অমিতাভ সেন, কলকাতা, ১ জুন#
বর্ষা কি আগে এসে পড়ছে? জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি ভাদ্র মাসের মতো আকাশে মেঘ, প্যাচপ্যাচে গরম। রোদ উঠল না। এসে পড়ল নিম্নচাপ। পাড়ার বন্ধুর বাড়িতে গেছিলাম আরেক বন্ধুর ছেলেকে ইসকুলে ভর্তি করার টাকা ধার করতে। আমাদের ঘরে টাকা বাড়ন্ত। দেখে এলাম ওদের পরিবারের আরেকজন জ্বরে পড়েছে। ভাইরাল ফিভার। আমাদের ঘরেও চলছে। কলকাতায় এ সময়ে এই জ্বরের ভাইরাস ঋতুচক্রের মতোই ফিরে ফিরে আসে। শুনে এলাম বন্ধুর শ্বশুর বাড়ি থেকে খবর এসেছে – ওখানে খুব ঝড়বৃষ্টি। ওরা ভয় পাচ্ছে। ওদের সুন্দরবনের কাছে বাড়ি- নদীর ধারেই।
খানিক আগে চুল কাটতে গিয়েছিলাম ইটালিয়ান সেলুনে – মানে ফুটপাথে ইট পাতা নাপিতের দোকানে। অবশ্য এখন সেখানে জারুলগাছের নিচে ইটের বদলে ছোটো টুল পাতা। সেখানে সুরেশ ঠাকুরের কাছে চুলদাড়ি ছাঁটা এখনো ২০ টাকায় হয়ে যায়। টুলে বসতে সুরেশদা গায়ে একটা সাদা কাপড় জড়িয়ে দেন, যে কাপড়টা কলপের ফোঁটা পড়ে পড়ে কালো হয়ে গেছে। আমি যখন গেলাম, তখন সুরেশদা ফতুয়া খুলে খালি গায়ে নারকেল তেল মাখছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, তেল মাখলে গা- জ্বালা একটু কমে। সারা গায়ে তাঁর লাল লাল ঘামাচি।
সুরেশদা দাড়িতে হাত দিতেই পানের দোকানের গোবিন্দ দোকান বন্ধ করে পাশে এসে বসল। বলল, ‘সুরেশদা তুই মুসলমানের দাড়ি কাটছিস? দাঁড়া তোর এখানে বসা বার করছি’। সুরেশদা বললেন, ‘আমার কাছে হিন্দু-মুসলমান কই আছে, চুলদাড়ি কাটা আমার কাজ, সে যেই হোক কাটতে হবে’। গোবিন্দর মুখে ফিচেল হাসি। আমি গোবিন্দকে বললাম, ‘তুই বকবক না করে দেখ আমার দাড়িটা ঠিক করে কাটা হচ্ছে কিনা।’ ও বলল, ‘শালা কত টাকা দিয়েছিস?’ বললাম, ‘২০ টাকা’। উত্তরে গোবিন্দ বলল, ‘হুম, এই তোরা নাকি গরিবকে ভালবাসিস?’ আমি বললাম, ‘তুই কি এই বেলা ১২টাতেই এক পাত্র চড়িয়েছিস?’ ও বলল, ‘হ্যাঁ রে ইংলিশ খাচ্ছি, হুইস্কি, খাবি নাকি এক পেগ?’ আমি বললাম, ‘পাগল, এই গরমে!’ গোবিন্দ বলল, ‘আরে বিষে বিষক্ষয়।’ আমি ‘থাক’ বলায় ও উঠে চলে গেল।
সুরেশদা হাসছে, ‘খেলেই বকবক করবে।’ সুরেশদাও অবশ্য খেয়েছে। সকাল সাতটা থেকে এগারোটা চুলদাড়ি কাটার পর সুরেশদা খেতে যায় নাস্তা, কচুরি দুটো আর গাঁজাপার্কে পঞ্চু সা’র ঠেক থেকে দশ টাকায় এক গেলাস বাংলা। তারপর আবার কাজে লেগে যায়। মুখে একটু গন্ধ ছাড়া কিছু বোঝা যায় না। হাত কাঁপে না। চশমা ছাড়া দিব্যি কাঁচি চালায় — এই এত বয়সেও।
বয়স কত জিজ্ঞেস করে আমি একটু খোঁচা দিই। সুরেশদা বলতে থাকেন, ‘সেই সাতচল্লিশ সালে জন্মেছি। এই যে ডানহাতের গটরায় দাগ দেখছেন – সাতমুখ ফোঁড়া হয়েছিল, কিছুতেই সারছিল না। দেশের বাড়ি থেকে বাবা, বড়োবাবার সঙ্গে চলে আসলাম কলকাতায়, তখন আমার বয়স ১৩ বছর।’ সুরেশদার দেশ বিহারের মুঙ্গেরে। ১৯৬০ সালে কলকাতায় এসে বাবার সঙ্গে কাজ শিখেছেন। বাবাও নাপিত ছিলেন। তিনি ঘুরে ঘুরে কাজ করতেন। সুরেশদা ১৯৬৫ সাল থেকে নাপিতের কাজ শুরু করেন। আগে বসতেন গলির ওধারে বকুল গাছের তলায়। সে গাছটা ঝড়ে পড়ে যাওয়ায় এখন এখানে। আমাকে দুঃখ করে বলেন, ‘ছোটো ছেলেটা বসে বসে খায়। কত বলি কাজ শিখতে। শিখবে না। বড়ো ছেলেও নাপিতের কাজ শেখেনি, সে গাড়ি চালায়। মেয়ে দুটোর বিয়ে দিয়েছি। দেশে বউ আছে। তাকে মাসে মাসে টাকা পাঠাতে হয়। একফোঁটা জমি নেই আমার। কী করব? আমাকে খেটে খেতে হবে। কাজ করব, খাব। আমি রাজনীতি-ফাজনীতি করি না। লালু পরসাদ আগে গরিব আদমি ছিল, মন্ত্রী হল আমির হয়ে গেল। নীতিশকুমারও তাই। আমি ওসব না। এখানে অনেকে বলেছে। আমি বলেছি, না। দেখলাম তো কত। নকশাল আমল – মারপিট, পুলিশের দৌড়াদৌড়ি। এই লালঝাণ্ডার সরকার এল, আগে কোথাও ছিল না, তারপর আবার চলে গেল। এখন নতুন সরকার। আমি কী করব? খাটব, খাব। ওসব কেন করব? আপনি দেখেছেন না, আমি এখানেই রাতে শুয়ে থাকি, এই ফুটপাথই আমার ঘর বলুন, দোকান বলুন সব।’
ব্যস, আমার চুলদাড়ি কাটা শেষ। রাতে সত্যিই সুরেশদা এইসব চিরুনি-কাঁচির বাক্স আর দুটো পাথর দিয়ে একটা উঁচু মতন শোয়ার জায়গা বানিয়ে রোজ তার ওপরে শুয়ে অঘোরে ঘুমায়। ঘুমানোর আগে অবশ্য আবার এক পাইট বাংলা খেয়ে আসে। আমি যখন বাড়ি ফিরি তখন দেখি সুরেশদা নাক ডাকাচ্ছে — সে রাত ৮টাই হোক আর ৯টাই হোক। কোনো কোনো দিন সুরেশদার পা বা মাথার অনেকখানি উঁচু সেই কঠিন বিছানা থেকে অনেকটা ঝুলে নিচে পড়ে থাকে। তাতে কিন্তু ঘুমের কোনো ব্যাঘাত হয় না। থাক বাবা এমন ভাবেই। ফুটে না যায়। এই তো কদিন আগে আমাদের পাড়ার মুচি যে সুরেশদার ঠেক থেকে তিনটে দোকান পরে রোল-চাউমিনের চাকা গাড়ির ওপর রাতে ঘুমাত, সে হঠাৎ ঘুমের মধ্যে কবে মরে গেল ভালো করে জানতে পারলাম না। তারও তো রোজকার রুটিন সুরেশদার মতোই দুবেলা বাংলা মদে ভেজা, সেও তো অমন নাক ডাকিয়ে ঘুমাত। আর, একদিন সকালে গিয়ে দেখলাম তার জায়গায় তার ছোটো ছেলেটা বসে জুতো সারাচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম কদিন আগেই তার বাবা মারা গেছে। রোজ কি আর এদের খবর রাখা যায়?
Leave a Reply