অমিতাভ সেন, ভবানীপুর, ১৮ ডিসেম্বর#
আজ ১৮ ডিসেম্বর। মহম্মদ খুরবান সর্দারের বুকে আঁটা সাদা ব্যাজের কালো লেখা পড়ে জানলাম আজ আন্তর্জাতিক সংখ্যালঘু অধিকার দিবস। খুরবানের সঙ্গে দেখা হল ১০-৪১ এর দমদমগামী মেট্রোয়। ‘কবি নজরুল’ অর্থাৎ ‘গড়িয়া বাজার’ এলাকার স্টেশন থেকে আমি উঠেছিলাম। অফিসটাইমের ভীড় একটু কমে এসেছে। সীট পেলাম কামরার শেষে ডানদিকে প্রতিবন্ধীদের সীটে। সেখানে খুরবান ও একজন বয়স্ক মুসলমান বসেছিলেন। উল্টোদিকে প্রবীণদের সীটে আরো তিনজন খুরবানের বয়সী যুবক মুসলমান। সকলেরই লুঙ্গি-জামা-মাথায় ফেজ টুপি আর বুকে ব্যাজ আঁটা। খুরবানকে জিজ্ঞেস করলাম, আজ কী, কোথায় যাচ্ছেন আপনারা? বলল আসামে আমাদের উপর দাঙ্গা হয়েছে, তার প্রতিবাদ সভা, ভারত সভা হলে যাচ্ছি, কামারুজ্জামান সাহেব বলবেন। বুকের ব্যাজে দেখলাম লেখা আছে ‘আন্তর্জাতিক সংখ্যালঘু অধিকার দিবসে, সারা বাংলা সংখ্যালঘু কাউন্সিলের ডাকে সভা’।
আমার প্যান্ট-পাঞ্জাবী, কাঁধে ঝোলা, রোগা পাকানো চেহারা, সর্বোপরি লম্বা কাঁচা-পাকা দাড়ি সম্প্রতি আমাকে দুটো বিশেষ বর্গভুক্ত করে দিয়েছে। দুদিন আগে হরিশপার্কের পাশ দিয়ে আসার সময় মাঠে ছেলেদের বলখেলা দেখে দাঁড়িয়ে গেছিলাম। তখন বেলা সাড়ে এগারোটা। একজন মাঝবয়সী লোক বাজার করে ফিরছিলেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি পুরোনো জিনিস নেন? আমি একটু ভুরু কুঁচকে প্রশ্নের চোখে তাকাতে বললেন, আমার কাছে কিছু পুরোনো জিনিস আছে। আমি হেসে বললাম, সবই তো পুরোনো। ভদ্রলোক কিছু বুঝতে পেরে, ঠিক আছে ঠিক আছে, বলে তাড়াতাড়ি সরে পড়লেন। এটা হল বিক্রীওয়ালা বর্গ। অর্থনৈতিক।
আজকে সকালেও ভবানীপুর থেকে ট্রেনে ওঠার জন্য হনহন করে হাঁটার সময়, মসজিদ গলির একজন মুখচেনা মুসলমান যুবক হেঁকে বলল, সালাম আলেকুম। আমি না থেমেই ‘আলেকুম সালাম’ জানানোয় সে বলল, ‘আগান চাচা, আসছি’। এটা হল মুসলমান বর্গ। ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক।
ফলে মেট্রোতে খুরবানের সাথে আলাপ জমাতে অসুবিধা হল না। ওর নাম জানানোর পর খুরবান বলল, ক্যানিং লাইনের তালদি থেকে ওরা আসছে, অনেকে আছে ট্রেনের এমাথা-ওমাথায়। খুরবান চাষের কাজ করে। নিজের জমি নেই। অপরের জমিতে কাজ করে। ধানকাটা হয়ে গেছে, এখন বাঁধা ও তোলার কাজ। ধান ভালোই হয়েছে। ২২০ টাকা রোজ। আজ কাজ কামাই দিয়ে সবাই মিলে যাচ্ছে।
এইসব বলতে বলতেই দু-স্টেশন পার। সামনের প্রবীণদের সিটের সামনে একজন প্রবীণ অফিস-যাত্রী কোট-প্যান্ট পড়া, হাতে ব্যাগ। মুসলমান যুবকদের একজনকে উঠতে বলছেন। ওরা বুঝতে পারছে না। আরেকজন কমবয়সী অফিসযাত্রী ব্যাপারটা বলতেই প্রথমে একজন উঠে দাঁড়ালো তারপর তিনজন মিলে প্রথমে দুই কামরার সংযোগস্থলে গিয়ে দাঁড়ালো তারপরে পাশের কামরায় চলে গেল। পরের স্টেশনে সামনের দুটো ফাঁকা সীটে আরো দুজন প্রবীণ ব্যক্তি এসে বসল। আমাদের প্রতিবন্ধী সীটের সামনে দুজন ভালো প্যান্ট-শার্ট পড়া বাবু হাতে আটাচি কেস নিয়ে এসে দাঁড়াতেই, খুরবানের পাশের প্রবীণ মুসলিম ভদ্রলোক ওকে ডেকে নিয়ে পাশের কামরায় চলে গেলেন। খুরবান তখন গলা নামিয়ে আমায় বলছিল, সভা ১২টায় শুরু হয়ে সারাদিন চলবে। সামনে দাঁড়ানো দুই বাবু আমার পাশে বসার পর, তাদের একজন আমায় অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন।
আমি নেতাজী ভবনে নামার একটু আগে উঠে পাশের কামরায় গিয়ে দেখলাম খুরবান আর ওর সঙ্গীরা সব একজায়গায় দলা পাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি খুরবানকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, উঠে এলে কেন, সীট তো ছিল? খুরবান হেসে ওর সঙ্গীদের দেখিয়ে বলল ওদের সাথে যাব। আমি বললাম, কোথায় যাবে তোমরা, কতদূর, নামবে কোথায়? ওরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। কেউই ঠিক বলতে পারে না। শেষে একজন অস্ফুটে বলে, বউবাজার। আমার স্টেশন এসে যায়। নেমে পড়ি — নামার অধিকারে, স্টেশনের নাম জানবার অধিকারেও। আর এত সব অধিকার থাকার জন্য নিজেকে সংখ্যাগুরু মনে হয় বটে।
Leave a Reply