বিশ্ব নাট্যদিবসের প্রাক্কালে এবারও ২৭ মার্চ পৃথিবীর নানা দেশে নানা স্থানে নাট্যমেলা বসেছে। মিলিত হয়েছে নাট্যপ্রাণ। ইউনেস্কোর সদর দফতর প্যারিসের আকাশ ভেদ করে এবারে মার্কিন প্রযোজক ও নির্দেশক জন মানকোভিচের বার্তা ‘আপনাদের কাজ আরও উদ্ভাবনী ও সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠুক। হোক আরও বিস্তীর্ণ, সুগভীর, বোধময় ও মননশীল। মানুষ হওয়া মানে কী — এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাহায্য করুক আপনাদের কাজ। এই অনুসন্ধান চলুক হৃদয় দিয়ে মনন দিয়ে। আপনারা সকল প্রতিকূলতা, বিপন্নতা, দারিদ্র্য ও নৈরাজ্যবাদকে জয় করুন। আপনাদের সেরাটা দিয়ে জীবনের এই মৌলিক প্রশ্নটার উত্তর খুঁজুন।’
এই স্বর ছুঁয়ে গেল শান্তিপুরের বাতাসও। শান্তিপুর সাংস্কৃতিক সংস্থা বাংলার নাট্য মানচিত্রে উজ্জ্বল আলোকের মতো। সারা বছরে তাদের নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে নাট্যদিবসে নাট্য কোজাগরি এরকমই এক কর্মকাণ্ড। এবারের অনুষ্ঠানসূচি বা ফোল্ডারের প্রারম্ভিক কথনে সুজন দর্শক সুজাতা গোস্বামীর অনুভব ধরা পড়ে শব্দচয়নের পরতে পরতে।
ভোর সাড়ে সাতটায় নাটকের জন্যে পথচলা। কচিকাঁচা থেকে বড়োরাও হাঁটলেন। মুখোশে পোশাকে গানে আর কবিতায় রঙিন হয়ে উঠল ভোরবেলার শান্তিপুরের জনপদ। রাত আটটা। বিশ্বনাথ দাস ও সম্প্রদায় ঢাকের তালে উৎসবের সূচনায় মনের মধ্যে ধরা দিল প্রাচীন রীতির ধারা। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে, আকাশ বাতাস মাটি স্পর্শ করে, ঢাক কাঁসরের ছন্দময় তালে বলে উঠলাম, হে প্রকৃতি, তোমাকে প্রণাম। তোমার কার্পণ্যহীন নিঃস্বার্থ চলায় আমাদের শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমাদের সকলের শ্রমে মননে গড়ে ওঠা এই শিল্প অর্ঘ তোমাকে অর্পণ করলাম। এসো আমরা বিনিদ্র থাকি সারা রাত।
রাত আটটা তিরিশ। সেই অমোঘ সত্যের উচ্চারণ। বাণী পাঠ করলেন শ্রী কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। এরপর মঞ্চে উপস্থিত বহুরূপীর অভিনেতা শ্রী দেবতোষ ঘোষ, শান্তিপুর পাবলিক লাইব্রেরির প্রশাসক শ্রী সোমনাথ কর এবং যারা সংবর্ধিত হবেন সেই শ্রী রণজিৎ চক্রবর্তী ও শ্রী শিবুপদ দেবনাথ। একজন সফল মঞ্চ-স্থপতি এবং অপর জন পরিবেশবন্ধু। এদের সম্মান জানিয়ে শান্তিপুরের সংস্কৃতিকে গর্বিত করেছে সাংস্কৃতিক। এরপর সুদূর ঝাড়গ্রাম আর্ট একাডেমির পুতুলনাটক — কাবুলিওয়ালা, কলকাতার শিল্পভূমি প্রযোজিত একক প্রযোজনা — রুদ্ধ শৈশব, নাটকের গানে অম্বরীশ ভট্টাচার্য। তারপর ফের পুতুলনাটক, তোতাকাহিনী। তারপর নাটক, উলটে দেখুন পালটে গেছি। প্রযোজনা থিয়েটার অঙ্গন, কৃষ্ণনগর। রাত একটা চল্লিশে শান্তিপুর রাগিনীর বৃন্দবাদন। তারপর শ্রী রণেন চক্রবর্তীর মূকাভিনয়। তারপর বহরমপুর ঋত্বিক প্রযোজিত নাটক, কুসুমকথা। ভোর চারটে কুড়িতে কবি ও চিত্রকরদের স্মারক প্রদান। তারপর ভোরের গানে সুভাষ দে। তারপর আবিরে পলাশে আর ভোরবেলাকার আলতো আলোর আবেশ নিয়ে ঘরে ফেরা।
পরিশেষে যে কথাগুলি বলার। নাট্যকোজাগরিতে লাইব্রেরি প্রেক্ষাগৃহে সমগ্র অনুষ্ঠানের সাজসজ্জায় বড়ো ভালোবাসার উষ্ণতা পাওয়া যায়। স্মারক আলোকদণ্ডে লেগে থাকে আন্তরিকতার ছোঁয়া। চলমান প্রত্যেক অনুষ্ঠানের শেষে কবিদের কবিতা ও চিত্রকরদের চিত্র ল্যামিনেশন সহ শিল্পীর হাতে তুলে দেওয়া এক অনন্য প্রয়াস। সমগ্র অনুষ্ঠানের মধ্যে যেমন অম্বরীশ ভট্টাচার্যের নাটকের গান আর শান্তিপুর রাগিনীর বৃন্দবাদন ও সুভাষ দের ভোরের গানে মন ভরে ওঠে, ঠিক তেমনভাবেই নিরাশ হই দুটি পুতুল নাটক ও তিনটি মঞ্চনাটক দেখে। বিশ্ব নাট্যদিবসে নাটকের মান যদি মনকে নাড়া না দেয়, হৃদয়ে সাড়া না জাগায়, তাহলে নিজের কাছেই প্রশ্ন জাগে। সাংস্কৃতিকের সকলের কাছেই আশা করব, আগামীদিনে সারা রাতের নাট্য প্রদর্শনের বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আরও যত্নবান হবে।
সবশেষে, ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত। চাঁদ উঠুক না উঠুক আজ নাট্য কোজাগরি। ধন্য সাংস্কৃতিকের সব্বাই। ধন্য শান্তিপুর।
শমিত বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিপুর, ১ মে
Leave a Reply