ইংরেজিতে ‘ঘেটো’ নামে একটা শব্দ আছে, যার মানে হল একটা এলাকা, যেখানে নির্দিষ্ট কোনো (সংখ্যালঘু) সম্প্রদায় বা দলের গতিবিধি সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়। ঘেটো শব্দটা এসেছিল ইতালির শহরের ইহুদি-পাড়া থেকে, ইহুদিদের এই অঞ্চলের বাইরে যেতে দেওয়া হত না।
গত চার সপ্তাহ ধরে ইজরায়েলি বোমাবর্ষণে বিধ্বস্ত গাজা এরকমই একটা অঞ্চল, এক বড়োসড়ো জেলখানা। এই অঞ্চলে একটা সরকার আছে, প্রশাসন আছে। কিন্তু সেটা একেবারেই অর্থহীন। কারণ স্থলপথে, সমুদ্রপথে এবং আকাশপথে তাকে ঘিরে রয়েছে ইজরায়েলি সৈন্য — ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্স। বছরের পর বছর ধরে।
গণতান্ত্রিক প্রচারমাধ্যম বড়ো মুখ করে বলছে, ণ্ণগাজার ওপর ইজরায়েলের বোমাবর্ষণ বন্ধ হোক’। কিন্তু বলা হচ্ছে না যে গাজার ওপর ইজরায়েলের জবরদখল তুলে নেওয়া হোক। আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধিরা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে, অথচ সমস্বরে বলা হচ্ছে না যে, ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্সকে আমেরিকার অস্ত্র-সাহায্য বন্ধ করা হোক। অর্থাৎ জবরদখল থাকুক, অবরোধ থাকুক, ট্যাঙ্ক-বোমারু বিমানের সরবরাহ থাকুক, যুদ্ধের কূটনৈতিক মদত থাকুক, আপাতত গাজার মানুষকে একটু রেহাই দেওয়া হোক। মাঝেমধ্যে যুদ্ধবিরতিও দেওয়া হচ্ছে, মানুষ যেন একটু হাঁফ নিয়ে পরবর্তী ধ্বংস আর মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়!
এটাই এখনকার গণতন্ত্র, এটাই মানবতার আধুনিকতম রূপ! না, আমরা এই মানবতা চাই না। গাজার ওপর ইজরায়েলের জবরদখল আর অবরোধ থাকলে যুদ্ধ বারবার ফিরে আসবে। অস্ত্র আর কূটনীতি দিয়ে ইজরায়েলকে ওশকানোর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি অপরিবর্তিত থাকলে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বদল চাই, গাজার ওপর জবরদখল আর অবরোধের ইতি চাই। এর জন্য চাই বিশ্বজোড়া এক স্পষ্ট এবং একতাবদ্ধ আবেদন।
এই আবেদন এই মুহূর্তে খুবই দুর্বল আর ক্ষীণস্বর। আমাদের অনেকেরই প্যালেস্টাইনের ওপর অন্যায়ের বিষয়টা গা-সওয়া হয়ে গেছে। রুটিন কিছু প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু চলছেই চার সপ্তাহ ব্যাপী একতরফা আগ্রাসন। আমাদেরও গায়ের চামড়া মোটা হয়ে গেছে, যারা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বা কাশ্মীরে লাগাতার নিগ্রহ দেখতে দেখতে। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনকে চুপ করে দেখি, ভারত-পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কোন্দল দেখে অভ্যস্ত আমরা, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন প্রসঙ্গ কীভাবে আমাদের নাড়া দেবে? বরং পনেরোই আগস্টের দিন আকাশ থেকে হেলিকপ্টারের ফুল ছড়ানোর খেলায় বুঁদ হয়ে থাকি!
রুটিন প্রতিবাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। প্রতীকি আন্দোলন কোনো কাজে তো লাগছেই না, বরং প্রকৃত সমাধানমুখী পদক্ষেপের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের মনটা এই ধরনের নামকাওয়াস্তে প্রতিবাদে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। গাজার ওপর বোমাবর্ষণ যদি না থামে, তাহলে আমাদের প্রতিবাদ কীভাবে থেমে যায় একটা মিটিং-মিছিল-স্বাক্ষরদানে?
Leave a Reply