর হইহই করে উঠল। তুমুল আনন্দোচ্ছ্বাস। চতুর্দিকে কেবল হাততালি, জোর হাততালি। কমরেড নিত্যানন্দ চৌধুরীর আনন্দ দেখে কে? তিনি মঞ্চের ওপর নেচে নেচে উঠছেন। সমগ্র সভার আবহাওয়াটাই তখন বদলে গেছে। আমি অদম্য উৎসাহে আবার ধরলাম।
আমি বুভুক্ষা রাক্ষসী
সোনার বঙ্গভূমে পশি
ছড়িয়ে মসী সর্বনাশী
(আমার) দেশ শ্মশান করে দিলে
… ইত্যাদি
সভাশেষে, ঘরে ফিরে এলাম দিগ্বিজয়ীর মনোভাব নিয়ে। দু-একদিনের মধ্যেই শুনলাম, কমরেড পি সি যোশি আমাকে আইপিটিএ ইউনিটের সভ্য করে নেওয়ার জন্য সুপারিশ করে গেছেন।
কলকাতা শহর ঘুরছি আর চতুর্দিকে চংমং করে দেখছি। হাতের মুঠোর মধ্যে সযত্নে চেপে ধরে আছি কমরেড বিনয় রায়ের নামে লেখা কমরেড নিত্যানন্দ চৌধুরীর সুপারিশপত্র। পি সি যোশির নির্দেশে আমাকে, আইপিটিএ ইউনিটের সভ্য করে নেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। মনে আনন্দ আর ধরে না। অনেক, অনেক ঘোরাঘুরির পর বহু লোককে বহু জিজ্ঞাসাবাদের পর আইপিটিএ-র রিহার্স্যাল ঘরের সন্ধান পেলাম। ঘরখানি বেশ ছিমছাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। দোতলার ওপর একখানি হলঘর, আর তারই সংলগ্ন রিহার্স্যাল ঘর। হলঘরে ঢুকে দেখি রিহার্স্যাল ঘরের দরজা তখন ভিতর দিক থেকে বন্ধ। বুঝলাম রিহার্স্যাল চলছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি ১৫/১৬ বছরের ছেলে। ছেলেটিকে খুব মিষ্টি করে বললাম, খোকা আমি বিনয় রায়ের সঙ্গে দেখা করব। ছেলেটি হাত উঁচু করে ইঙ্গিতে আমাকে চুপ করতে বলল। ভিতরে রিহার্স্যাল হচ্ছে। আমি সভয়ে কাঁপা হাতে, কমরেড নিত্যানন্দ চৌধুরীর চিঠিটা দিয়ে ইশারায় বললাম, দয়া করে ভিতরে বিনয় রায়কে দিতে। ছেলেটি তো গ্রাহ্যই করল না — তারপর কি জানি কি যেন ভেবে আস্তে আস্তে দরজা খুলে ভিতরে চিঠিখানা দিয়ে এসে বললে, বসুন। ভিতর থেকে আবার ঘড়াং করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। যাই হোক, ওই রকমের জায়গায় বসার তো অনুমতি পেয়েছি, তাই বা কম কী? তাড়িয়ে তো দেয়নি? এদিক ওদিক তাকিয়ে, আয়নার মতো তকতকে পালিশ করা চেয়ারে আর বসতে ভরসা হল না, বেঞ্চি-টেঞ্চি নেই, ধপাস করে বসে পড়লাম ঘরের কোণে সিমেণ্ট করা মেঝের ওপর। ছেলেটি মুখ ঘুরিয়ে নিল; বোধহয় আমার পাড়াগেঁয়ে কাণ্ড দেখে মুখ টিপে হাসছিল। হাসুক, ও হাসি আর কদিনের? দুদিন পরে আমিও একদিন ওই বন্ধ দরজার ভেতর রিহার্স্যাল দেব, আর আমারই মতো কত হতভাগ্য হয়তো আমারই সঙ্গে দেখা করার জন্য হাপিত্যেস করে বসে থাকবে — ঠিক এমনি করে এই আমারই মতো। ওঃ ভাবতেও কেমন মজা লাগে। নিজেই নিজের আঙুলগুলো মটকাচ্ছি আর ভাবছি এক কল্পরাজ্যের কত আজগুবি কাহিনির কথা। বসে আছি তো বসেই আছি এক, দুই, আড়াই ঘণ্টা। ঘরের দরজা বন্ধ রয়েছে তো বন্ধই রয়েছে। খোলবার কোনো লক্ষণ নেই। শেষে প্রায় ঘণ্টা তিনেক পরে হঠাৎ সশব্দে দরজা খুলে গেল, আমি আঁই করে চমকে উঠলাম। প্রায় ১৩/১৪ জন শিল্পী একসঙ্গে জটলা করতে করতে বেরিয়ে এলেন বাইরে। আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। উদ্দেশ্য, আমার উপস্থিতির প্রতি তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কিন্তু হায় আশা মরীচিকা। অনেকের চোখ পড়ল বটে আমার দিকে, কিন্তু সে নিছক তাকানোর জন্যই তাকানো, তার বেশি কিছু নয়। সবাই গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়লেন রাস্তায়। ক্ষোভে, দুঃখে, অভিমানে কেবলই কল্পনায় ভাবতে লাগলাম, পাতাল প্রবেশের পূর্ব মুহূর্তের সীতাদেবীর মনের অবস্থার কথা। একটা অস্বাভাবিক মানসিক অবস্থায়, দ্রুতগতিতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে, সটান চলে গেলাম কমরেড বিনয় রায়ের সামনে। হ্যাঁ, দেখুন, স্যার, বাবু, আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে — ওহো, আপনার নাম? — আজ্ঞে হ্যাঁ, আমারই নাম। নেহাত একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, আচ্ছা আচ্ছা, হবে হবে, পরে খবর দিয়ে দেব, বলেই আবার সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সটান চলে গেলেন। খবর তিনি যা দেবেন তা তাঁর কথার ভঙ্গিতে, বুঝতে আমার আর বাকি রইল না। তখনকার দিনের আইপিটিএ সম্পর্কে একটা অতি উচ্চ ধারণা, এক মুহূর্তে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। উঃ মানুষকে এরা এত ঘৃণা করে? এত নীচ মনে করে? নাঃ — এই সোনার হরিণের পিছনে ছুটে আর লাভ নেই। এঁদের চেয়ে, সেই কেরোসিনের কুপি জ্বেলে, ছেঁড়া চ্যাটাইতে বসে যে বিড়ি শ্রমিক আড্ডা মারে, তাদের অন্তঃকরণ অনেক বেশি উদার, অনেক বেশি মহান ইত্যাদি কত কথাই না ভাবতে ভাবতে আমার অতি প্রিয় কুঁড়েঘরে ফিরে এলাম।
আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা শোনার পর কমরেড নিত্যানন্দ চৌধুরী বললেন, যাক্ — আমি তোমাকে ২৪ পরগনা জেলায় গান করাব। তিনি আমাকে সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি দিলেন এবং সম্ভাব্য সমস্ত রকম সুযোগ করে দিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, পার্টির নেতা আবার এক অর্থে সাংস্কৃতিক নেতাও বটে। ওই রকমের সর্বতোমুখী প্রতিভাধর আর নেতার কথা আমি জানি না। আলোচ্য সময়ে তিনি ছিলেন কম্যুনিস্ট পার্টির ২৪ পরগনা জেলা কমিটির সেক্রেটারি।
২৪ পরগনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পার্টির মাধ্যমে ডাক আসতে লাগল। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সভায় বা অনুষ্ঠানে গান গাইতে যেতাম। অধিকাংশ গানই নিজে রচনা করে গাইতাম। গান করার সময় মনের সমগ্র আবেগকে কেন্দ্রীভূত করে বক্তব্যের মধ্যে মিশিয়ে দিতাম। যেন বুকখানাকে হালকা করার জন্য নিজের জীবনের দুঃখের কাহিনীকে প্রাণ খুলে প্রকাশ করার চেষ্টা করতাম সাধারণ মানুষের কাছে। এইভাবে আমার গান জনপ্রিয় হয়ে উঠল অল্পদিনের মধ্যেই।
১৯৪৬ সাল। মহম্মদ আলি পার্কে পার্টির নেতৃত্বে হচ্ছে বিরাট সাংস্কৃতিক উৎসব।২ গান, নাচ, নাটক, পল্লিগীতির সে এক বিরাট সমারোহ। কবি রমেশ শীল ও কবি শেখ গোমহানির কবির লড়াই বিশেষ আকর্ষণ। আমার কৌতূহলী মন আমাকে টেনে নিয়ে গেল সেখানে। কবির লড়াই এর আগে জীবনে কখনও শুনিনি। সমস্ত রাত্রি ধরে বসে বসে নিবিষ্ট মনে সেই অপূর্ব কবির লড়াই শুনলাম। আমার সামনে যেন এক নতুন দিগন্ত উদঘাটিত হয়ে গেল। বিশেষ করে কবি রমেশ শীলের গানের ছন্দ ও সুরগুলি আমার মনে সেদিন যে রেখাপাত করেছিল, পরবর্তীকালে সেইগুলিই আমার জীবনের গতিপথে এক নতুন ধারার সংযোজন ঘটিয়েছিল। কবিগান শুনলাম, সুরও কিছু কিছু আয়ত্ত করলাম। কিন্তু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বুঝলাম, ওই মাত্র একদিনের শোনা গানের নিছক অনুকরণ করে, কবিগান করা সম্ভব নয়। তাই ওই সুরগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করার সাথে সাথে, কিছু কিছু মুকুন্দদাসের সুর, গ্রামবাংলার প্রচলিত বিষহরা বা মনসামঙ্গল, শীতলার গান প্রভৃতির সুর একটা সূত্রে গাঁথবার চেষ্টা করলাম। আইপিটিএ-র কিছু কিছু উচ্চ ধরনের সুর ও মার্জিত ভাষাও ব্যবহার করার চেষ্টা করলাম, যথা, —
একি! অবশেষে কাণ্ডারী বেশে জনতা ধরেছে হাল!
দেখে তরঙ্গ দেয় না ভঙ্গ, আবার টাঙায় পাল
নেই হা হুতাশ ভোরের বাতাস মৃদু মৃদু মৃদু বয়
নব কলরবে নতুন মানবে নতুনের কথা কয়
ওই তো! বোধ হয় নবারুণোদয় পূর্ব আকাশ লাল
ওই আলোতে কি ধরা দেবে তুমি আগামী দিনের কাল? —
… ইত্যাদি।
এইভাবে পাঁচ ফুলে সাজি করার মতো, বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের জনপ্রিয় সুরসমূহের সমন্বয় ঘটানোর অবিরাম চেষ্টার মধ্য দিয়ে — এক বিশেষ ধরনের গানের পদ্ধতি বেরিয়ে এল। বহু প্রচেষ্টা এবং অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে ওই নতুন ধরনের গানগুলি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগল। অদম্য উৎসাহে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করতে লাগলাম। সাথে সাথে আবার একখানি যাত্রার নাটক লিখে ফেললাম। তখন পার্টি নেতৃত্ব তথা সমগ্র পার্টি সংকীর্ণতাবাদী পথে নেমে পড়েছে। রাজনীতির সূক্ষ্ম তত্ত্ব ও তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে হৃদয়ঙ্গম করার মতো শক্তি আমাদের মতো সাধারণ কর্মীদের খুব কমই ছিল। মোদ্দা কথা যেটুকুন বুঝেছিলাম, তা হচ্ছে এই যে এখনই আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে হবে। তারই প্রথম ধাপ হিসাবে এক-একটা মুক্ত অঞ্চল তৈরি করতে হবে। এবং সেটা হবে নিছক গায়ের জোরে, ডাণ্ডার জোরে, লাঠিবাজির মধ্য দিয়ে। এই চিন্তার ছাপ স্বাভাবিক ভাবেই আমার নাটকের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, যখন একজন ছাঁটাই মজুর আর কোনো দিকে কোনো বাঁচার পথ দেখতে পাচ্ছে না তখন, তার সমগ্র সহকর্মীকে ডাক দিয়ে বলছে —
ওরে, তোরা কে কোথায় আছিস আয়, ছুটে আয়
বাঁচিবি যদি লাঠি ধর গড়ে তোল নতুন কারবালা।
বিবেকের গান,
ওরে, বল, বল্ বল্ আরও জোরে বল্
শুনুক বিশ্ব চরাচর
(তোরা) বাঁচার মতো বাঁচবি যদি
শক্ত হাতে লাঠি ধর।
ওই পথেতেই বাঁচবি রে তুই
(তোর) লাগবে জোড়া ভাঙাঘর
ওই পথেতেই বাঁচবে রে তোর
ভবিষ্যতের বংশধর।।
… ইত্যাদি।
যেদিন নাটক অভিনয় হল, তার পরের দিনই, কংগ্রেসি সরকারের ‘বদান্যতায়’ আমি ‘আমন্ত্রিত’ হলাম জেলখানায়।
১৯৪৮ সালের নভেম্বর। জেল থেকে বেরিয়ে দেখি সারা রাজ্যে চলেছে এক সন্ত্রাসের রাজত্ব। কথায় কথায় চলেছে পুলিশের লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস ও গ্রেপ্তার। কাকদ্বীপের মাটি মা অহল্যার রক্তে রাঙা হয়ে গেল, লতিকা, প্রতিভা, অমিয়া, গীতা বন্দীমুক্তির দাবিতে মহিলা শোভাযাত্রা পরিচালনার সময় বউবাজারের মোড়ে প্রাণদান করলেন। বিদ্যায়তনের চিরন্তন পবিত্রতা পদদলিত করে পুলিশ ইউনিভার্সিটি লনে ঢুকে গুলি চালাল, ছাত্রহত্যা করল। এমনকী জেলখানার ভিতরেও রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর চালানো হল গুলি। আমাদের বহু নেতা ও কর্মী নিক্ষিপ্ত হতে লাগলেন কারাগারে। যাঁরা বাইরে রইলেন, অনেকেই পার্টির নির্দেশে আত্মগোপন করে কাজ করতে লাগলাম। আমিও তখন ছদ্মবেশে ‘সনাতন মণ্ডল’ এই ছদ্মনামে, পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে, এখানে ওখানে গান করে বেড়াতে লাগলাম। সেই সময়ের লেখা কলকাতার খবর গানখানি লোকের মুখে মুখে যেন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল গ্রামে গ্রামান্তরে।৩ ওই গানখানার বক্তব্য ও বিষয়বস্তু নিয়ে এমনকী পার্টি নেতৃত্বের একাংশের মধ্যেও যথেষ্ট চাঞ্চল্য, আলোচনা এমনকী মতবিরোধ পর্যন্তও হয়েছিল।
যাই হোক, কালের গতিতে, ঘটনার ঘাত সংঘাতে, অনেক ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে, আই.পি.টি.এ. তখন এক নতুন মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। সংগ্রামী জনতার মধ্য দিয়ে তার নতুন করে পথ চলা শুরু হয়েছে। হরিপদ কুশারির নেতৃত্বে গঠিত আইপিটিএ-র প্রাদেশিক সংগঠন পিসি ইউনিটে আমি স্থান পেলাম পার্টির নির্দেশে। দীর্ঘদিনের সাধনা এইভাবে সার্থকতা লাভ করল।
অদম্য উন্মাদনা নিয়ে নতুন নতুন গান রচনা করে গাইতে লাগলাম। পথে পথে গ্রামে গ্রামে পুলিশি তাণ্ডবের মুখোমুখী দাঁড়িয়ে, যেন বুকের ভেতরটা প্রতিহিংসার বিধ্বংসী আগুনে জ্বলতে লাগল। ভাষায়, সুরে ও ছন্দে তার রূপ দেবার চেষ্টা করতে লাগলাম যেন কীসের এক প্রেরণায়।
রক্ত মাখা ঝাণ্ডা তুলে নাও রে
অত্যাচারীর বাসায় বাসায়
আগুন জ্বেলে দাও রে দাও রে —
ইত্যাদি গানগুলি তখন জনতার মনে বেশ সাড়া জাগাতে লাগল। কিন্তু হায় আশা কুহকিনী, তখনও পর্যন্ত কেউই বুঝতে পারিনি, আমাদের রাজনৈতিক চেতনার দৈন্যের কোনো এক ছিদ্রপথ দিয়ে সংকীর্ণতাবাদী চিন্তাধারার নিঃশব্দ অনুপ্রবেশ ধীরে ধীরে সমগ্র সংগঠনটাকেই আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে রাজনীতি ক্ষেত্রে হতে লাগল একটার পর একটা পরাজয়, আর সম্ভবত তারই প্রতিক্রিয়া হিসাবে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে দেখা দিল নানান বিভ্রান্তি, মানসিক বিকৃতি ইত্যাদি। এই আত্মঘাতী ঝোঁক-এর একটা বিশেষ স্তরে দেখা গেল সহকর্মীদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি দোষারোপের প্রবণতা, সমালোচনার নামে পরস্পরের প্রতি কুৎসা প্রচার, আমলাতান্ত্রিক আত্মম্ভরিতা, নির্দেশ, সহকর্মীর ওপর পদাধিকার বলে অন্যায় নিপীড়ন ইত্যাদি ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত সংগঠন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যেতে লাগল, শেষপর্যন্ত সব যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে লাগল। আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসাবে যাঁদের খ্যাতি ছিল তাঁরা অনেকেই সিনেমা আর্টের দিকে ঝুঁকলেন। কেউ বা মতবিরোধের অজুহাতে সরে গিয়ে পৃথক সংগঠন গড়লেন। এ প্রসঙ্গে সলিল চৌধুরী, বিজন ভট্টাচার্য প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। আবার যে সকল প্রতিভাবান গণশিল্পী একেবারে শোষিত শ্রেণী থেকে এসেছিলেন, যাঁরা গণসংস্কৃতির সত্যিকারের বনিয়াদ, তাঁদেরও আমরা ধরে রাখতে পারলাম না। বর্তমান সমাজব্যবস্থার যাঁতাকলে কে কোথায় কীভাবে পিষ্ট হচ্ছেন তার খবর রাখার আগ্রহও যেন আমাদের নেই।
দোতারা বাদক টগর আধিকারী অভাবের জ্বালায় নাকি পাগল হয়ে গেছে। সহযোদ্ধা নিবারণ পণ্ডিত, বিখ্যাত গম্ভীরা গায়ক বিশু পণ্ডিত এঁরা – শোষকশ্রেণীর কৃপার দানকে ঘৃণাভরে বারে বারে প্রত্যাখ্যান করেও আদর্শের পতাকা ঊর্ধ্বে ধরে রেখেছিলেন জানি। কিন্তু তারপর? তারপর আর জানি না। কে কার খবর রাখে? কিন্তু যাক সে কথা।
পরবর্তী ইতিহাস – সংক্ষিপ্ত। পার্টির অভ্যন্তরে সংকীর্ণতাবাদী ঝোঁক, সংকীর্ণতাবাদী নেতৃত্ব, সাধারণ কর্মীদের বিদ্রোহ, বিটিআর-এর৪ নেতৃত্বের অবসান। অজয় ঘোষের৫ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ইত্যাদি ঘটনার গতিপথে পার্টির মধ্যে সংশোধনবাদী চিন্তাধারার আত্মপ্রকাশ, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও শেষপর্যন্ত পার্টি দুভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে আজকের মার্ক্সবাদী কম্যুনিস্ট পার্টির আত্মপ্রকাশ। এই সমস্ত ঘটনাগুলি এত দ্রুতগতিতে ঘটে যেতে লাগল যে তার ধাক্কায় বা প্রভাবে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে দেখা গেল একটা ভাঙাগড়া, একটা ওলোটপালটের যুগ। বহু গণসংগঠন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, আবার তারই পাশাপাশি গড়ে উঠল নতুন ভাবে নতুন সংগঠন। এই ঝড়ঝাপটা বিশৃঙ্খলার মধ্যে কখন কীভাবে আমিও যে ছিটকে পড়লাম তা আজ আর ঠিক ঠিক মনে করতে পারি না। স্মৃতিশক্তির তন্ত্রীগুলি সব যেন ঢিলেঢালা। এখন জীবন সায়াহ্নে পানের দোকানে বসে খিলিপান বিক্রি করি বাঁচার জন্য। এ যেন শুধু বাঁচার জন্যই বাঁচা। ক্লান্তি, অবসাদ স্মরণ করিয়ে দেয় আগত শেষদিনের কথা। আশা আকাঙ্ক্ষার তন্ত্রীগুলি কালের প্রভাবে নীরবে ঝিমিয়ে পড়ে। আজ নয় কাল, কিংবা দু-মাস — ছ-মাস পরে হয়তো আমি থাকব না, থাকার কথাও নয়, মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু যাঁরা থেকে যাবেন, যাঁদের সামনে রয়েছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, প্রাণে রয়েছে অদম্য প্রেরণা, চোখে মুখে রয়েছে নতুনের সম্ভাবনা, তাঁদের মধ্যে থেকে গড়ে উঠবে যে নতুন দিনের গণশিল্পী, যাঁদের ললাটে আঁকা থাকবে আগত দিনের শোষণহীন মানব সমাজের তিলক, তাঁদের কল্পনা করে আমি আমার সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাই।
পাদটীকা
১ নৈহাটির অনুষ্ঠানের ঠিক প্রসঙ্গটি আমরা জোগাড় করতে পারিনি। তবে জানা গেছে এটি হয় চটকল মজুরদের কোনো একটি সমাবেশে। এটাও আমরা জেনেছি যে দুর্ভিক্ষ-পরবর্তী ওই সময়ে পি সি যোশি ২৪ পরগনার বিভিন্ন জায়গায় সভা করেছিলেন।
২ মহম্মদ আলি পার্কের অনুষ্ঠানটি ছিল ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের সমাবেশের একটি অংশ। ১৯৪৬ নয়, ১৯৪৫ সালের ৩-৮ মার্চ এটি অনুষ্ঠিত হয়। সুধী প্রধান স্মারক গ্রন্থ, মালিনী ভট্টাচার্য সম্পাদিত, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, ১৯৯৯, পরিশিষ্ট ৩, পৃঃ ৩৬৮-৩৭০।
৩ এই বইয়ের ‘প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত অন্যান্য গান’-এর ৩নং গান, পৃঃ ৮৩-৮৫।
৪ বি টি রণদিভে, সাধারণ সম্পাদক, ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির (১৯৪৮-৫১)।
৫ ১৯৫১ সালে অজয় ঘোষ ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন।
লোকসমাজের অন্তস্তল থেকে যে শিল্প-সাহিত্যের অভ্যুদয় ঘটে, তাকে আমরা বলি লোকসাহিত্য বা লোকশিল্প। শিল্প-সাহিত্যের মর্যাদাপ্রাপ্ত যে কোনো ছড়া-কবিতা-গল্প-গদ্য-গান লোকসাহিত্য বা লোকশিল্প নয়। মেটিয়াব্রুজের বদরতলা গ্রামের মাটি থেকে যে কবি উঠে এসেছিলেন, ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে জনতার তাগিদ থেকে গান রচনা করেছিলেন, তিনি শুধু একজন কবি বা গায়ক নন, তিনি কবিয়াল, তিনি লোককবি। গুরুদাস পাল। তাঁর গড়ে ওঠা বামপন্থী মন ফুটে উঠেছিল তাঁর গানে, তাঁর নাটকে, তাঁর সৃষ্টিতে। তাই তাঁকে বলা হয়েছে গণ-কবিয়াল।
গুরুদাস পাল। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন কুমোর বা কুম্ভকার; মাটি নিয়ে তাঁরা কাজ করতেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন চটকল-শ্রমিক। তাঁর জন্ম-তারিখ নিয়ে মতান্তর রয়েছে। সম্ভবত জানুয়ারি ১৯১৩ সালে (২৫ বা ২৬ পৌষ ১৩১৯ বঙ্গাব্দ) তাঁর জন্ম। তখনকার দিনে সাধারণ শ্রমজীবী পরিবারে জন্ম-তারিখ সবসময় লিখে রাখা হত না। ১৯৬৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর তাঁর অকালপ্রয়াণ হয়। আমরা মনে করি, তিনি বেঁচে রয়েছেন মেটিয়াব্রুজ এবং বদরতলার লোকজীবনে। যদিও আজকের প্রজন্ম এখনও তাঁকে যথাযথভাবে চিনতে পারেনি। সেই উদ্দেশ্যে জন্মশতবর্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আমরা মাটির কেল্লা-র পক্ষ থেকে তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবন ও শিল্প’ পুনঃপ্রকাশ করছি। মৃত্যুর কিছুদিন আগে পাঠানো লেখাটি ‘গণনাট্য’ জানুয়ারি ১৯৬৯ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। পরে মালিনী ভট্টাচার্য ও প্রদীপ্ত বাগচি সম্পাদিত ‘কবিয়াল গুরুদাস পাল’ বইতে এটি পুনঃপ্রকাশিত হয়। টীকাগুলি ওই বইয়ের ‘উল্লেখপঞ্জি’ অংশ থেকে নেওয়া হয়েছে।
তীর্থরাজ ত্রিবেদী says
‘কবিয়াল গুরুদাস পাল’ বইটি কোথায় পাব জানতে চাই। যদি আপনাদের কাছে কোনও কপি থাকে সেক্ষেত্রে যোগাযোগ করতে চাই। গুরুদাস পাল সম্পর্কে ইন্টার্নেটে কোনও বইপত্র বা লেখার হদিস থাকলে দয়া করে আমায় তা মেল করবেন; আপ্লুত হই। ধন্যবাদ।
TG Roy says
This is completely an unknown story to me & people of Bangladesh & West Bengal as well.
Many thanks for your efforts.
Please contribute as much as you can.
Wish you all the best.