সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, ১৫ মার্চ#
১ মার্চ বিদেশ থেকে ফিরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া লিখিত বিবৃতিতে শাহবাগের আন্দোলনের বিরোধিতা করেন, জামাত-ই-ইসলামির কর্মীদের পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার তীব্র নিন্দা করেন এবং সরকারকে হুঁশিয়ারি দেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। ৩ ও ৪ তারিখ জামাত-ই-ইসলামির হরতালের পরদিন, ৫ তারিখ ফের হরতাল ডাকেন তিনি। যদিও জামাত-শিবিরের হিংসার কোনো নিন্দা তিনি করেননি। গণজাগরণ মঞ্চ জানায়, খালেদার বক্তব্যে তারা হতাশ।
২ মার্চ রাজধানীর নয়াপল্টন, শান্তিনগর ও মালিবাগ এলাকায় আজ শনিবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার পাঁচজনের পড়াশুনা স্থগিত রাখল বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।
শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের আহ্বানে রংপুর কারমাইকেল কলেজিয়েট স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। সব সরকারি, বেসরকারি ও আবাসিক ভবনে এবং গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে শাহবাগের আন্দোলনের প্রতি আজ শনিবার একাত্মতা প্রকাশ করা হয়।
রাজধানীর তোপখানা রোডের শহিদ আসাদ মিলনায়তনে জামাত-শিবিরের সন্ত্রাস, আতঙ্ক ও নৈরাজ্য সৃষ্টির ঘৃণ্য তৎপরতার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান ১০টি বাম প্রগতিশীল সংগঠনের। এদিন নীলফামারী শহরের জলঢাকা উপজেলার রাজারহাট এলাকায় জামাত-শিবিরের সশস্ত্র মিছিল, বিজিবির গুলিতে নিহত একজন।
৩ মার্চ শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর থেকে হরতালবিরোধী মিছিল। বোয়ানের আহ্বায়ক ইমরান এইচ সরকারের এক বিবৃতিতে সব ধর্মপ্রাণ মানুষদের একসঙ্গে জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসি দাঙ্গাবাজদের প্রতিরোধের ডাক দিয়েছে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর ও উপাসনালয় পাহারা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মঞ্চ নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান, আপনারা এক হয়ে এই জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসি বাহিনী কর্তৃক সৃষ্ট দাঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।’
এদিকে হরতাল সফল করতে মাঠে নামে জামাত। চট্টগ্রামের বাঁশখালি উপজেলার চাম্বল ইউনিয়নে আজ শনিবার বিকেলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের ওপর গুলি চালিয়েছে জামাত-শিবিরের কর্মীরা। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি উপজেলায় সড়কের ওপর গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ। বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলা প্রশাসন চত্বরে আগুন। রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি উপজেলার মহিষালবাড়ি এলাকায় জামাত-শিবিরের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, নয় বছরের শিশু রফিকুল ইসলাম নিহত। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে শ্রীপুর উপজেলার জৈনাবাজার এলাকায় গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তায় অবরোধ, ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে এক শিবির কর্মীর মৃত্যু।
জয়পুরহাট-বগুড়া সড়কের সদর উপজেলার হিচমী এলাকায় কয়েক হাজার জামাত সমর্থক একদল পুলিশকে ঘিরে ফেলে। তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশ-বিজিবি যৌথভাবে গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুঁড়লে নিহত হয় ছয়জন — এদের প্রত্যেকের বয়স ১৬ থেকে ৩২-এর মধ্যে। এছাড়া গুলিবিদ্ধ হয় আরও প্রায় ২৫ জন।
অপরদিকে, পাঁচবিবি উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে জামায়াত-শিবিরের ৮-১০ হাজার নেতা-কর্মী মিছিল করে পাঁচবিবি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয় ও থানার ভেতরে দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ ও অগ্নি সংযোগ করে। ঝিনাইদহে হরিণাকুণ্ডুতে জামাত-পুলিশ সংঘর্ষে এক পুলিশ কনস্টেবল নিহত, দশ পুলিশ আহত। সাতক্ষীরার রইচপুর এলাকায় বিজিবির দুটি টহলযানে জামাতের হামলা, বিজিবির সদস্যদের গুলিতে একজন নিহত ও তিনজন আহত। এই অঞ্চলে ভোর থেকেই জামাত-শিবিরের কর্মীরা খুলনা, আশাশুনি, কালীগঞ্জ, যশোর, বৈকারি ও ছনকা সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ সৃষ্টি করে।
রবিবার হরতালের কারণে রেল, সড়ক যোগাযোগ অচল হয় ঢাকায়। মিরপুর-১০ নম্বরের সি-ব্লকে সকাল আটটার দিকে তিনটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
সবচেয়ে বড়ো ঘটনা ঘটে বগুড়ায়। গতকাল শনিবার রাত থেকেই জেলায় গুজব রটে, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডাদেশ পাওয়া জামাতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চেহারা চাঁদে দেখা যাবে। রাত তিনটার দিকে জেলা শহরের বিভিন্ন মসজিদ থেকে মাইকিং করে সবাইকে বের হয়ে তা দেখার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এভাবে জড়ো হয়ে জামাত-শিবিরের কর্মীরা ভোর থেকেই মিছিল শুরু করে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভাঙচুর চালাতে থাকে। সকাল সাতটার দিকে জামাত-শিবিরের কর্মীরা শাজাহানপুর থানায় হামলা করে। বাধা দিতে গেলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ একপর্যায়ে গুলি ছোড়ে। এই গুলিচালনায় বেশ কয়েকজন মহিলা সহ মোট তেরোজন মারা যায়। এইদিনই মারা যায় ৫ জন।
বগুড়া সদরের ইয়াকুবিয়া স্কুলের মোড়ে দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। নন্দীগ্রাম উপজেলায় আজ সকাল সাড়ে আটটার দিকে জামাত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়ে সরকারি বিভিন্ন কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। এছাড়া, রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। দুপচাঁচিয়ায় থানা ঘেরাও করে জামাত-শিবির। শিবগঞ্জের মোকামতলায় দুজন নিহত।
খুলনার ফুলতলা থানার ওসিসহ তিন পুলিশকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়েছে। দিনাজপুরে সদর উপজেলার রানিগঞ্জ উত্তর মহেশপুরে ১২টি গ্রামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি ও খড়ের গাদা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নাটোরে শহিদ মিনার ভাঙচুর ও লালপুর উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শহিদ মিনার ভেঙে ফেলে জামাত-শিবিরের কর্মীরা।
৪ মার্চ কমলাপুর স্টেশনে একটি ট্রেনে আগুন দেয় জামাত-শিবির। ঢাকায় গাবতলীর মাজার রোডে ও মিরপুরে দুটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় হরতালের সমর্থকেরা। রাজধানীর রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনের (বিটিভি) ফটকে হামলা চালায় হরতাল সমর্থকেরা।
মিরপুর, ফকিরাপুল, বিজয়নগর, মালিবাগ ও পল্টন এলাকা থেকে ককটেলের বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার কুশলা ইউনিয়নের লাকিরপাড় গ্রামের সংখ্যালঘুদের এক ধর্মীয় স্থানে আগুন লাগানো হয়। উল্লাপাড়া উপজেলায় এদিন সকালে পুলিশের সঙ্গে জামাত-শিবিরের কর্মীদের সংঘর্ষে এক নবম শ্রেণীর ছাত্র নিহত হয়েছে। সাতক্ষীরায় কলারোয়া-সরসকাটি সড়কে গাছ ফেলে জামায়াত-শিবির কর্মীরা অবরোধ করে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সড়ক থেকে গাছ সরাতে গেলে জামাত-শিবিরের কর্মীরা সরসকাটি পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। পরে পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা আবার ওই এলাকায় গেলে ওফাপুর গ্রামের জামাত-শিবিরের কর্মীরা তাদের চারদিক থেকে ঘেরাও করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। একপর্যায়ে বিজিবির সদস্যরা গুলি চালালে তিনজন নিহত ও চারজন আহত হয়।
জামাতের ডাকা হরতাল প্রতিহত করতে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে মিছিল।
৭ মার্চ বিএনপি এনং জামাতের যৌথ হরতাল ঢিলেঢালাভাবে চলতে থাকে। ঢাকার পল্লবীতে সানিউর রহমান (২৭) নামের এক ব্লগার ছুরিকাহত হয়েছেন। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আজ গণজাগরণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণই ছিল মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা।
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামাত-ই-ইসলামির নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালে করা রিট আবেদন শুনানির জন্য হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের কার্যতালিকায় এসেছে আজ।
৮ মার্চ শাহবাগে নারী জাগরণী সমাবেশ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষ্যে। সমাবেশ চলাকালীন মঞ্চের কাছে কয়েকটি হাতবোমা এসে পড়ে। গণজাগরণ মঞ্চের স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল এইসময় সমাবেশকে ঘিরে লাঠি হাতে বারবার প্রদক্ষিণ করতে থাকে।
নারায়ণগঞ্জে গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা রফিউর রাব্বির বড়ো ছেলে, দুদিন ধরে নিখোঁজ তানভীর তৌকির লাশ পাওয়া যায়। রাব্বি জানান, আমার ছেলের কোনো শত্রু নেই। আমার শত্রুরাই আমার ছেলেকে মেরেছে। পরদিন নারায়ণগঞ্জে হরতালের ডাক দেয় সাংস্কৃতিক জোট।
৪০টিরও বেশি দেশের কূটনীতিকরা চলমান হিংসার অবসানে শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সরকারকে আবেদন জানায়। ব্রিটেন সহ কোনো কোনো দেশ সেনা মোতায়েনের প্রসঙ্গ তোলে।
১০ মার্চ জামাত-ই-ইসলামির নিষিদ্ধকরণ নিয়ে রিট-এর শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করেছেন।
বাংলাদেশের স্বনামধন্য সংগীতব্যক্তিত্ব আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ভাই মিরাজ উদ্দিন আহমেদের লাশ উদ্ধার। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে করা মামলায় বুলবুল সাক্ষী ছিলেন। রাজশাহীতে পুলিশকে আক্রমণ করে অস্ত্র লুঠ জামাতের।
ব্লগ, ফেসবুক, ইন্টারনেট, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তিকারীদেরকে শনাক্ত করতে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। জামাতের সমান্তরাল ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক জোট ‘হেফাজতে ইসলাম’ ‘ইসলামবিদ্বেষী ব্লগারদের অপতৎপরতা বন্ধ এবং তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার’ দাবি জানিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।
১১ মার্চ নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে হিংসা, পরদিন হরতালের ডাক। পরে বিএনপির কার্যালয়ে ঢুকে পুলিশের অস্ত্র উদ্ধার ও শতাধিক বিএনপি নেতাকে গ্রেপ্তার। চট্টগ্রামে আগামী ১৩ মার্চ গণজাগরণ মঞ্চের মহাসমাবেশ বাতিল করার দাবিতে সেইদিনই চট্টগ্রাম জুড়ে হরতালের ডাক হেফাজতে ইসলামের। ১৪৪ ধারা জারি করে কোনোরকম সভা সমাবেশ বন্ধের প্রশাসনিক ফরমান চট্টগ্রামে। রাজধানীতে বিজিবি নামল সন্ধ্যের পর।
১৫ মার্চ আশুলিয়ায় বস্ত্র শ্রমিক অধ্যুষিত অঞ্চলে গণজাগরণ মঞ্চের বিশাল সমাবেশ। সমাবেশ শুরুর আগে সমাবেশস্থলের কাছে ককটেল বিস্ফোরণ। সমাবেশে গার্মেন্টস কারখানার নারী শ্রমিকদের বিষয়ে ইমরান বলেন, এই শিল্পের শ্রমিকদের ৯০ ভাগই নারী। এ দেশের নারীরা যখনই রাজপথে নামতে শুরু করেছে, তখনই জামাত-শিবির প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছে, যাতে নারীরা কাজ করে দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে না পারে। হেফাজতে ইসলামের পাল্টা সমাবেশের ডাক সফল হয়নি।
খালেদার ঘোষণা, শাহবাগ ‘নাস্তিক চত্বর’। আশুলিয়ার গণজাগরণ সমাবেশে এক ছাত্রনেতার বক্তব্য, ‘ধর্মপ্রেম দিয়ে আমরা দেশপ্রেম শিখেছি। আমরা সবাই বাংলাদেশি, জন্মসূত্রেই পাওয়া ধর্ম পালন করে থাকি।’
Leave a Reply