শুভা চৌধুরী, কোচবিহার, ২৫ সেপ্টেম্বর#
ছোট্ট একটি শব্দ ‘রিকশা’ — আমাদের এই ছোট্ট পরিধির শহর কোচবিহারে চলাচলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বাহন। কোনো কারণে যদি রিকশা ধর্মঘট হয়ে থাকে, তবে হয়রানির একশেষ। যদিও মফস্বল শহরগুলিতে এখন অটো বা ব্যাটারিচালিত রিকশা রমরমিয়ে চলছে — তবে সেগুলি তো কিছু নির্দিষ্ট রাস্তায় চলে। ছোটো পরিসরের রাস্তা বা গলিতে সেগুলির চলাচল সীমিত। সেক্ষেত্রে তখন একমাত্র ভরসা রিকশা।
আর এই রিকশা নিয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির একশেষ। যখন আপনার প্রয়োজন তখন ডাকলে হয়তো চলমান কোনো রিকশাচালকের মুখে শুনবেন, আপনার গন্তব্যের দিকে সে যাবে না। স্ট্যান্ড থেকে ধরবেন? পায়ের উপর পা তুলে বসে রইবে, সে গাত্রোত্থানই করবে না। আবার কিছু রিকশাওয়ালা আছে যারা ডাক্তারের দালাল হিসেবে কাজ করে কমিশন লাভ করে থাকে এবং এদের মধ্যে বেশিরভাগ ডাক্তারই হাতুড়ে। কোচবিহার একসময়ে অর্থলগ্নি সংস্থাগুলোর মুক্তাঞ্চল ছিল, এখন সেরকমই হাতুড়ে ডাক্তারদের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছে, যদিও প্রশাসন নির্বিকার। গ্রামান্তর থেকে শহরে চিকিৎসার জন্যে আসা মানুষদের এরা বিপথে চালিত করে। সেদিন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, রিকশা থেকে নেমে এল একটি লোক। চেহারা বেশভূষা বলে দিচ্ছে নিতান্তই গ্রামের লোক। বাড়ির সামনের একজন হাতুড়ে ডাক্তারের সাইনবোর্ড দেখিয়ে শহরের স্বনামধন্য এক ডাক্তারের নাম বলে বলল রিকশাওয়ালা তাকে বলেছে এটাই সেই বিখ্যাত ডাক্তারবাবুর চেম্বার। যত বলি এটা সেই ডাক্তারবাবুর চেম্বার নয়, ওনাকে দেখাতে হলে একসপ্তাহ আগে নাম লেখাতে হয়, লোকটি কিন্তু আমার কথা বিশ্বাসই করতে চাইছিল না। শেষে যখন ব্যাপারটি তার বোধগম্য হল ততক্ষণে তো রিকশাওয়ালা পগার পার। জানি না লোকটি শেষ পর্যন্ত কী করল? এভাবে রিকশাওয়ালাদের পাল্লায় পড়ে প্রতিদিন কত লোকের কত সর্বনাশ হচ্ছে।
আজ সারা কোচবিহার জুড়েই এই রিকশাওলাদের সাথে আরোহীদের নিত্য লেগে থাকে বচসা। বচসাটা ভাড়া নিয়ে। রিকশায় উঠবার আগে একরকম ভাড়া এরা ঠিক করে নেবে আরোহীদের কাছ থেকে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে কোনো না কোনো কারণ দেখিয়ে সে ভাড়াটা বাড়িয়ে দিয়ে আগের ঠিক করা ভাড়া নিতে অস্বীকার করবে। প্রতিবাদ করলেই শুনতে হবে অজস্র গালাগালি, রাস্তায় লোক জমা হয়ে গিয়ে আপনি সম্মুখীন হবেন এক লজ্জাকর পরিস্থিতির। পৌর এলাকার মধ্যে চললেও পৌরসভার পক্ষ থেকে বেঁধে দেওয়া কোনো ভাড়ার তালিকা দেখা যায় না কোথাও, সেই সুযোগে ভাড়ারও কোনো ঠিকঠিকানা নেই – যার কাছ থেকে যেরকম দাঁও মারা যায় আর কি। হয়ত ৩০ মিনিট আগে যেখানে যেতে ভাড়া দেওয়া হয়েছে ২০ টাকা ৩০ মিনিট পরই সেখান থেকে একই রাস্তায় ফিরতে হলে ভাড়া গুণতে হবে ৩৫ টাকা। আবার একই গন্তব্যের জন্যে কেউ চাইবেন ১০ টাকা কেউ ১৫ টাকা কেউ বা ২০ টাকা। কলকাতার একজন রিকশাওয়ালাকে বলতে শুনেছি, ‘ভাড়ায় না পোষায় যাবেন না। ওই তো কত বাস-অটো চলছে, উঠে পড়ুন, অনেক কমে যেতে পারবেন।’ অসুস্থ বৃদ্ধদেরও এদের দুর্ব্যবহারের হাত থেকে নিস্তার নেই। বাস ট্যাক্সি অটোর ভাড়া বাড়লে আমরা চিৎকার করি। কিন্তু রিকশাওয়ালারা যে নিজেদের খুশিমতো ভাড়া বাড়িয়েই চলেছে তার বেলা? তাছাড়া পৌরসভার কাছে রেজিস্টার্ড রিকশার সঠিক পরিসংখ্যান আছে কিনা তাতে সন্দেহ হয়। এরপরও অধিকাংশ রিকশাতেই থাকে না আলো, রাত্রে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এতে।
ইতিমধ্যে শহরে চলতে শুরু করেছে ব্যাটারিচালিত রিকশা, শব্দহীন ও দূষণহীন এই গাড়ি অল্পদিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। এখন শহরে চলছে প্রায় ৪০টি মতো ব্যাটারিচালিত রিকশা। অল্প ভাড়ায় তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌছানোর তাগিতে মানুষ পায়ে টানা রিকশার বদলে এই গাড়ি বেছে নিচ্ছে। যার ফলে পায়ে টানা রিকশাওয়ালাদের রুজিতে টান পড়তে শুরু করেছে। এর প্রতিবাদে গত ২৮ আগস্ট কোচবিহার দেবীবাড়ি মাঠ থেকে বিরাট মিছিল করে গিয়ে মহকুমাশাসকের দপ্তরে ডেপুটেশন দিতে গিয়েছিলেন সংগ্রামী রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের কয়েকশো রিকশাওয়ালা। কিন্তু তারপর কিছুদিন আগে আমাদের শহরে দুদিন ধরে হয়ে গেল রিকশা ধর্মঘট।
তবে ভালো রিকশাচালক নেই তা নয়, তবে তার সংখ্যা মুষ্টিমেয়। এ সব ভালো রিকশাওলারা নির্দিষ্ট গন্তব্যের জন্যে সঠিক ভাড়া নিয়ে থাকে, কোনোরকম বচসা করেন না, এদের কথাবার্তা, আচার ব্যবহারও ভালো — বয়স্ক মানুষদের রিকশা থেকে ওঠা বা নামাতে এরা যথাযথ সাহায্য করে — কিন্তু কখনই আদর্শ হয়ে উঠতে পারে কি?
বেশ ভাল লেখা । তিন চার দশক আগে অধিকাংশ রিকশা চালকের পোশাক বলতে ছিল ধুতি । আজ সীমান্তবর্তী কোচবিহারে বিহারী রিকশা চালকদের জায়গা অনেক্ টা দখল করেছে মূলত জীবিকার খোজে বাংলাদেশ থেকে আসা কিছু মানুষ । গ্রামীন সংস্কৃতির উপর এদের প্রভাব যথেষ্ট পড়ছে । জেহাদী্রা ক্যারিয়ার হিসাবে এদের কাউকে ব্যবহার করছে কিনা তা প্রশাসন বলবেন । তবে এরা আধিকারিকদের ঘুম তাড়িয়েছে তা সকলেই বলছেন ।