শান্তনু ভট্টাচার্য, মেটিয়াব্রুজ, ৩০ ডিসেম্বর#
১৪-১৬ ডিসেম্বর মেটিয়াব্রুজ-মহেশতলার সমবেত ক্ষুদ্র পত্র-পত্রিকা সংস্থা ‘মাটির কেল্লা’-র উদ্যোগে ষষ্ঠ বর্ষ ‘বইমেলা ও লিট্ল ম্যাগাজিন সমাবেশ’ অনুষ্ঠিত হল রবীন্দ্রনগর রবীন্দ্রমঞ্চে। তিনদিন ধরে সন্নিহিত বদরতলা, মুদিয়ালি, আকড়া, সন্তোষপুর সহ রবীন্দ্রনগর অঞ্চলের নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল এই মেলায়। এবারের মেলা উৎসর্গ করা হয় লোককবি গুরুদাস পালকে। এবছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। গুরুদাস পাল সম্বন্ধে বক্তৃতা দেন অঞ্জন পাল, আনন্দ কিশোর পাল এবং নিখিল রঞ্জন জোয়ারদার। সাদাত হাসান মান্টো সম্বন্ধে বলেন ‘নতুন শতক’ পত্রিকার সম্পাদক শীর্ষেন্দু দত্ত।
এবছর মেলার শেষদিন রবিবার সকাল থেকে অনুষ্ঠিত হল ‘লিট্ল ম্যাগাজিনের কাঠামো’ নিয়ে একটি আলোচনা। শুরুতে মাটির কেল্লার সম্পাদক শান্তনু ভট্টাচার্য এই আলোচনার উদ্দেশ্য নিয়ে ভূমিকা করার পর আলোচনাটি সঞ্চালন করেন ‘বিতর্কিকা’ পত্রিকার সম্পাদক অভ্র ঘোষ এবং ‘পরিকথা’ পত্রিকার সম্পাদক দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়।
অভ্র ঘোষ প্রথমেই জানান, ১৯৮০ সালে বিতর্কিকা শুরু হয়। কিছুদিন চলার পর তা বন্ধ হয়ে যায়, তারপর ১৯৯৭ সালে ফের চালু হয়ে চারবছর চলার পর বন্ধ হয়। আবার এখন শুরু হচ্ছে নতুনভাবে। এই বন্ধ না হওয়াটা সংগঠনের কাজ। সাংগঠনিক দুর্বলতা লিট্ল ম্যাগাজিনের ধর্ম।
দেবব্রত চট্টোপাধ্যায় বলেন, সংগঠন প্রসঙ্গে ‘পরিকথা’ পত্রিকার উদাহরণ দেন। তা গোড়ার দিকে ছিল সময়ের কাগজ, সম্পাদকের নয়। কিন্তু আজ আমি সংগঠন ছাড়াই একা কাগজটা করছি। মূল কথা, যেটা করতে চাইছি সেটা করতে পারা।
‘দুর্বার কলম’ পত্রিকার সম্পাদক অমর নস্কর বলেন, ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর লিট্ল ম্যাগাজিনের প্রতি আগ্রহ ছিল। তারপর প্রেসকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আরও উৎসাহ বেড়ে ওঠে। হুগলির ধনেখালিতে থাকাকালীন ‘হুগলি কথা’র সম্পাদক মনসুরকে দেখে তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। ছোটোদের পত্রিকা ‘টাটাই টো’র সম্পাদক ব্রজেন্দ্র নাথ ধর বলেন, মানবিক ভালোবাসা থেকে পত্রিকা করা আর একাকিত্ব থেকে পত্রিকার সূত্রপাত। অর্থাৎ নিজের মতো করে কিছু বলা। ‘সংগ্রামী নন্দীগ্রাম’ পত্রিকার সম্পাদক প্রবীণ কানাইলাল দাসের মতে, সংগ্রাম পত্রিকা প্রকাশের এক বিরাট প্রেরণা। ১৯৮২ সালে তাঁরা ‘নন্দীগ্রাম উন্নয়ন পরিষদ’ গঠন করে সংগ্রামের কর্মসূচি নিয়েছিলেন। তারই সূত্র ধরে পত্রিকা প্রকাশ। পাঠকই ঠিক করে দিচ্ছে এর কাঠামো কী হবে। তারাই বলে, এটা লিখুন, এটা ছাপুন। তাঁর মতে সংগঠন দরকার বটে, কিন্তু ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’। ‘ললিত ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক শেখ আবদুল মান্নান জানান, চাকরির সূত্রে গৌহাটিতে থাকাকালীনই তাঁর লিট্ল ম্যাগাজিনের প্রতি আগ্রহ জন্মায়।
মেটিয়াব্রুজ-মহেশতলা অঞ্চলে এই মুহূর্তে সবচেয়ে পুরোনো পত্রিকা আকড়া থেকে প্রকাশিত ‘প্রগতি’। এই পত্রিকার সম্পাদক মহম্মদ আলী বলেন, ১৯৬২ সালে স্থানীয় মুসলমান সমাজে শিক্ষার প্রসারের কাজ করার জন্য গড়ে উঠেছিল ‘প্রগতি পরিষদ’। সেখান থেকেই ১৯৬৪-তে প্রগতি পত্রিকা প্রকাশ। সদ্য প্রয়াত সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বলেছিলেন, ‘লিট্ল ম্যাগাজিনের নিয়তি মৃত্যু’। কিন্তু তিনি প্রগতি পত্রিকা চালিয়ে তা ভুল প্রমাণ করেছেন।
১৯৯৭ সাল থেকে প্রকাশিত বজবজের ‘সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনা’ পত্রিকার সম্পাদক মানসী গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, তাঁরা বিজ্ঞাপন জোগাড় করতে পারেন না। নিজেরাই খরচ বহন করে চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতি মাসে আড্ডার আয়োজন করেন। ‘উজান’ পত্রিকার বিমল পণ্ডিত জোর দেন সময়ের ওপর। ১৯৭০-এর দশক থেকে যেসব পত্রিকা বেরোচ্ছে, সেগুলো একটা নির্দিষ্ট দিশা নিয়েই এগিয়েছে। ‘হাওয়া ৪৯’ পত্রিকার মুর্শিদ এ এম ‘একলা চলো’ মনোভাব ব্যক্ত করে বলেন, লিট্ল ম্যাগাজিন একটা স্রষ্টার মতো। একটা কবিতা যেমন দশজনে মিলে লেখা যায় না, তেমন একটা পত্রিকাও দশজনে হয় না। তিনি তাঁর বক্তব্যে প্রবীণ সমীর রায়চৌধুরি এবং পোস্টমর্ডান ভাবনার প্রসঙ্গ আনেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোচারণ থেকে প্রকাশিত ‘সুচেতনা’র সম্পাদক গৌতম মণ্ডলও বাচ্চাদের সংগঠন ও দেওয়াল পত্রিকার সূত্রে ছাপা কাগজ বের করার প্রয়াস নিয়ে বলেন। তিনি নিজে কম্পোজের কাজ করেন। পায়ে হেঁটে সাইকেল চালিয়ে পত্রিকার কাজ করেন।
‘নতুন শতক’ পত্রিকার শীর্ষেন্দু দত্ত বলেন, পত্রিকা আমার একার নয়, সবাই মিলেই করি। কোনো স্টলে পত্রিকা রাখি না। বিভিন্ন বইমেলায় অংশ নিই। সেখান থেকে এর বিপনন হয়ে যায়। তিনি বলেন, একলা চলতে হতেই পারে, তবে ‘ডাক দিতে হবে’। সায়ন্তনী নাগও একলা চলো নীতিতে বিশ্বাস করেন না। তাঁদের পত্রিকায় সম্পাদক নির্বাচিত হয়। শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত ‘লোকায়ত’ পত্রিকার সম্পাদক মৃন্ময় সেনগুপ্ত জানান, নিজেদের মত প্রকাশের জন্যই কাগজ, তবে এখন নানান ভিন্ন মতামতকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
মেটিয়াব্রুজ বদরতলার ‘ভাস্বর’ ও ‘চিন্তন’ পত্রিকার সম্পাদক অঞ্জন পাল পত্রিকাকে মানুষের শরীরের সঙ্গে তুলনা করেন। মানব শরীরে যেমন একটি অঙ্গ কাজ করলে শরীর বিকল হয়ে যাবে, তেমনি পত্রিকার ক্ষেত্রে লেখা, বিজ্ঞাপন এবং পাঠকের চাহিদা না থাকলে সেই কাগজ দাঁড়াবে না। বজবজ থেকে প্রকাশিত ‘আমি’র সম্পাদক বৃন্দাবন দাস বলেন, বাজারি নাকি বাজারি নয়, তার থেকে বড়ো কথা সৃষ্টিটা যেন ঠিক থাকে। সেটাই তো পত্রিকার কাঠামো গড়ে তোলে।
অল্পকথায় আলোচনায় অংশ নেন শরদিন্দু সাহা, দীপেন সেনগুপ্ত এবং সৌমিত্র সিন্হা। তিনঘন্টার বেশি সময় ধরে চলা সভার শেষে উপসংহারে অভ্র ঘোষ বলেন, আজকের আলোচনায় যেটা বিতর্কিত তা হল, দলবদ্ধ না একলা চলো। একটা সমঝোতা দরকার। একলা চলা ভালো নয়, তবু চলতে হয়। মান ধরে রাখার জন্য। দরকার সততাও। দ্বিতীয়ত, দিশাহীনতা তো মৃত্যুর নামান্তর। লিট্ল ম্যাগাজিন মানেই আন্দোলন, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। তবে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার বিষয়টা নিয়ে তাঁর বিভ্রান্তি রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের গৌরব তো আমরা পেতেও চাই, তবে তার বোধহয় একটা সীমাও আছে। প্রতিষ্ঠানের সমার্থক শব্দ ‘বাজারি’ নয়।
এছাড়া এই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন ‘ত্রিদিব’ পত্রিকার মোহন নস্কর, ‘মন্থন সাময়িকী’র জিতেন নন্দী, ‘এখন সৃজনী’র মহব্বত হোসেন এবং ‘বহুবচন’ পত্রিকার অনিমেষ নস্কর। উপস্থিত সকলেই ভবিষ্যতে এধরনের আলোচনার আয়োজন হওয়ার গুরুত্ব স্বীকার করেন।
এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার আঞ্চলিক ইতিহাস বিষয়ক বই, পত্রিকা এবং স্থানীয় সংবাদপত্রের সংগ্রহের একটি প্রদর্শনী। বিদ্যানগরে অবস্থিত জেলা গ্রন্থাগার থেকে এগুলি নিয়ে আসা হয়েছিল।
Leave a Reply