ভরত মানসাটা-র ইংরেজি রিপোর্টের প্রথম অংশের বঙ্গানুবাদ, ৮ মার্চ। সম্মেলনের রিপোর্টের দ্বিতীয় অংশের বঙ্গানুবাদ পরে প্রকাশিত হবে#
বিশ্বের বৃহত্তম জৈবচাষিদের মিলনমেলা — ভারতের বাইশটি জেলার ২৫০০ চাষি মিলিত হয়েছিল চণ্ডীগড়ের ‘জাতীয় জৈব সম্মেলন’-এ, ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ। সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য নাম নথিভুক্তকরণের হিড়িকের চোটে এক মাস আগেই রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। এই আবেগ ইঙ্গিত দিচ্ছে, চাষ-বাস্তুতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান স্বীকৃতি বর্তমান সময়ের একটি জ্বলন্ত আবশ্যকতা। কনভেনশনের লক্ষ্যও ছিল, ‘মূলধারায় জৈব চাষ’।
সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে ভারতের ‘সবুজ বিপ্লব’-এর সামনের সারিতে থাকা রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী শ্রী প্রকাশ সিং বাদল জৈব কৃষিকে ঊর্দ্ধে তুলে ধরে বললেন, এই চাষই ‘সময়ের প্রয়োজনীয়তা’, পরিহাসের মতো শোনালো, একটা বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ হল। তিনি দুঃখপ্রকাশ করে বললেন, রাসায়নিক বিষের বোঝার ভার বহন করতে হয়েছে পাঞ্জাবের ভূমি, চাষি এবং মানুষকে। দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করলেন, ‘ধরিত্রী মা, পিতা জল, এবং গুরু বাতাস’ — সবাই অপবিত্র হয়েছে। বিষাক্ত কীটনাশকগুলি পাঞ্জাবের স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করেছে। জৈব চাষি, বীজ রক্ষাকারী, ইকোলজিস্ট, বিজ্ঞানী এবং সমাজকর্মীদের ভিড়ে ঠাসা অডিটোরিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বাদল বললেন, ‘তোমাদের মতো মানুষরাই জাতিকে বাঁচানোর নয়া সংগ্রামের সত্যিকারের নায়ক’।
মুখ্যমন্ত্রী ডাক দিলেন, পাঞ্জাবকে ভারতের জৈব চাষের কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য, বললেন, বর্তমানের এক জমিতে একই ধরনের চাষের বদলে বিচিত্র ধরনের চাষের কথা। দেশি প্রজাতির গরুর প্রতিপালনের জন্য রাজ্য সরকার পঞ্চাশ শতাংশ ভর্তুকি দেবে, এমন ঘোষণাও করলেন। জৈব ফসল বা উপজাত দ্রব্য বিক্রিবাটার জন্য পাইকারি/খুচরো দোকান তৈরি করে দেওয়ার প্রস্তাব রাখলেন। ঘোষণা করলেন, একটি জৈব চাষ বোর্ড তৈরি করা হবে। জৈব চাষের প্রচারের জন্য প্রতিটি ব্লকে পঞ্চায়েতের জমিতে একটি করে জৈব চাষের খামার তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
কনভেনশনে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাত্তার তাঁর কৃষিমন্ত্রীকে সাথে নিয়ে প্রতিশ্রুতি দিলেন, রাজ্যের চাষযোগ্য জমির অন্তত দশ শতাংশকে জৈব চাষের আওতায় আনার ব্যাপারে রাজ্য সরকার সহযোগিতা করবে। কেন্দ্রের মন্ত্রী মানেকা গান্ধী হুঁশিয়ারি দিলেন অত্যন্ত ভয়ঙ্কর নিও-নিকোটিনয়েড কীটনাশক (যা জিনপ্রযুক্তির তুলো বীজের জন্য ব্যবহার হয়) ব্যবহারের বিরুদ্ধে, কারণ তা মৌমাছির মতো পরাগমিলনকারী প্রাণীকে হত্যা করে। এই কীটনাশকের ব্যবহারে প্রায় সত্তর শতাংশ পরাগমিলনকারী প্রাণী মুছে গেছে। এতে চাষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা, যদি না ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো এখানেও এটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করা হয়। মানেকা বললেন, ‘জিনপ্রযুক্তির তুলো মালিকরা আমাদের মিথ্যে কথা বলেছে, তারা বলেছিল এর জন্য কোনো কীটনাশক লাগবে না। … কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কীটনাশকটি না ব্যবহার করলে বিটি তুলো হচ্ছেই না।’
কয়েক বছর আগে, আইএএএসটিডি-র ‘বিশ্ব কৃষি রিপোর্ট’-এ রাখঢাক না করেই বলা হয়েছিল, ‘যেভাবে চলছে, সেভাবে চালানো আর সঙ্গত নয়।’ চার বছর ধরে চারশো আন্তর্জাতিক কৃষিবিজ্ঞানী/বিশেষজ্ঞদের বানানো এবং এক হাজার বিভিন্ন শাখার বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পর্যালোচনা করা এই রিপোর্টটি মেনে নেয় ৫৮টি জাতিরাষ্ট্র, যার মধ্যে ভারত অন্যতম। এছাড়া বিশ্ব ব্যাঙ্ক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউএনইপি, ইউএনডিপি, এফএও — এরা সবাই মেনে নেয়। এই রিপোর্টে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, যাতে জৈব-বৈচিত্র্যময় কৃষি-বাস্তুতান্ত্রিক চাষের দিকে সরে আসা হয় দ্রুত, যাতে ছোটো পারিবারিক খামারকে উৎসাহ দেওয়া হয় — সারা বিশ্বে চাষাবাদ যে সমস্যায় পড়েছে, তার থেকে মুক্তির রাস্তা এটাই। জিনপ্রযুক্তির শস্য ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধান নয়, এমনকী বাস্তুতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক এবং শক্তিগত সমস্যাগুলিরও সমাধান নয় — এমনটাই বলেছিল এই রিপোর্ট।
বিচিত্র রঙ, বিচিত্র পরিধান, বিচিত্র সংস্কৃতি এবং বিচিত্র রান্নাবান্নার সমারোহে অভ্যাগতদের বরণ করা হয়েছিল চ্ছ্রপ্রকৃতি ও কিষান মেলা’, চ্ছ্রজৈব খাদ্য উৎসব’, এবং চ্ছ্রজৈববৈচিত্র উৎসব’-এ, যা জাতীয় জৈব কনভেনশনের পাশাপাশিই চলছিল। জৈব খাদ্য উৎসব এবং বিভিন্ন রাজ্যের নিজস্ব জৈব মেলা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। জৈব বৈচিত্র্য উৎসবে প্রদর্শিত হল ২০০০ স্বতন্ত্র বীজ, যা এখানে নিয়ে এসেছিল ২৭০ জন বীজ-সংরক্ষক চাষি, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। আধ ডজন নতুন বই প্রকাশ হল। অনেক বইয়ের দোকান, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গান এবং নাচে আকর্ষণ বেড়েছিল স্মরণযোগ্য এই জৈব মেলার। মাঝে ঝড় বৃষ্টিতে একটু ঝুলেছিল অনুষ্ঠান।
এই কনভেনশন যৌথভাবে আয়োজন করেছিল অর্গানিক ফার্মিং অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া (ওএফএআই), অ্যালায়েন্স ফর সাসটেনেবল অ্যান্ড হোলিস্টিক এগ্রিকালচার (এএসএইচএ), এবং খেতি বিরাসাত মিশন। সঙ্গে ছিল স্থানীয় প্রতিষ্ঠান, ন্যাশনাল ইনসটিটিউট অব টেকনিকাল টিচার্স ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ (এনআইটিটিটিআর), যেখানে কনভেনশনটি অনুষ্ঠিত হল। বক্তব্য ছিল দুটি ভাষায় — হিন্দি এবং ইংরেজিতে। বক্তব্য ভাষান্তর করে দেওয়া হচ্ছিল। অন্যান্য ভাষায় ভাষান্তরের কাজগুলো শ্রোতাদের মধ্যে থেকে বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিরা নিজেরাই করে নিচ্ছিল, সেই রাজ্যের যারা ইংরেজি বা হিন্দি বোঝেন না তাদের জন্য।
Leave a Reply