চূর্ণী ভৌমিক, ৩০ ডিসেম্বর, সূত্র উইকিপিডিয়া#
মধ্য ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়া। পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও ছোট এই দেশটাতে জনসংখ্যা খুবই কম। শুধুমাত্র উত্তর কলকাতায় যত লোক থাকে এই দেশটার সামগ্রিক জনসংখ্যাই প্রায় তত, ২০ লক্ষের একটু বেশি। ইউরোপের সাংস্কৃতিক রাজধানী, ছোট্ট স্লোভেনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মারিবোর উত্তাল হয়ে উঠল আন্দোলনে ২০১২ সালের নভেম্বর মাস থেকে। ৯৫ হাজার মানুষের বাসস্থান এই শহর। এক সপ্তাহের মধ্যে ২০ হাজার মানুষ প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় নেমেছে। এরা সবাই শান্তিপ্রিয় মারিবোরের অধিবাসী। অন্যান্য জায়গার তুলনায় এই শহরে ভোট না দেওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি। নির্বিবাদী চেহারার আড়ালে এত ক্ষোভ জমল কেন, যে তারা টাউন হলের সামনে পেট্রল বোম মারল? অভূতপূর্ব পুলিশি দমন চলেছে আন্দোলনকারীদের উপর, যা ১৯৯১ সালে স্বাধীনতার পর এই প্রথম। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে দেশটির অন্যান্য শহরগুলোতেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মারিবোরের মেয়র ফ্র্যাঙ্ক ক্যাংলার সহ আরো দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের পদত্যাগের দাবি জানায় সাধারণ মানুষ।
২০০৬ সালের পর ২০১০-এ পুনরায় নির্বাচিত হন ফ্র্যাঙ্ক ক্যাংলার। তাঁর ৬ বছরের পরিচালনার মেয়াদের মধ্যে বহুবার তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি, স্বজনপোষণ ও টাকা দিয়ে সমর্থন কেনার দায়ে অভিযুক্ত হন। তাঁর অর্ধসমাপ্ত ও ব্যর্থ প্রজেক্টের সংখ্যাও কম নয়। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে তিনি একটি নতুন প্রজেক্ট গ্রহণ করেন। সমস্ত ব্যস্ত এলাকায় ও বড় রাস্তায় মোড়ে মোড়ে রাডার বসানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। রাডারের সাহায্যে গতিশীল বস্তুর যাতায়াতের উপর নজর রাখা যায় সহজে এবং ধরে ফেলা যায় ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম ট্রাফিক আইন বিরুদ্ধ অপরাধও। এর জন্য প্রাইভেট কোম্পানি ‘ইস্ক্রা সিস্টেমি’ কে ৪৬টি রাডার বসানোর অনুমতি দেওয়া হয় যার মধ্যে ৩০টি অক্টোবর মাসের মধ্যে কার্যকারী ভাবে বসানো হয়েছিল। প্রথম কয়েকদিনের মধ্যেই ২৫ হাজারের বেশি অপরাধ ধরে ফেলা হয়। তবে সমস্যা আর আপত্তি কিসের?
এই অপরাধীদের জরিমানার ৯২% টাকা যায় ‘ইস্ক্রা সিস্টেমি’ নামক ব্যাবসায়ী দলের পকেটে আর মাত্র ৮% যায় শহরের মিউনিসিপালিটির কাছে। ক্যাংলার মহাশয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, এই মহাযজ্ঞ সারার খরচ হওয়ার কথা ছিল ৫ মিলিয়ন ইউরো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খরচ হয়ে দাঁড়ায় ৩০ মিলিয়ান ইউরো। ২৫ হাজার ধরা পড়া অপরাধের অধিকাংশই খুবই সামান্য সব অপরাধ বা আইন-বিচ্যুতি। গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের চাপে পড়ে সামান্য অপরাধে অভিযুক্ত অসংখ্য ড্রাইভারকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মারিবোরের জনতা বরাবরই এই স্পিড রাডার প্রযুক্তির বিরুদ্ধে ছিল। প্রথম এক সপ্তাহের মধ্যেই তারা ভেঙ্গে ফেলে দশ-দশটি রাডার, ক্ষতির পরিমান দাঁড়ায় ৩ লক্ষ ইউরো।
১৯৯৭ সাল থেকেই মারিবোরের মিউনিসিপ্যালিটি শহরের নিকাশি ব্যবস্থা থেকে শুরু করে, জল-ব্যবস্থা, গণপরিবহন ব্যবস্থা সমস্ত কিছুই বাণিজ্যিকীকরণ করে দিয়েছে। এর ফলে দুর্মূল্য হয়ে পড়েছে জীবনধারণ। দুর্নীতি বিরোধী মঞ্চের প্রধান ফাঁস করে দিয়েছে ক্যাংলারের বহু বেআইনি কার্যকলাপ। মারিবোরের মানুষেরা অবাক হয়নি তাতে, ক্ষোভে ফেটে পড়েছে তারা। স্লোভেনিয়ার অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পরেছে সেই ক্ষোভ। সকলেই ভীত যে মারিবোর অধিবাসীদের মত দশা না হয়!
২১ নভেম্বর মারিবোর টাউন হলে ন্যাশনাল কাউন্সিল নির্বাচনের জন্য ক্যাংলার উপস্থিত ছিলেন প্রার্থী হিসেবে। উনি ভোটে জিতে যাওয়ার খবর পেয়ে এক হাজার অহিংস প্রতিবাদী টাউন হলের সামনে গিয়ে ক্যাংলারকে ঘেরাও করে। ক্যাংলার তখন তাঁর বন্ধুকে ফোন করে পরিস্থিতির কথা জানালে সে জনা বারো বন্ধুর সাথে অকুস্থলে যায়। মুখোশ পরে ছিল তারা সকলে। সেখানে গিয়ে তারা প্রতিবাদীদের মধ্যে ঢুকে পরে ও টাউন হলে ঢোকার চেষ্টা করে। পুলিশ তাদের বাধা দেয় এবং সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়। ফ্র্যাঙ্ক ক্যাংলার এই সময়ে পুলিশের গাড়ি করে ওখান থেকে চলে যান। প্রতিবাদ মিছিল শুরু হওয়ার আগে ফেসবুকে ক্যাংলার বিরোধী একদল মানুষ অজানা সূত্রে খবর দেয় যে ক্যাংলার মহাশয় আন্দোলনের শান্তিভঙ্গ করার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র করছেন, অতএব আন্দোলনকারীদের সাবধানতা অবলম্বন করা ও পুলিশের সাথে কোনোরকম সংঘর্ষ এড়ানো দরকার। এই ঘটনার পরে স্লোভেনিয়ান পিপলস পার্টি ক্যাংলারকে দল থেকে বিতাড়িত করে। ক্যাংলার অবশ্য কোনোরকম স্বীকারোক্তি দেননি। তিনি পদত্যাগ করার কথাও ভাবেননি।
২৬ নভেম্বর তৃতীয়বার প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। ১০ হাজার মানুষ লিবার্টি স্কোয়ারে জড়ো হয়। ক্যাংলারের কুশপুতুল পোড়ানো, স্লোগান দেওয়া প্রভৃতির মাধ্যমে মোটের উপর শান্তিপূর্ণ ভাবেই শুরু হয় এই প্রতিবাদ সভা। কিন্তু সিটি মিউনিসিপালিটির প্রতিষ্ঠানের কাছে যাওয়ার সময় শুরু হয় সংঘর্ষ। এলাকাটিতে বহু পুলিশ মোতায়েন করা ছিল। ৩ ডিসেম্বর আবারও লিবার্টি স্কোয়ার থেকে শুরু হয় মিছিল। আবারো শান্তি বিঘ্নিত হয়। শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবাদ করছেন এমন মানুষদের উপরেও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া ও জোর করে আন্দোলন ভেঙ্গে দেওয়ার নানাবিধ চেষ্টার পাশাপাশি অসংখ্য মানুষের এমন প্রতিরোধ বহুদিন দেখেনি স্লোভানিয়া। আহত এবং গ্রেপ্তার হয়েছ বেশ কিছু মানুষ।
Leave a Reply