কুডানকুলাম পরমাণু প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা উদয়কুমারের ১০ জুন পাঠানো এই চিঠি ডায়ানিউক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়, এখানে তার বাংলা প্রকাশ করা হলো — সম্পাদক#
পটভূমিকা
ভিকি নানজাপ্পা নামে একজন ৯ জুন রেডিফ ডট কমে একটা প্রবন্ধ লেখেন, ‘ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ সরকারকে সতর্ক করল ‘ দুরভিসন্ধিমূলক’ এনজিও-গুলি থেকে’ নামে। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ বা আইবি-র গোপন নথি থেকে নেওয়া মূল বক্তব্য এরকম :
‘ এই দেশের সক্রিয় ৮৫ হাজার এনজিও-র মধ্যে অনেকগুলিই বিদেশি টাকায় বিভিন্ন ‘ দুরভিসন্ধিমূলক’ কার্যকলাপ চালায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন আটকে দেওয়ার জন্য। সম্প্রতি আইবি-র রিপোর্টে এই অভিযোগ জানানো হয়েছে।’
‘ এক এনজিও সবচেয়ে বেশি বাধা দিয়েছে কুডানকুলাম পরমাণু প্রকল্পে। ওখানে যে প্রতিবাদ হয়েছে তা অনেক ইন্টেলিজেন্স সংস্থাকে ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিল। আইবি সে সময় সরকারকে জানিয়েছিল, একটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এনজিও এই প্রতিবাদ সংগঠিত করায় অভিযুক্ত। যদিও ইউপিএ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক একটা বিবৃতি দিয়েছিল এই মর্মে, আর কিছু করেনি। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর, আইবি ফের এই ব্যাপারটা তুলছে এবং এই এনজিও-গুলির বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থার দাবি জানাচ্ছে।’
‘ এই এনজিও-গুলি আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি ও অন্যান্য দেশ থেকে ফান্ড নিয়ে দেশের উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলিতে গণ্ডগোল পাকায়।’
‘ আগে এই এনজিও-গুলো জাতপাত, ধর্ম এবং মানবাধিকারের ভিত্তিতে ভাঙন ধরিয়েছিল। আজ তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রতিবাদ সংগঠিত করে বড়ো বড়ো প্রকল্পগুলি আটকে দেওয়ার জন্য।
‘ এই এনজিওগুলি কিছু ইউনিয়নের সঙ্গে মিলে কাজ করে এবং সেগুলিকে টাকা দিয়ে প্রতিবাদ সংগঠিত করে।’
‘ এই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ধর্মান্তরকরণের একটি বিশাল র্যাকেট কাজ করছে এবং বিপুল অর্থ বিদেশ থেকে আসছে এই এনজিও-গুলোর মাধ্যমে মানুষকে ধর্মান্তরকরণে আকৃষ্ট করার জন্য।’
‘ এই বিষয়গুলো সামাজিক বিভাজন তৈরি করছে, যার ফলে নিরন্তর ঝামেলা থাকছে যা মারপিট প্রবণ অঞ্চলের বৃদ্ধির জন্য খারাপ।’
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সহকারী সম্পাদক প্রিয়দর্শী সিদ্ধান্ত দিল্লি থেকে আমাকে ইমেল করে বলেন, আমরা ভারত সরকারের একটি এজেন্সির কাছ থেকে একটি রিপোর্ট হাতে পেয়েছি যাতে পরমাণু বিরোধী প্রতিবাদে আপনার ভূমিকা বিষয়ে আলোচনা করেছে। আমরা রিপোর্টের নিম্নলিখিত দুটি অংশের ওপর বিশেষ করে আপনার মতামত জানতে চাইছি।
১) ‘ উদয়কুমার সম্পর্কে একটা অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, তার আমেরিকা ও জার্মানির সঙ্গে গভীর ও ক্রমবর্ধমান যোগাযোগের কথা। ২০১০ সালের জুলাই মাসে উদয়কুমার ‘ কিরওয়ান ইন্সটিটিউট অব স্টাডি অব রেস অ্যান্ড এথনিসিটি’-র কাছ থেকে না চাইতেই একটি দায়িত্ব পান — আমেরিকার ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটি-তে গোষ্ঠী, জাত, শ্রেণী এবং গণতন্ত্রের ওপর এনজিও-গুলির পরামর্শদাতার। তাকে ২০১১-র জুন মাস পর্যন্ত ২১,১২০ ডলার দেয় সংস্থাটি, তার আমেরিকার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। এছাড়া তাকে ২০১২ সালের এপ্রিল অবধি আরও ১৭,৬০০ ডলার দেওয়ার কথা হয়, একটি করে পাক্ষিক রিপোর্টের বিনিময়ে।’
২) ‘ … উদয়কুমারের জার্মানিতে যোগাযোগের সূত্রে ধরেই আসা এক জার্মান, সনটাগ রাইনার হেরম্যান-কে ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি চেন্নাই থেকে ভাগিয়ে দেওয়া হয়। হেরম্যানের ল্যাপটপে ভারতের একটি স্ক্যান করা মানচিত্রে ১৬টি পরমাণু প্রকল্পের (বর্তমান বা প্রস্তাবিত) এবং পাঁচটি ইউরেনিয়াম খনির অবস্থান চিহ্নিত করা ছিল খুব স্পষ্ট করে। এই মানচিত্রে আরও ছিল — পঞ্চাশজন ভারতীয় পরমাণু-বিরোধী আন্দোলনকারীর নাম — হাতে লেখা, এবং তাদের ব্ল্যাকবেরি ফোনের সাংকেতিক চিত্র। এই মানচিত্রটি উদয়কুমার সহ পাঁচজন প্রমুখ পরমাণু বিরোধীর কাছে পাঠানো হয়েছিল ইমেল করে।’
আমার উত্তর :
এটা হাস্যকর এবং মানহানিকর দাবি যে আমি এনজিও-গুলোর মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ এবং আমি তাদের ‘পাক্ষিক রিপোর্ট’ পাঠাই। বাস্তবে, আমি ‘ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফ দি কিরওয়ান ইন্সটিটিউট ফর দি স্টাডি অব রেস অ্যান্ড এথনিসিটি’-র একজন ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা গবেষক হিসেবে কাজ করেছি আমেরিকার ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটি-তে। কিরওয়ান ইন্সটিটিউটের অধিকর্তা জন এ পাওয়েল, নাগরিক অধিকারের বিষয়ে একজন নামকরা পণ্ডিত, যে আমাকে ‘মিনেসোটা-মিনেপলিস ইউনিভার্সিটিতে ইন্সটিটিউট অন রেস অ্যান্ড পভার্টি’-তে কাজ দিয়েছিল, ১৯৯৭-এর শরৎ থেকে ২০০১-এর বসন্ত অবদি। আমি তার সঙ্গে কাজ করেছিলাম সহ-গবেষক ও প্রোগ্রামের সহকারি অধিকর্তা হিসেবে। সে কারণেই তিনি আমাকে কিরওয়ানের কাজটায় মনোনীত করেন। আমি সে কারণে আমেরিকার কলম্বাসের ওহিও-তে গিয়েছি কয়েকবার। কিরওয়ান ইন্সটিটিউটের জন্য আমি অনেক গবেষণা ও লেখালেখির কাজ করেছি, বিশ্বায়ন, জাতপ্রথা, সংখ্যালঘু কল্যাণ, ব্রিক রাষ্ট্র প্রভৃতি নিয়ে। আমি কখনও ভারতের উন্নয়ন বা পারমাণবিক প্রকল্পগুলি নিয়ে কোনো গবেষণা বা প্রজেক্ট করিনি। আমি ২০১১ সালের বসন্তকালে ওই গবেষকের চাকরি ছেড়ে দিই, যখন কিরওয়ান ইন্সটিটিউটের প্রশাসনে বদল হয়।
একইভাবে সনটাগ রেইনার হেরম্যান আমার জার্মানির যোগাযোগ নয়। তিনি তামিলনাড়ুর নাগেরকয়েল, আমার জন্মশহর সূত্রে পরিচিত। তিনি হিপিদের মতো নাগেরকয়েলের একটি সস্তা হটেলে থেকে পরমাণু বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতেন। আমি তার থেকে কোনো তথ্য বা মানচিত্র বা আর্থিক সহায়তা নিইনি। তাকে ওসব কিছু দিই-ও নি। যদি তিনি সত্যিই কোনো ক্ষতিকর বা বেআইনি কাজ করেই থাকেন, তাহলে কর্তৃপক্ষ কেন তাড়াহুড়ো করে তাড়ালো কোনো আইনি পদক্ষেপ না নিয়ে? যখন তাঁকে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভাগানো হয়, তখনও আমি এই প্রশ্নগুলো তুলেছিলাম।
আমার মতে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে ভাবতেই হবে, চাষি ও মৎস্যজীবী সহ ভারতের ‘সাধারণ নাগরিক’দের নিজেদের মগজ আছে এবং তারা নিজেরাই বুদ্ধিদীপ্ত অবস্থান নিতে পারে। বিশেষ করে তাদের ঘরের পাশেই যদি পরমাণু পার্কের ভয়ঙ্কর প্রকল্প বানানোর কথা হয়। আমাদের মধ্যে যারা উঠে দাঁড়াই, কথা বলি এবং গরীব মানুষদের জমি, জল, বায়ু, সমুদ্র, খাদ্য এবং পুষ্টি সুরক্ষার চেষ্টা করি, তাদেরকে বিদেশি চর, অর্থ তছনছকারী, বা চোরাচালানকারী হিসেবে অপমান করা উচিত নয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের এই সরল সত্যটাকে মানা উচিত, আমরা এই দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসি বলেই এসব করি। এভাবে যদি আমাদের মতো সৎ, দায়িত্বশীল এবং আইন-মেনে-চলা নাগরিকদের অসদাচারণ করা হয়, গাল দেওয়া হয় এবং হয়রান করা হয় — তাহলে তা যুব সম্প্রদায়কে ভুল শিক্ষা দেবে এবং চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বাড়বাড়ন্ত হবে।
এই আইবি রিপোর্টে সমস্ত ধরণের হাওয়ালা (বেআইনি) আদানপ্রদান, ধর্মান্তর, জাতের সংঘর্ষ, সন্ত্রাসবাদ, উন্নয়নমূলক কার্যকলাপে বাধা, জাতীয় অর্থনীতির ভেঙে পড়া — সমস্ত কিছুর জন্য দায়ী করা হয়েছে বিভিন্ন এনজিও এবং তাদের কার্যকলাপকে। আমাদের দেশের বহুত্ববাদী মূল্যবোধ এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে এটা খারাপ। আমি ভয় পাচ্ছি, আইবি রিপোর্টের এই ফ্যাসিস্ট পূর্বধারনা হলো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, জন-আন্দোলন এবং সংখ্যালঘুদের ওপর চরম আঘাতের আবাহন। এই রিপোর্টে যেভাবে আমাকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়ে নাম ধরে, তাতে আমি আমার প্রাণহানি ও আমার পরিবারের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার আশঙ্কা করছি। দয়া করে কিছু করুন।
Leave a Reply