সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, যাদবপুর, ১৭ আগস্ট#
২৮ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসের মধ্যে কলাবিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রীর যৌনহেনস্থার ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি নিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর থেকে মেয়েটির বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন অরবিন্দ ভবনের গাড়িবারান্দায় একটানা দিবারাত্র ধরনায় বসেছিল। এই ধরনা চলাকালীনই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও ইউনিয়নকে আলোচনায় ডাকে উপাচার্য। সেখানে তিনি তদন্তের ব্যাপারে বা অভিযুক্তদের শাস্তির ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহ দেখাননি, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে কিছু নজরদারি বন্দোবস্তর প্রস্তাব দেন। এই নজরদারির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, রাত আটটার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আই কার্ড ছাড়া কাউকে না ঘুরতে দেওয়া (যেটা ক্রমশ দিনের বেলাতেও প্রযোজ্য হবে), ক্যাম্পাসে পুলিশের বন্দোবস্ত, সন্ধ্যের পর ছাত্রছাত্রীদের ফেস্ট বা সংস্কৃতির অনুষ্ঠান না করতে দেওয়া, সংস্কৃতির সম্পূর্ণ দায়ভার ছাত্র ইউনিয়নের, আরো সিসিটিভি বসানো প্রভৃতি। এই বিষয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো প্রতিবাদ জানাতে গেলে উপাচার্য বলেন, ছাত্রদের জানানোর জন্য মিটিং-টা ডাকা হয়েছে, তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ডাকা হয়নি। এছাড়াও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র ইউনিয়নকে তিনি পাশে পাওয়ার চেষ্টা করেন এই কথা বলে যে অভিযুক্ত ছাত্ররা তো সব ইঞ্জিনিয়ারিং-এর। এই বিভাজনের চেষ্টার প্রতিবাদ জানিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিয়ন সাধারণ সভা করে জানিয়ে দেয়, অভিযুক্তরা দোষের অনুপাতে আইন অনুযায়ীই শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। এরপর তারা অরবিন্দ ভবনের সামনের জমায়েতে সামিল হয়ে যায়।
গতকাল ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সংস্থা এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সভায় আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা তাদের চার দফা দাবি পেশ করে : ১) ছাত্রী নিগ্রহের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চাই। ২) তদন্ত কমিটির দুই শিক্ষিকা সদস্যা মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে মেয়েটিকে আজেবাজে প্রশ্ন করেছিলেন, তাদের তদন্ত কমিটি থেকে বাদ দিতে হবে। ৩) সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিত বিশাখা গাইড লাইন মেনে তদন্ত কমিটিতে নারী আন্দোলনের কর্মী, মানবাধিকার কর্মী প্রভৃতিদের রাখতে হবে। ৪) তদন্ত কমিটি থেকে রিজাইন করা ছাত্রী প্রতিনিধির বদলে আর একজন ছাত্রী প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল বা ইসি এই ব্যাপারে কোনও উত্তর না জানানোয় সন্ধ্যেবেলা থেকে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা ইসি ঘেরাও শুরু করে। সন্ধ্যেবেলা শাসকদল প্রভাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অশিক্ষক কর্মচারী ইউনিয়নের সঙ্গে কিছুটা বচসা হয় আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের। তারপর থেকেই শাসক দলের এলাকার কিছু মস্তান এবং পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেয়ে যায়।
সন্ধ্যের একটু পরে মধ্যস্ততার চেষ্টা করে পুলিশ। দুই পুলিশ অফিসার ভেতরে গিয়ে ইসি সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মধ্যস্ততার চেষ্টা করেন। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা ইসির সঙ্গে সরাসরি কথা বলার কথায় অনড় থাকে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠনের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন শিক্ষক মধ্যস্ততার চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যস্ততাও মেনে নেয়নি আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা। তারা সরাসরি উপাচার্যকে বয়ান দিয়ে বলতে বলেন, ছাত্রছাত্রীদের তোলা চারটি দাবির জবাব দিতে। এরপর ইসিতে কয়েকজন ছাত্র প্রতিনিধিকে ডেকে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখান ইসি সদস্যরা বা উপাচার্য ছাত্রছাত্রীদের চারটি দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য দাবিগুলি, যথা অবান্তর প্রশ্ন করা দুই শিক্ষিকা সদস্যার তদন্ত কমিটি থেকে অপসারণ, বিশাখা গাইডলাইন মেনে নারী আন্দোলনের কর্মী, মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীদের অন্তর্ভুক্তি প্রভৃতিকে মানা হয় না। ইসি থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, আপাতত ঘেরাও তুলে নাও, পরে শুক্রবার এইসব দাবি নিয়ে এসো। ছাত্রছাত্রীরা বুঝতে পারে, ঘেরাও-এর কারণে কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ পড়েছে, তাই এসব কথা বলছে। ঘেরাও তুলে নিলে শুক্রবার তাদের কোনো দাবিই মানবে না। তারা ঘেরাও চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
রার পৌনে ন’টার সময় উপাচার্য বা ভিসি জানিয়ে দেন, পনেরো মিনিটের মধ্যে ঘেরাও তুলে না নিলে তিনি যে কোনো ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে পারেন। ছাত্রছাত্রীরা বলাই বাহুল্য এই হুমকিতে কর্ণপাত করেনি। রাত বাড়তে থাকে। রাত পৌনে দুটোর সময় গাড়ি বারান্দার আলো নিভিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। একই সাথে শাসক দলের বহিরাগত গুণ্ডারা এবং পুলিশ যৌথভাবে অবস্থানরত ছাত্রছাত্রীদের ওপর বেধড়ক লাঠি চার্জ করে এবং গায়ের জোরে ঘেরাও তুলে দিয়ে ভিসি এবং অন্যান্য ইসি সদস্যদের বার করে নিয়ে যায়।
এই লাঠি চার্জ ও বলপ্রয়োগের সময় অবস্থানরত ছাত্রীদের যৌনহেনস্থা করে সাদা পোষাকের কিছু লোক, যারা শাসক দলের আশ্রিত গুণ্ডা বলে অভিযোগ। রাতের বেলা কোনো মেয়েকে অ্যারেস্ট করা যায় না, কিন্তু তা না মেনে সুধন্যা নামে এক ছাত্রীকে এবং আরও ৩৫ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে ভ্যানে করে নিয়ে যায় পুলিশ। ওই সময় ভ্যানে কোনও মহিলা পুলিশও ছিল না। ওই ছাত্রীকে সকালে জামিন দিয়ে দেওয়া হয়।
লাঠি চার্জে আহত হয় প্রচুর ছাত্রছাত্রী। তারা কেপিসি মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন। অন্তত দু-জন গুরুতর আহত অবস্থায় কেপিসি মেডিক্যাল কলেজের আইসিইউ-তে ভর্তি বলে জানা যাচ্ছে।
কিন্তু এতসব করেও দমানো যায়নি। ছাত্রছাত্রীরা সঙ্গে ওই রাত্রীবেলাতেই যাদবপুর থানা অবরোধ করে বসে থাকে সারা রাত। তারপর সাধারণ সভা করে পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচী ঠিক করা হবে বলে জানা গেছে।
Leave a Reply