অমলেন্দু সরকার, পঞ্চসায়র, পূর্ব যাদবপুর, কলকাতা, ২৯ এপ্রিল#
‘২০০৭ সাল। হাওড়ার বালি অঞ্চলে দুর্গাপুর পল্লীমঙ্গল বালিকা বিদ্যালয়ের ছাদে মোবাইল টাওয়ার বসছে। পরিবেশ সচেতন কিছু মানুষ বিষয়টা নিয়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদে অভিযোগ জানালো। কিন্তু দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ অসহায়তা প্রকাশ করে। কারণ, এ ব্যাপারে তাদের কোনো গাইডলাইন নেই। তখন আমরা উদ্যোগ নিয়ে কেন্দ্রশাসিত দিল্লির ‘মোবাইল টাওয়ার স্থাপন সংক্রান্ত গাইডলাইন’ সংগ্রহ করে দিলাম। সেই গাইডলাইনকে হুবহু অনুসরণ করে ২০০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হলো ‘মোবাইল টাওয়ার সংক্রান্ত গাইডলাইন” — এভাবেই অচ্যুৎ সেনগুপ্ত বললেন, পশ্চিমবঙ্গে মোবাইল টাওয়ার বিরোধী আন্দোলনের গোড়ার কথা। তিনি আরও বললেন, বিকিরণ ১/১০ কমানোর পূর্বে মানবশরীরে কী প্রতিক্রিয়া হলো তার জন্য সরকারের উচিত গ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করা। প্রমোটাররা যেভাবে ফ্ল্যাটের আবাসিকদের না জানিয়ে ছাদে মোবাইল টাওয়ার বসাচ্ছেন, তার বিরুদ্ধেও সরব হওয়ার আবেদন জানান। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ছাদের মালিকানা প্রমোটারের নয়, আবাসিকদেরই।
সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পাশ্ববর্তী সারপেনটাইন লেনের বাসিন্দা দিলীপবাবু বললেন, সংকীর্ণ সারপেনটাইন লেন-এ মোবাইল টাওয়ার অপসারণের কাহিনী। পরিবেশ দপ্তরে অভিযোগ জানিয়ে কোনো সুফল না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাঁরা কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন এবং মোবাইল টাওয়ার নির্মাণের ওপর ‘স্টে অর্ডার’ পান। বর্তমানে মোবাইল টাওয়ার টি অপসারিত হয়েছে।
যোধপুর পার্কের কিশলয় মিত্র বলেন, কেন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিকিরণ কমানো হবে না? বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ কিশলয়বাবু বললেন, আমেরিকাতে বসতি অঞ্চলের ছাদে মোবাইল টাওয়ার নেই। সেখানে মোবাইল টাওয়ার থাকে বিজনেস এরিয়াতে, লোকালয়ে নয়। তার বাড়ির বিপরীতে বাড়ির ছাদে বসানো দুটি মোবাইল টাওয়ার নিয়ে তিনি বহুদিন যাবৎ লড়াই জারি রেখেছেন।
হাওড়ার আবাদার অনুপ মাকালের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। তাদের এলাকাতে ১৪৪ ধারা জারি করে মোবাইল টাওয়ার তৈরি হয়। প্রতিবাদের ফলস্বরূপ সক্রিয় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করেছে পুলিশ। তবে সক্রিয় প্রতিরোধে মোবাইল টাওয়ার কাজ বন্ধ আছে।
বালিখাল সংলগ্ন বসতি এলাকাতে একটি মোবাইল টাওয়ার নির্মাণের কাজ শুরু হলে এলাকার মানুষ প্রতিবাদ করেন। কিন্তু প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করে মোবাইল টাওয়ারটি তৈরি সম্পূর্ণ হয় ঠিকই, তবে কোম্পানি এখনও সেটি চালু করতে পারেনি। — এমনই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন বালিখালের জনৈক বাসিন্দা।
বেহালার বিজন কাহালি জানালেন, কীভাবে তাদের এলাকাতে মোবাইল টাওয়ারের স্থাপন আটকাতে পেরেছেন। পাশাপাশি তিনি জানান, সরসুনার সোনামুখীতে একটি মোবাইল টাওয়ার-এর কাজ আটকে গেছে স্থানীয় মানুষের প্রতিবাদে।
পরিবেশকর্মী শান্তনু চক্রবর্তী মোবাইল টাওয়ার স্থাপনের পেছনে সরকারি সমর্থনের অন্যতম কারণ হিসেবে বলেন, ‘মোবাইল টাওয়ারের মাধ্যমে সরকারের ‘নজরদারি’ চালানোর কাজ খুব সহজ হয়।’ তিনি দাবি তোলেন, মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশন হ্যাজার্ডকে ‘পরিবেশ সুরক্ষা আইন’-এর অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
নাকতলা পদ্মপুকুর রোডের বাসিন্দা পঁচাত্তর বছর বয়সী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার আবেগময়ী কন্ঠে বর্ণনা করলেন, মোবাইল টাওয়ার অপসারণ সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারি দপ্তরগুলির অপদার্থতার কথা। তবে দীর্ঘ পাঁচ বছর লড়াই চালিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ মোবাইল টাওয়ারটি ভেঙে নিয়ে যায় কোম্পানি।
পঞ্চসায়র নবদিগন্ত থেকে সম্পূর্ণ তৈরি হওয়া মোবাইল টাওয়ার অপসারণের সাফল্যের কথা জানান অমলেন্দু সরকার। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বর্তমান রাজ্য সরকারের পরিবেশ দপ্তর ২০১১ সালের জুন মাসে মোবাইল টাওয়ার স্থাপন সংক্রান্ত বিধি তৈরির জন্য একটি বিশেষতজ্ঞ কমিটি তৈড়ি করেন। এই কমিটি ১৪ অক্টোবর ২০১১ সালে একটি রিপোর্ট পেশ করলেও এখনো কোনো অজ্ঞান কারণে সেই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি।
বিশিষ্ট পরিবেশ ও মানবাধিকারকর্মী নব দত্ত এই কনভেনশনের সভাপতিত্ব করেন। তিনি সভা থেকে উদ্ভুত দাবিগুলিকে সুনির্দিষ্ট করেন, —
১) মোবাইল টাওয়ার স্থাপন সংক্রান্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট অবিলম্বে প্রকাশ করা হোক।
২) কলকাতাতে বিকিরণ পরিমাপ করা হোক, যেমনভাবে তেহলকা কাগজটি করেছিল।
৩) বিকিরণের বিপদকে ‘পরিবেশ সুরক্ষা আইন’-এর অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
সভা থেকে মোবাইল টাওয়ার সংক্রান্ত আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য একটি চারজনের কমিটি তৈরি হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক অচ্যুত সেনগুপ্ত। সভাটি অনুষ্টিত হয় ১১ এপ্রিল নাগরিক মঞ্চের পরিচালনায় শিয়ালদহ-র নিকটস্থ ইস্ট লাইব্রেরিতে।
Leave a Reply