দীপঙ্কর সরকার, ঢাকুরিয়া ইস্ট রোড, হালতু#
পশ্চিমবঙ্গ ভারতবর্ষের এমনই একটি রাজ্য যেখানে পর্যটন শিল্প ও স্থানীয় হস্তশিল্পের প্রসারের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত দিকনির্দেশ, যোগাযোগের পরিকাঠামো, কোথায় কোন শিল্পের অবস্থান ও পরিচিতি এসব না থাকায় তা আজও অধিকাংশের কাছেই অধরা থেকে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের উৎসাহী হাতে গোনা কিছু পর্যটক ও শিল্পবোধসম্পন্ন মানুষ ব্যতীত বিভিন্ন জেলায় সহজে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা কারিগরি হস্তশিল্পগুলির কোনো প্রচার নেই সাধারণের মধ্যে। আবার কিছু কিছু সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী পশ্চিমবঙ্গের এই হস্তশিল্পগুলিকে চড়া মূল্যে বেচে চলেছে অন্যত্র ভিন্ন নামে। আমরা কজনই বা জানি বর্ধমানের নতুনগ্রামের কাঠের খেলনা কথা, কোচবিহারের ঘুঘুমারীর শীতলপাটি, বর্ধমানের দরিয়াপুরের ডোকরা আর বীরভূমের নানুরের কাঁথাস্টিচের কথা? আমরা কি জানি বাঁকুড়ার বিকনার ডোকরা, দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমান্ডির কাঠের মুখোশ, বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ার টেরাকোটা, নদীয়ার ঘুর্ণীর মাটির পুতুল, পুরুলিয়ার চড়িদার মুখোশ, পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার পটচিত্র, পূর্ব মেদিনীপুরের বড়ো বাসুদেবপুরের মাদুর শিল্পের খুঁটিনাটি? এগুলির যেমন নেই কোনো প্রচার, তেমনি সাধারণের হাতে পৌঁছে দেবার মতো বাজারের পরিকাঠামোও নেই।
হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলার সুপ্রাচীন টেরাকোটা শিল্প। যে শিল্প একদা পৃথিবীখ্যাত হয়েছিল তা আজ যেমন অবহেলিত, তেমনি তার নামে চলছে অনৈতিক ব্যবসাও। বাংলার বহু মন্দির-গাত্রে টেরাকোটার শিল্পসুষমা আজও সবর্ত্র সমাদৃত। অথচ সেই সমস্ত টেরাকোটা শিল্পের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ইতিহাসখ্যাত মন্দির স্থাপত্যগুলির ভগ্নদশা আমাদের পীড়া দেয়। ইতিহাস বিস্মৃত বঙ্গভূমির এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিষ্ণুপুর, আটপুর, বাঁশবেড়িয়া, গুপ্তিপাড়া, কালনা ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে নিভৃতে দাঁড়িয়ে থাকা টেরাকোটার মন্দিরগুলি আজও আমাদের মনে শিহরণ জাগায়। আমরা আজ এইরকম একটি টেরাকোটার মন্দির কোতলপুরের রাজরাজেশ্বরের কথা বলব।
হাওড়া থেকে রাজা বলহাটের বাসে অথবা হরিপাল স্টেশন হয়ে বড়গাছিয়ার বাসে সীতাপুর বাজারে নামতে হবে। সেখান থেকে গ্রামীণ পথে শিবতলার দিকে এগিয়ে দশ মিনিট হাঁটাপথে একটু ভিতরের দিকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে লোকালয়ের আড়ালে একাকী দাঁড়িয়ে রাজরাজেশ্বরের মন্দির। ১৬৯৪ সাল থেকে এই মন্দির আজ বহু ইতিহাসের সাক্ষী। আগাছায় মন্দিরের নিচের অংশ ঢাকা পড়ে আছে। এই মন্দিরের গায়ে শকুনের প্রতিকৃতি আছে, যা দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসাবে আমরা কেউ কেউ মেনে থাকি। মন্দিরের একটি প্যানেলে দেখা যায় শকুন একটা শবদেহ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।
ওপরের দুটি প্যানেলে কালী ও দুর্গার রূপ বর্ণিত আছে। কালী এখানে কাপড় পরিহিতা, যা অপ্রচলিত। এই আটচালা মন্দিরটি রাজ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগ অধিগ্রহণ করেছে যা ভগ্নপ্রায় ও অবলুপ্তির পথে। মন্দিরের ছাদে ও পার্শ্ব গাত্রে অশ্বত্থ ও বটগাছ গজিয়ে উঠেছে। ফাটল ধরেছে বহু জায়গায়। মন্দিরের তিনটি প্রবেশপথ থাকলেও অবস্থা এমন, সেখানে প্রবেশ করা যায় না। মন্দিরের ভিতর এখন কোনো বিগ্রহ নেই। মন্দিরে সামনে বহু কষ্টেই যেতে হয়। মন্দিরের সামনে থেকে টেরাকোটা করা অংশ এখনও ভালোভাবে দেখা যায়। মন্দিরের গাত্রে কোনো ফলক নেই যা দেখে এর প্রতিষ্ঠাতার নাম জানা যায়। ঐতিহাসিক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য তাঁর রচিত হুগলী জেলার পুরাকীর্তি বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে ১৬৯৪ সাল নাগাদ এটি নির্মিত হয়েছে। তবে তিনি প্রতিষ্ঠাতার নাম বলতে পারেননি। মন্দিরের উপরের খিলানে চিত্রিত আছে রামায়ণের কাহিনী, যেখানে রাম ও লক্ষণ রাবণ ও কুম্ভকর্ণের সাথে যুদ্ধ করছে। একটি চিত্রশোভিত চক্র প্যানেলের শিল্প সুষমাকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। মূল প্যানেলে চিত্রিত আছে কৃষ্ণের জীবনলীলা, রাজকীয় শোভাযাত্রা, জাহাজ ও নৌকা।
এই রাজরাজেশ্বরের মন্দিরের ঠিক পাশেই সমরূপী ও সমদর্শী আর একটি মন্দির ছিল ডানদিকে, সেটি তৈরি হয়েছিল ১৭৭৪ সালে। যেটি এখন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত। তার বদলে তৈরি হয়েছে আধুনিক শিবমন্দির। যা একেবারে বিপরীত ভাবধারার। আগামী প্রজন্ম আর কোনোদিনই সেই মন্দিরশৈলী দেখতে পাবে না।
অবিলম্বে রাজ্যপুরাতত্ত্বের পর্যবেক্ষকদের ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের কাছে এই ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজরাজেশ্বরের মন্দিরটির সংরক্ষণে সক্রিয় হবার জন্য আমি আবেদন জানাচ্ছি। বাংলার প্রাচীন টেরাকোটা শিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শনের সাক্ষী হয়ে আছে এই মন্দিরটি। হুগলীর জাঙ্গীপাড়ার কোতলপুরের এই মন্দিরটির শিল্প ঐতিহ্যকে আগামী প্রজন্মের জন্য আমাদের বাঁচাতেই হবে।
Leave a Reply