দিল্লির গণধর্ষণ কাণ্ডের পর রাষ্ট্রের তরফে বিভিন্ন ধরণের সক্রিয়তার কথা দাবি আকারে উঠে আসছে। সাংসদরা চব্বিশ ঘন্টা সিসিটিভি, পুলিশি নজরদারি থেকে শুরু করে ধর্ষকের দ্রুত বিচার করে ফাঁসি দিয়ে দেওয়ার দাবি তুলেছে। বিভিন্ন তরফে শোনা গেছে কেমিক্যাল কাস্ট্রেশন, যাবজ্জীবন জেল প্রভৃতি হরেক রকম হিংসাত্মক সাজার কথা। রাষ্ট্রীয় এই সাজাগুলি কোনওটিই হয়ত ধর্ষণের তুলনায় কম হিংসাত্মক নয়। কিন্তু এসবের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র তথা সমাজ কীভাবে মেয়েদের রক্ষা করবে সেইসব কথাই আসছে ফিরে, যেমন আগে বলা হত, বা এখনও কোথাও কোথাও বলা হয়ে থাকে, মেয়েরা বাইরে না বেরোনোই ভালো। কিন্তু মেয়েরা কী নিজেরাই যৌন হিংসা প্রতিরোধের কথা ভাবতে পারে না? আয়েষার সঙ্গে কথা, ২৩ ডিসেম্বর#
সংবাদমন্থন : আপনি মেয়েদের স্বাবলম্বন নিয়ে কাজ করছেন। দিল্লির সাম্প্রতিক ধর্ষণের ঘটনার পর অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার কথা উঠছে চারদিক থেকে। আপনার কী মনে হয়?
আয়েষা : ঠিকই এই ধরনের অপরাধ বন্ধ করা উচিত। কিন্তু হিংসার চক্রটাকে তো আমরা কোনো না কোনোভাবে জারি রাখছি। কঠোরতম শাস্তি মানে ফাঁসি বা সারা জীবন বন্দি করে রাখা হল … আসলে শাস্তি কী হওয়া উচিত, যখন আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি, আমাদের মধ্যে এটা খুব স্পষ্ট নয়। লোকের মাথায় যাতে জিনিসটা থাকে এরকম কিছু নিশ্চয় হওয়া উচিত। সেটা স্বল্পকালীন ব্যাপার। তাতে এখনই হয়তো একটা কিছু হল। কিন্তু দীর্ঘকালীন ভাবে দেখতে গেলে, তার চেয়ে বরং অন্য ধরনের উদ্যোগ অনেক বেশিরকম হওয়া দরকার। একদিকে মেয়েদের মধ্যে সক্ষমতার দিকগুলো গড়ে তোলা; অন্যদিকে ছেলেদের কাছেও প্রশ্ন তোলা, সত্যিই সে ক্ষমতার এই ধরনের প্রকাশটাকেই দেখতে চায় কিনা। যৌনতার রূপ যেটা সে এযাবৎ দেখে এসেছে, সেটাকেও প্রশ্ন করা। এটা কি সত্যিই যৌনতার প্রকাশ নাকি যেখানে সত্যি সত্যি একটা সমতা আছে, যেখানে দুটো মানুষ একইরকম ভাবে চাইছে সেটাই কাম্য?
সংবাদমন্থন : মেয়েদের এই সক্ষমতা গড়ে তোলা যায় কীভাবে?
আয়েষা : যৌন-হিংসা প্রতিরোধের জন্য আমরা যে কাজটা করছি, তা হল, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ বা ট্রেনিং। আমরা একটা পাঠক্রম তৈরি করছি। গত বেশ কিছু বছর যাবৎ আমরা ‘তালাশ’-এর পক্ষ থেকে যে কাজটা করছি তা হল — এই পাঠক্রমগুলোর মূল লক্ষ্য যেটা — এক ধরনের দক্ষতা তৈরি করা। আমরা দেখি যে চারপাশে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। সমস্যাগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য একজন মেয়ের মধ্যে যে দক্ষতা তৈরি করা দরকার, সেই ধরনের কোনো প্রচেষ্টা সাধারণভাবে চোখে পড়ে না। এই জিনিসটার ওপর আমরা গত কিছু বছর ধরে কলকাতা ও মালদহের দশটা সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলের সঙ্গে কাজ করছি। সেখানে আমাদের কাছে বারবার যে চিত্রটা বেরিয়ে আসছে, সেটা হচ্ছে যে বিচ্ছিন্নভাবে কখনো কখনো এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, মার্শাল আর্ট ট্রেনিং করানো হচ্ছে। এটা ঠিকই মার্শাল আর্ট ট্রেনিং, তার পাশাপাশি নানা ধরনের শরীর চর্চা এবং নানা ধরনের খেলাধুলায় মেয়েরা যোগ দিতে পারছে, সেটা শরীর চর্চার দিক থেকে খুবই জরুরি একটা দিক। কিন্তু তার পাশাপাশি যে জিনিসটা দরকার বলে আমাদের বিশেষভাবে মনে হয়, সেটা হচ্ছে, একটা মেয়েকে ছোটোবেলা থেকে সামাজিকভাবে যেরকম করে গড়ে তোলা হয়, তাতে সে নিজেকে নানা পরিবেশের শিকার (ভিক্টিম) বলে ভাবতে শুরু করে। সমাজে এই ধারণাটা রয়েছে। সেই জায়গাটাকে আমরা বিশেষভাবে মোকাবিলা করা জরুরি বলে মনে করি। আমরা যে ধরনের পাঠক্রম গড়ে তুলছি, তার মধ্যে একটা দিক রয়েছে সে বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতিতে মেয়েটি কীভাবে মোকাবিলা করতে পারছে, শারীরিক, মানসিক, এমনকী যে কোনো আবেগ বা অনুভূতিজনিত সমস্যাকেও সে কীভাবে মোকাবিলা করতে পারছে সেই জায়গাগুলোয় দক্ষতা তৈরি করা। তার পাশাপাশি, তার যে মানসিকতা বা সাইকি যা তাকে এইভাবে নিজেকে ভিক্টিম হিসেবে দেখতে শিখেছে এবং কোথাও একটা তার অসহায়তা আছে, যার ফলে সে সবসময় ভাবে, আমাকে কেউ একটা বাঁচাবে, যে কোনো পরিস্থিতিতে আটকা পড়ে গেলে কেউ একটা আমাকে বাঁচাবে, তবেই আমি সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারব। এই জায়গাটাতে কাজ করা যাতে এই মানসিকতা বা সাইকির একটা বদল ঘটতে পারে। কীভাবে? ভয়কে সে কী করে পাল্টে নিতে পারে যাতে — আমার ভয় করছে — সেই ভয় তাকে কাবু না করে দিয়ে, কাহিল না করে দিয়ে — যেখানে সে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে — সেই জায়গাটাকে যাতে সে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। সেই ভয় করার পরিস্থিতিটাকে, আমি একটা সচেতনতার জায়গায় নিয়ে যেতে পারি — ঠিক আছে, আমি ভয় পাচ্ছি, সাথে সাথে আমাকে কিছু করতে হবে পালানোর জন্য নয়তো পরিস্থিতিটাকে মোকাবিলা করার জন্য — এই ভাবনাগুলো যাতে তার মধ্যে তৈরি হয়। তার পাশাপাশি, বিভিন্ন পরিস্থিতিকে যে আসলে মোকাবিলা করা সম্ভব, এমন কোনো পরিস্থিতি যে আসলে হয়ই না যার সমাধান নেই, যে কোনো সমস্যার সঙ্গে যে একটা সমাধান লুকিয়ে আছে, আমার মানসিক স্থিতির কারণে আমি বন্দি বা আটকা হিসেবে পরিস্থিতিটাকে দেখছি, যেটাকে আসলে বদলে ফেলা সম্ভব, সেগুলো নানা ধরনের অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে গড়ে তোলা যাতে করে সে যে কোনো সমস্যাকে কীভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব, সেটা সে দেখতে দেখতে শিখতে শিখতে চলবে। যাতে করে তার মধ্যে সেই সক্ষমতা তৈরি হবে যে, হ্যাঁ এটা করা সম্ভব। আপাতদৃষ্টিতে যত কঠিনই পরিস্থিতি হোক না কেন, পরিস্থিতির মধ্যে কোনো না কোনো কিছু করার আমার রয়েছেই।
এই ট্রেনিংগুলোর দুটো দিক আছে। একদিকে সেই মেয়েটির মধ্যে এককভাবে একটা দক্ষতা বা সক্ষমতা তৈরির কাজ করা। আর একদিকে একটা বন্ধুত্ব তৈরি করা যাতে মেয়েরা অন্য সমবয়সি মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে পারে। সাধারণভাবে আমি যদি কোনো যৌন হিংসার শিকার হই, এমনকী আমার অন্তরঙ্গ সম্পর্কের মধ্যেও বা পরিচিত চেনাজানা থেকে শুরু করে অপরিচিতিদের মাঝেও রাস্তাঘাটে আমি নিয়মিত কোনো সমস্যার মধ্যে পড়ছি, ব্যক্তিগত সমস্যা হিসেবে এটাকে দেখার একটা সামাজিক রেওয়াজ আছে। ব্যক্তিগত বলেই কারো কাছে আমি যে সাহায্য চাইব, সেই জায়গাটা আমি করতে পারছি না। এখানে দুটো জিনিস করা। একদিকে সাহায্য চাওয়ার মধ্যে, যদি আমার প্রতি ঘটনাটা ঘটে তার লজ্জা বা দায় যে কেবল আমার নয়, ঘটনাটা যে ঘটাচ্ছে দায়টা যে তার, সেই জায়গাটা বারবার জানানোর মধ্যে দিয়ে গড়ে তোলা। দ্বিতীয়ত, এই মেয়েদের মধ্যে সেই সক্ষমতা গড়ে তোলা যাতে ও ওর সমবয়সি বন্ধুদের পাশে দাঁড়াতে পারে, তার যদি কোনো সমস্যা হয়, প্রথমত সে শ্রোতার ভূমিকা পালন করতে পারে। সবচেয়ে বড়ো কথা, ছোটোরা, বিশেষত কিশোরীরা তার সমবয়সিদের কাছেই তার সমস্যা শেয়ার করতে ভালোবাসে। বড়োদের কাছে সাধারণত যেতে চায় না। আমাদের মতো লোকেদের কাছে কখন আসে? যখন একটা ভরসার জায়গা তৈরি হয়। সাধারণত সমবয়সিদের কাছেই আসে। সমবয়সিদের মধ্যে সেই দক্ষতাটা তৈরি করা যেখানে ওর কথা তারা শুনতে পারে, প্রয়োজনে ওকে সাহায্য করতে পারে। আমরা বারবার আমাদের প্রশিক্ষণের একটা পদ্ধতি, নিরাপদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতির ওপর জোর দিই। যেখানে ও নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেখানে আমরা এখানটায় জোর দিই যে ও নিজে যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা ওর পক্ষে নিরাপদ নাও হতে পারে। কিন্তু ও জানবে যে তার ঝুঁকিগুলো কী আছে, তাতে ওর কোনো বিপদ ঘটছে কিনা, তাহলে ও ভাববে যে আমি কার কার কাছ থেকে কী ধরনের সাহায্য নিতে পারব। সেই প্রক্রিয়াটা ওর বন্ধুর সাথে নিতে পারছে কিনা যাতে সেই দক্ষতা ওর মধ্যে গড়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত যখন সে দেখছে যে পরিস্থিতিটা সিরিয়াস, যদি কোনোরকম পেশাগত সহায়তা (প্রফেশনাল সাপোর্ট) দরকার হয়, হতে পারে সেটা কাউন্সেলিং সাপোর্ট, হতে পারে সেটা ডাক্তারি সাপোর্ট, নানা কিছুই সেটা হতে পারে, সেখানে সে যাতে বড়োদের কাছে যেতে পারে, সেই দক্ষতাটা এই মেয়েদের দলগুলোর মধ্যে গড়ে তোলা। আমাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত আমরা ৫২ জন মেয়ের মধ্যে এই প্রক্রিয়াটা তৈরি করতে পেরেছি। সমবয়সিদের মধ্যে এবং নিজের পাড়াপড়শির মধ্যে সে এই কাজগুলো করে যেতে পারছে। আমরা যাদের মধ্যে কাজ করছি, সেই মেয়েদের মধ্যে এই সক্ষমতা তৈরি করার চেষ্টা করছি। সেই সক্ষমতার জায়গাগুলো এটাই — একদিকে যেখানে সে আগে থেকে টের পাচ্ছে, ওর মধ্যে সেই বোধ তৈরি করা। আমি যদি একটা ফাঁকা রাস্তা দিয়ে যাই, আমাকে যদি কেউ একটা লিফ্ট দেওয়ার কথা বলে, আমি সেটা গ্রহণ করব কি করব না, আমার ইনটিউশন কী বলছে, আমি ওখান দিয়ে গেলে আমার যদি কোনো বিপদ হয়, আমি কোনো সাপোর্ট পাব কিনা — এককথায় বলতে গেলে এই প্রশিক্ষণগুলোর কেন্দ্রীয় জিনিসটা হল, আমার জীবনের ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ কীভাবে বজায় রাখতে পারি। সেটা নানাভাবে হতে পারে। নিরাপদ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে, সাহায্য চাওয়ার ক্ষমতা তৈরি করার মধ্যে দিয়ে, সামগ্রিকভাবে আমার মানসিকতা বদলের মধ্য দিয়ে এবং নানাবিধ শারীরিক চর্চা যেটা আমাকে শারীরিক আক্রমণ মোকাবিলা করতে সাহায্য করছে, তার মধ্যে দিয়ে এটা হতে পারে। তার পাশাপাশি আমরা মিডিয়াতে সারাক্ষণই দেখছি, একজন মেয়েকে আক্রমণ করল, আসলে ও কী করতে পারত, সেই করতে পারার ছবিটা ওর মনের মধ্যে তৈরি করা। সাধারণত আমি ধরেই নিই যে আমার কিছু করার নেই। কিন্তু সেই খারাপ থেকে খারাপতর পরিস্থিতিতেও আসলে আমার কিছু করার আছে। আমি নানারকম কৌশল নিতে পারি যেটা আমি হয়তো এখানে বসে ভাবতেও পারছি না। কিন্তু করা যায় এই বিশ্বাসটা নিজের মধ্যে তৈরি করা, সেগুলো বারবার চর্চা করার মধ্য দিয়ে এই জায়গাটা তৈরি করা যে আমি পারব।
সংবাদমন্থন : মেয়েদের ছোটো পশাক পরা, রাতেরবেলায় বেরোনো, যেখানে-সেখানে যাওয়া নিয়ে কথা ওঠে …
আয়েষা : এগুলো তো অজুহাত। এক ধরনের বোকাবোকা অকার্যকর কথাবার্তা। এত বছর ধরে এগুলো লোকে ব্যবহার করে এসেছে, আজকেও যদি আমরা এগুলোকেই তুলে ধরি তো কোনো মানেই হয় না। আমার যদি ইচ্ছে করে আমি চলাফেরা করব না? আমি তো একটা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। তার পাশাপাশি এটাও ঠিক যে আমি যদি রাত্রিবেলা একটা পানশালা থেকে বেরোই, আমার কিছু সম্ভাব্য জিনিসও ভেবে রাখা দরকার। আমি জানি পরিস্থিতিটা কীরকম, সেখানে আমি কীরকম যানবাহন ব্যবহার করছি, কীরকম লোকজনকে আমি চারপাশে সাহায্যের জন্য পাব, কাদের সাহায্য আমি চাইলে পাব, সেই জায়গাগুলো তৈরি করার দরকার আছে বলে মনে হয়। চারপাশে সারাদিন কি মেয়েরা খোলামেলা পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়? আর খোলামেলা পোশাক পরলেই বা অন্য লোকের তাতে কী অধিকার আছে যে তাকে হেনস্থা করবে? যখন একজন পুরুষ খোলামেলা পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়, তখন কি লোকে সেই জিনিসটা ভাবতে পারে? ক্ষমতার এই ব্যবহারকে প্রশ্ন করার দরকার আছে। এইগুলো কি আমি চাই?
Leave a Reply