২১ আগস্ট, বিশ্বরঞ্জন প্রধান, মৌড়িগ্রাম, হাওড়া#
১৯৯৬ সালে খবরের কাগজ এবং বিভিন্ন জায়গায় একটা প্রতিবেদন বেরোয় যে মৌড়িগ্রামে একটা অত্যাধুনিক খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের কারখানা চালু হচ্ছে। এলাকার মানুষ সে ব্যাপারে একেবারে অন্ধকারে ছিল। এখানে রিলিফ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের ৪৬ একরের বেশি জায়গা ছিল। সুন্দর জায়গাটা। সরকারি জায়গা, প্রাণীসম্পদ বিকাশ দপ্তরকে দেওয়া হয়। তখন জায়গাটা নিচু ছিল। ছেলেরা খেলাধুলা করত। এরা ওটাকে উন্নত করে। সেই উন্নত জায়গাটা এরা ফ্রেজারিও কনজারভা আল্লানা লিমিটেড নামে এক কোম্পানিকে দিয়ে দেয় ৯৯ বছরের লিজে মাত্র কয়েক লক্ষ টাকার বিনিময়ে। তৎকালীন বাজার দরের তুলনায় খুবই সামান্য দরে দেওয়া হয়। দুর্গাপুরে সরকারের একটা রুগ্ন কসাইখানা ছিল। সেটা এই কোম্পানি কিনে নেয়। তারই পরিপূরণ হিসেবে এই জমিটাও এদের দেওয়া হয়। আসলে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ নয়, দুর্গাপুরে যে কসাইখানা বন্ধ হয়ে গেছে, সেটাই এরা এখানে তৈরি করবে বলে স্থির হয়। স্থানীয় মানুষ সেটা জানত না। তারা ভেবে নিয়েছিল যে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মানে শাকসবজি ফলমূল ইত্যাদির প্রক্রিয়াকরণ হবে, লোকে কাজ পাবে, স্থানীয় চাষিরা উপকৃত হবে ইত্যাদি।
পাঁচবছর লাগে কারখানার ঘরবাড়ি তৈরি করতে। ১৯৯৯ সাল থেকে এই কারখানার কাজ শুরু হয়। কোনো সাইনবোর্ড ছিল না। ২০০০ সালে জানুয়ারি নাগাদ হঠাৎ একদিন একটা ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। এলাকার মানুষ হতচকিত, কী ব্যাপার? পরে বোঝা গেল, যে কারখানাটা চালু হয়েছে, সেখান থেকে আসছে গন্ধটা। কৌতুহলী যুবকেরা ঢুকতে গেলে বাধা পেল। যারা ওখানে কাজ করে তাদের কাছ থেকে জানা গেল যে উত্তরপ্রদেশের কানপুর থেকে মোষ নিয়ে এসে এখানে জবাই হচ্ছে এবং সেই জবাইয়ের রক্ত ধোয়া জল আর বর্জ্য বেরয়ে যাচ্ছে। মাংসটা ওরা হিমায়িত (ফ্রিজ) করে রাখছে, সেটা বিদেশে রপ্তানি হবে। হাড়গোড় নাড়িভুড়ি আর যাবতীয় বর্জ্য রেন্ডারিং প্ল্যান্টের মাধ্যমে পুড়িয়ে পোল্ট্রি ফিড হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
দেখা গেল, তৎকালীন সমস্ত রাজনৈতিক দল, গ্রাম পঞ্চায়েত স্তর থেকে বিষয়টা জানে এবং তারা এতে মদতও দিয়েছে। তখন অতনু বসু, লিটন ভাদুড়ি, সুখেন সরকার এবং আরও কিছু মানুষ এখানে একটা সভা ডাকেন। আগে রটনা হয়েছিল যে এটা দাউদ ইব্রাহিমের কারখানা, কিছু করা যাবে না। এলাকার মানুষের স্বতস্ফূর্ত জমায়েত থেকে গড়ে উঠল ‘মৌড়িগ্রাম পরিবেশ সুরক্ষা কমিটি’। সকলের স্বাক্ষর নিয়ে একটা গণ দরখাস্ত প্রস্তুত করা হল। তা সরকারের কাছে পেশ করা হল। ২০০০ সালের মে-জুন মাস নাগাদ একটা শুনানি ডাকল রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। তখন জানা গেল আল্লানা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের কথা। সারা ভারতে এদের ৩২টা কারখানা আছে। আন্দোলন করতে করতে বিভিন্ন তথ্য জানা গেল। তৎকালীন বর্ধমান জেলা পরিষদের সভাপতি মেহবুব জাহেদি, তিনি প্রাণীসম্পদ বিকাশ দপ্তরের মন্ত্রীও ছিলেন, তাঁর ব্যক্তিগত লাভালাভির জন্য এসব করা হয়েছে। শুনানিতে জানা গেল, এরা কারখানাটা করার জন্য ছাড়পত্র (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) পেয়েছে, কিন্তু অপারেশনের জন্য পায়নি। সেটা না পেয়েই এরা ট্রায়াল রান শুরু করে দেয়। এই ধরনের কারখানা করার জন্য যেটা দরকার হয়, এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট (ইআইএ) অর্থাৎ এই কাজটা পরিবেশের ওপর কী প্রভাব ফেলবে তার মূল্যায়ন করা হয়নি। বিশেষ করে এখানে চারপাশে ঘনবসতি, রেলস্টেশন এবং সুন্দর একটা জায়গায় এটা করার প্রভাব কী পড়বে সেটা দেখা হয়নি। যখন জনসাধারণের অভিযোগ জমা পড়ল, তখন এদের বলা হল যে তোমরা এগুলো করে নাও, ততদিন কারখানা বন্ধ থাকবে। ওই শুনানিতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছিল যে এই কাজটা ওরা সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে শুরু করেছিল।
তারপরে এলাকার মানুষ উত্যক্ত হয়ে যাচ্ছে। এরাও চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল এখানে উত্তাল আন্দোলন সৃষ্টি হয়। এই সময়ের মধ্যে অন্তত ছয় থেকে সাতবার শুনানি হয়েছে। লক্ষ লক্ষ টন মোষের মাংসকে হিমায়িত করার জন্য এরা তরল অ্যামোনিয়া ব্যবহার করছে, যা ভীষণ বিপজ্জনক এক মারণ গ্যাস। মাঝে একবার এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাস লিকেজ হল, শ্রমিক মারা গেল। ওই ক-বছর এখানে বহু মিছিল মিটিং হয়েছে, রাজভবনে গিয়ে ধরনা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ তাতে শামিল হয়েছে। পরিবেশ রক্ষার জন্য বন্ধ হয়েছে। এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করেছিল কোম্পানি রক্ত ধোয়া জলকে শোধন করার জন্য। যত বর্জ্য জল নির্গত হত তার ধারণ-ক্ষমতা ছিল না ওই প্ল্যান্টের। বারবার কোম্পানির কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আবার ওরা খুলেছে। কিন্তু লাগাতার আন্দোলন চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশবাদী সংগঠন ও কর্মীরা এখানে এসেছেন। তাঁদের সক্রিয়তায় একটা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট তৈরি হয়েছিল। আজকে যাঁরা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের পরিচালনায় রয়েছেন, তাঁরা ছিলেন এই আন্দোলনের পরামর্শদাতা। তাঁরাই আমাদের মূল দাবিটাকে নির্ধারণ করে নিতে সাহায্য করেন, সেটা ছিল এই যে মৌড়িগ্রামের এই কসাইখানা চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে।
শুধু দুর্গন্ধ বা দূষণই নয়, এরা মাটির তলা থেকে জল তুলে নিচ্ছিল, সেটা সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ ছিল। একটা কমার্শিয়াল স্লটারহাউজের হাজার হাজার গ্যালন জল লাগে। সেই পরিমাণ জল তুলে নিয়ে সেটাকে দূষিত করে আবার ভূগর্ভস্থ জলে সেটা ছেড়ে দিচ্ছে। খাল বিল নালা সব দূষিত হচ্ছে। নদীতে চলে যাচ্ছে। পুকুরের মাছ মরে যাচ্ছে। মানুষের গায়ে চর্মরোগ হচ্ছে।
লাগাতার আন্দোলনের চাপে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হল, কিন্তু সাময়িকভাবে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বলে দিল যে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করলে তবেই কারখানা চালু করা যাবে। এর পরেও এদের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের কাজ করার জন্য প্রত্যেক মাসে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কোনোটাই এরা মানতে পারেনি। কারণ এই কারখানার পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে মাংস প্রক্রিয়াকরণের জন্য। শেষপর্যন্ত পর্ষদ একটা মনিটরিং কমিটি তৈরি করে দিল, জেলাশাসককে চেয়ারম্যান করে। আমাদের অনুমতি না নিয়েই সেই কমিটিতে আমাদের প্রতিনিধি রাখা হল। আমরা সে কথা জেলাশাসককে জানালাম। আমরা কারখানাই চাইছি না তো আমরা মনিটরিং করব কীভাবে? ২০০৬-০৭ নাগাদ এরা চুপ করে গেল। আর কিছু করল না।
২০১০ সালে এসে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আবার একটা শুনানি ডাকল। স্বভাবত আমাদেরও ডাকা হল। আমরা ওদের কাছে বললাম, আপনারা যুক্তি দিন। ওরা পারল না। ২০১১ সালে নতুন সরকার আসার পর আবার শুনানি আহ্বান করা হল। সেখানে আমরা ছাড়াও জেলাশাসক, পঞ্চায়েত সমিতির প্রতিনিধি, দুইল্যা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিও ছিলেন। সবাই একবাক্যে সিদ্ধান্ত হল যে কসাইখানা চালু করা যাবে না। পর্ষদ তখন কোম্পানিকে বলল, ঠিক আছে, আপনাদের ওই কারখানা চলবে না। আপনাদের কী প্রস্তাব আছে নতুন করে ডিটেল প্রজেক্ট রিপোর্ট আমাদের দিন। কোম্পানি বলল, আমরা এসব দিতে পারব না। ইতিমধ্যে কোম্পানি আমাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরেও টেলিফোনে কথা বলার চেষ্টা করেছে। আমরা তাতে সাড়া দিইনি। এই পর্যায়ে ২০১৪-তে কোম্পানি একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল। গ্রাম পঞ্চায়েতে ওরা ট্রেড লাইসেন্স চাইল যে, আমরা কানপুর থেকে জবাই করে এনে এখানে মাংস প্রক্রিয়াকরণ করব, রেন্ডারিং প্ল্যান্টে হাড়গোড় পোড়ানোর কাজটা করব না। যাবতীয় বর্জ্য আমরা এখান থেকে নিয়ে চলে যাব। একই সময়ে ওরা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কাছে বলল, আমরা একটা কোল্ড স্টোরেজ কাম ওয়ারহাউজ করব। খুব কম দিনের নোটিশে একটা শুনানি হল। আমরা গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছ থেকে রেকর্ড সংগ্রহ করে দেখিয়ে দিলাম যে কোম্পানি দু-জায়গায় দুরকম কথা বলছে। আমরা পর্ষদের কাছে বললাম, কোম্পানি প্রস্তাব দিক, আমরা গ্রামবাসীদের কাছে তা রাখব এবং তারাই সিদ্ধান্ত নেবে। পর্ষদ সেই প্রসিডিং পাঠালে আমরা গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বললাম। গ্রাম পঞ্চায়েতে ডেপুটেশন দেওয়া হল। তারা বলল, আমরা ভুল করে ২০১৩-১৪ এক বছরের জন্য অনুমোদন দিয়ে দিয়েছি, ২০১৪-১৫ আর দেব না। গণ-স্বাক্ষর করে এলাকার মানুষ জানিয়ে দিল, কারখানা চালু করা যাবে না।
২০১৫-তে এসে হঠাৎ একদিন আমরা একটা টেলিফোন পেলাম দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ থেকে। খোদ চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। আমরা গেলাম। তিনি বললেন, আল্লানা একটা কোল্ড স্টোরেজ করতে চাইছে, খুব একটা দূষণ হবে না। আমরা অবাক হলাম। চেয়ারম্যান একটা মিটিং ডাকলেন। আমরা যথারীতি কোম্পানির প্রস্তাবে রাজি হলাম না। তারপর হঠাৎ একদিন জুন মাসে পঞ্চায়েত সমিতির পদস্থ শ্রী তপন পাল আমাদের টেলিফোন করে জানালেন, কারখানা আবার খোলার চেষ্টা হচ্ছে, অর্ডার বেরিয়েছে, আপনারা একবার আসুন। আমরা দ্রুত তাঁর কাছে গেলাম। তিনি বললেন যে বিধায়ক তাঁকে জানিয়েছেন, অর্ডার বেরিয়ে গেছে, কারখানা খুলছে। আমরা তো অর্ডারের কোনো কপি পাইনি। ২০০০ সাল থেকে এমন তো কখনো হয়নি। আমরা অর্ডারটা জোগাড় করে দেখলাম। তারপর বিধায়ক, সাংসদ এবং মন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা আলাদা করে দেখা করলাম। নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও বিস্তারিত জানিয়ে চিঠি দিলাম। সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি কিছুই জানেন না। বিধায়ক ব্রজমোহন মজুমদার বললেন, তিনিও কিছু জানেন না। পরিবেশমন্ত্রী ডাঃ সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার আমাদের জানালেন যে এটা পরীক্ষামূলক, যদি দূষণ করে তাহলে বন্ধ করে দেব। তিনি একথাও বললেন যে সাংসদ এবং বিধায়ক বিষয়টা সম্বন্ধে অবগত রয়েছেন।
আমরা ফিরে এসে একটা প্রচারপত্র প্রকাশ করে স্থানীয় মানুষকে সমস্ত জানালাম। আবার আমাদের লড়াই করতে হবে। পঞ্চায়েত একটা প্রস্তাব নিয়েছে, আল্লানা নামে কোনো প্রকল্প এখানে হতে দেওয়া হবে না।
Leave a Reply