অমিতাভ সেন, ভবানীপুর, ৮ এপ্রিল#
শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনে মনীন্দ্র চন্দ্র কলেজের দিকে বেরোতে গেটের মুখে পাহারাদার পুলিশের গলা শোনা গেল, কী হচ্ছে! এখানে এসব করবেন না। সরে যান। গেটের সামনে ফুটপাথের ওপর কলেজের ছাত্ররা একটা ঠাণ্ডা পানীয়র ক্যান নিয়ে ফুটবল খেলছে। গেটের সামনে সিঁড়ির ওপর ছাত্রীরা বসে হাসাহাসি করছে। এই ফুটপাথটা ওই কলেজের এত গায়ে গায়ে যে ছাত্রছাত্রীরা এখানেই রোজ আড্ডা জমায়। পুলিশের কথা ছাত্রেরা কানেই নিচ্ছে না। যে ছেলেটার সাজগোজ দেখনদারী সে ক্যানটা নিয়ে পায়ে নাচানোর চেষ্টা করছে যেমন করে বল নাচায়। আমি পাশ কাটিয়ে বাঁদিকে ঘুরে ডান হাতের রাস্তা ধরলাম — শচীন মিত্র লেন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই পৃথিবী এত তেতে উঠেছে যে বেলা সাড়ে চারটেতেও রাস্তা থেকে ওঠা গরম ভাপে গায়ে যেন আগুনের হলকা লাগছে। চৈত্রের বাতাস নড়ছে না। বাঁদিকে একটা বাড়ির গায়ে সাদা ফলকে লেখা শহীদ শচীন্দ্রনাথ মিত্র। দাঁড়িয়ে পড়লাম। ফলকে লেখা আছে মহাত্মা গান্ধীর শিষ্য শচীন্দ্রনাথ ১৯৪৭ সালে দাঙ্গার সময়ে শান্তি মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ছুরিকাহত হয়েছিলেন।
যাব এই গলিরই ওই মুখে বাগবাজার স্ট্রীট। দু-পাশের বাড়িগুলো বেশ পুরানো। আমাকে পেরিয়ে একটা মারুতি ভ্যান সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। স্কুলের বাচ্চায় ভর্তি সেই গাড়িটা দাঁরাতেই বাচ্চারা সমস্বরে চেঁচাতে লাগল, ‘শহরে ঢেউ উঠেছে, শহরে ঢেউ উঠেছে’। অমনি ডানদিকের গলিতে দেখি এক বয়স্ক মহিলা আলুথালু বেশে বেরিয়ে এসে বাচ্চাগুলোর মা-বাপ তুলে উদুম গালাগাল করতে শুরু করল। বাচ্চাদের এক সঙ্গী নেমে যাওয়া পর্যন্ত বাচ্চাদের স্লোগান ‘শহরে ঢেউ উঠেছে’ আর সেই মহিলার গালাগালি চলতে থাকল। গাড়ির ড্রাইভার বার দুয়েক বাচ্চাগুলোকে হেই হেই করে ধমক দিয়ে হেসে ফেলল। একটা কুকুর ছুটে এসে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে গাড়ির কাঁচের জানলায় উঁকি মেরে কাকে যেন খুঁজছে। হুস করে গাড়ি ছেড়ে দিল।
বাচ্চাদের গলা মিলিয়ে যেতে যেতেই ঢাকের আওয়াজ। ঢাক ঠিক নয়, দু-হাতে দুই কাঠি নিয়ে চড়বড়ি বাজাতে বাজাতে আসছে ফতুয়া পড়া গলায় গামছা দেওয়া এক বৃদ্ধ। সঙ্গে একটা রোগা কালো বউ লাল হলুদ চেককাটা শাড়ি পরে মাটির সরা হাতে হাঁকছে, ‘বাবা তারকনাথের চরণের সেবা লাগে — মহাদেব।’ দোতলার ঝুলবারান্দা থেকে এক ভদ্রমহিলা একটা কয়েন ছুঁড়ে দিলেন। মাটির সরায় পড়ে পয়সাটা গড়িয়ে গেল ঢাকির খালি পায়ের মাঝে লুঙির ছায়ার দিকে। চাষি বউ ঝুঁকে সেটা কুড়িয়ে নিল।
আচ্ছা, এরা চাষি তো? চেহারায় পোষাকে সেরকমই লাগছে। সময়টাও চৈত্র মাস। গাজনের সন্নেসীরা তো বরাবর গ্রামেরই বেকার কৃষক। হইয়ত আজই এসছে উত্তর চব্বিশ পরগণার কোনও গ্রাম থেকে। অথবা গাঁ ছেড়ে দমদমের কোনও বস্তীতে এসে উঠেছে আরও আগে।
যাই হোক, সরায় একটা টাকা দিতে গিয়ে দেখলাম, একদানাও চাল নেই। আগে আমাদের মা-মাসীরা দেখতাম শুধু টাকা দিত না, সঙ্গে এক কৌটো চাল দিত। কেউ কেউ আলুটা-কলাটা দিত। দেখতে দেখতে বাগবাজার স্ট্রীটে পড়লাম। সামনের পুরোনো বাড়িতে একতলার অন্ধকার ঘুপচিউ ঘরে শেষ বিকেলের অল্প আলোয় তক্তপোষের পরে এক দাদু তার নাতিকে পড়াচ্ছে, ‘তাহলে কোনটা বড়ো? বলো বলো …’ দাদুর গর্জন নাতির নীরবতা … আমি তাদের পাশ কাটিয়ে কোণের সিঁড়ির দিকে চলেছি। আমার গন্তব্য দোতলায়। সেখানে আমার ছাত্রী অপেক্ষা করছে। কিন্তু কী পড়াবো ভাবছি। কোনও শিক্ষাতেই কি কিছু শিখিয়ে তোলা যাবে? চৈত্রের বাতাস যে নড়ছে না।
Leave a Reply