রামজীবন ভৌমিক, কোচবিহার, ১৪ মে#
বক্সা না সান্দাকফু, কোথায় যাওয়া হবে? এই নিয়ে আমাদের আলোচনা চলছিল। অমিতাভর কলকাতা যেতে হবে। হাতে মাত্র দু-দিন সময়। শেষে ঠিক হল, গরুমারা জঙ্গল ঘুরে আসবো। দুজনে লাটাগুড়ি চললাম। লাটাগুড়ি ক্রান্তি মোড়ে দিদির বাড়িতে পৌঁছতেই ভাগনে সবার আগে দৌড়ে এসে গ্রিল খুলে ঘরে নিয়ে গেল। দু-দিন জামাইবাবুর বাইক নিয়ে লাটাগুড়ি, মূর্তি নদী, খুনিয়া জঙ্গল, চালসা, মেটলি সামসিং ও আপার সামসিং অর্থাৎ মণ্ডলগাঁও ঘুরে বেড়ালাম। অমিতাভ অনেক ফরেস্ট ঘুরেও বানর আর ময়ুর ছাড়া আর কিছু দেখতে পায়নি। লাটাগুড়ি থেকে চালসা যাওয়ার পাকা রাস্তায় বা তার আশেপাশে একটি দাঁতাল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
দুপুরের পর ক্রান্তিমোড় পৌঁছে খাওয়া দাওয়া সেরেই আমরা দু-জন হাতির খোঁজে হেঁটেই বেড়িয়ে পড়লাম। লোকে আমাদের খুব সাবধান করতে লাগল। হেঁটে হেঁটে লাটাগুড়ি রেললাইন ও চালসাগামী পাকা সড়কের ক্রসিং অবধি এলাম। এখান থেকেই ঘন জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে। আর সামনে হেঁটে যাওয়া যাবে না। আমরা রেল লাইন ধরে বাঁদিকে বনের ভেতরে নেওড়া ব্রিজের দিকে খানিকটা এগোলাম। নেওড়া ব্রিজে বসে সূর্যাস্ত দেখতে বেশ লাগে আমার। এখন সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। সন্ধ্যে নেমে আসছে। বেশি দূরে যাওয়া ঠিক হবে না ভেবে লাইনের ওপর বসে পড়লাম। কিছু ময়ুরের ডাক, বন মুরগীর ডাক শোনা গেল। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, আরও কত পাখি-পশুর ডাক মিলেমিশে বনে যেন উৎসব হয় সব সময়। এই উৎসবের কোনো বার্ধক্য নেই, শৈশব নেই। যা শুধু প্রাক যৌবনের সতেজতা নিয়ে থাকে। না, দাঁতালের দেখা আমরা পেলাম না।
জঙ্গল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে এক ভ্যান চালককে বললাম, চালসাগামী পাকা রাস্তা ধরে কিছু দূর বনের ভেতর নিয়ে যেতে। আমাদের কাণ্ডজ্ঞান নেই দেখে তিনি আমাদের বোঝাতে লাগলেন, কেন চার চাকা ছাড়া অরণ্যে এই সন্ধ্যেয় যাওয়া উচিত নয়। ওঁর সারল্যের হাসি আরও শিশুসুলভ হয়ে উঠেছে আকণ্ঠ সুরা পানের পর। কথায় কথায় জানতে পারলাম ভ্যানচালক বামনি বস্তির অরণ্যবাসী। উনি কপালে হাতজোড় করে ঠেকিয়ে বললেন, আমরা প্রার্থনা করি হে মহাকাল বাবা, আমাদের সাথে যেন হাতির বা চিতার দেখা না হয়। আর আপনারা উল্টো।
জামাইবাবু আমাদের হাতি দেখাবেন ভেবে মাঝ রাতে চার চাকার ব্যবস্থা করে ফেললেন। একাধিক পাকা সড়ক আর রেল লাইন লাটাগুড়ি চালসা চাপড়ামাড়ি প্রভৃতি গভীর জঙ্গলের বুক চিরে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত। এইসব রাস্তা দিয়ে সরকারি টিকিট কেটে জঙ্গল সাফারিতে যেতে হয়। সকাল বিকেল মিলিয়ে একশোর বেশি হুডখোলা জিপসি গাড়ি বনের আনাচ কানাচে পর্যটককে নিয়ে যায়। আর একটু মোটা পাকা সড়কে ২৪ ঘন্টা ৭০-১০০ কিমি প্রতি ঘন্টা বেগে অসংখ্য গাড়ি বাইক চলছে। অরণ্যবাসী পশুদের সেসব রাস্তা সাক্ষাৎ লক্ষ্মণ রেখা। যেন লেসার রশ্মির লক্ষ্মণ দেওয়াল। অতিক্রম করতে গেলেই প্রাণ সঙ্কট। গভীর রাতে বন্য পশুদের দুঃসাহস হয়। সারাদিনের ঘেটো জীবনকে ওরা অস্বীকার করতে চায়। গভীর রাতে এক ঘেটো থেকে আরেক ঘেটোতে যাবার জন্য রাস্তা অতিক্রম করবে আর আমরা দেখতে পাব। না আজ আর ওদের সেই সাহস হল না। আমাদের লাটাগুড়ি চালসা পাকা সড়ক ধরে মাঝ রাতের জঙ্গল সাফারি পুরোপুরি ব্যর্থ।
পরদিন সকালে চায়ে চুমুক দিতে দিতে জামাইবাবু বললেন, আমাদের জঙ্গল সাফারি যে রাস্তা ধরে হয়েছে, তার একটু গভীরে জঙ্গলে হাতির পাল ছিল। বিছাভাঙা বনবস্তির মানুষের বেশ ক্ষতি করেছে হাতিগুলো। শুঁড় দিয়ে ঘরের বেড়া খুলে নিয়েছে। ঘর ফেলে দিয়েছে। ণ্ণজয় মহাকাল বাবা’ ণ্ণজয় মহাকাল বাবা’ ধ্বনি ওদের প্রাণ বাঁচিয়েছে।
সকালের খাবার টেবিলে গল্প চলছে। সাত বছরের ভাগনে প্রশ্ন করল,মামা বনের অনেক আগুন দেখেছ? দাবানল? হ্যাঁ। — না বাবা, আমি দাবানল দেখিনি। — আমি দেখেছি। তোমরা যাও পোড়া বন দেখতে পাবে।
মোটরবাইক নিয়ে লাটাগুড়ি থেকে মূর্তি ব্রিজের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। বিছাভাঙ পেরিয়েই রাস্তার দু-পাশে কয়েক কিলোমিটার বন ২০০-৩০০ মিটার গভীরতা নিয়ে পুড়ে খাঁক হয়ে আছে। বেশ দূর অবধি শুধু পোড়া মাটি। শুকনো পাতা ছড়ানো। বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়িগুলির বাকল পুড়ে কালো। লেলিহান শিখা ৪০-৫০ ফুট উচ্চতার সতেজ ডালপালাগুলিকে ঝলসে দিয়েছিল। এখন ডালপালাগুলি মরে শুকনো পাতা নিয়ে ঝুলছে। ৫০ ফুট উচ্চতার বেশ কিছু গাছ পুরোপুরি মরে দাঁড়িয়ে আছে অদৃশ্য হওয়ার জন্য। ছোটো খাটো ঝোপ, লতা জাতীয় গাছ আর পোকা মাকড়, পাখি, সাপ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বা আরও গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে।
গরুমারা জাতীয় উদ্যানের ডিয়ার পার্কে গেলাম। কয়েক একর বন মোটা তারের ফেন্সিং দিয়ে ঘিরে ডিয়ার পার্ক। পাশে কিছু সাপ ঘর। এবার পার্কে হরিণ নেই। সাপ ঘরেও বন্য জন্তুর পাকা স্ট্যাচু সাজানো। নিশ্চয়ই সাপ আর হরিণগুলোকে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
বাইক চলল। বন এখনও সবুজ সতেজ হয়নি। মলিন, দারিদ্রতার ছাপ। কিন্তু সবল সোজা হয়ে ওঠা বৃক্ষরাজি, বেশ সম্ভ্রম জাগায়, মনের ক্ষুদ্রতা দূর করে। আমরা বামনিঝোড়ায় এসে থামলাম। এখানেই বিখ্যাত মহাকাল বাবার মন্দির। স্ট্যাটাসে কোচবিহারের মদনমোহন বাড়ির মতো। বিবাহ অন্নপ্রাশন সব শুভকাজে এখানে সব বর্ণের মানুষ জোড় হাতে মাথা নুইয়ে যায়। দু-জন উপজাতি বৃদ্ধা মন্দিরের আশেপাশে ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করছেন। একজন রুগ্ন বৃদ্ধ পুরোহিত পুজোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। না, বামনিঝোড়ায় জলের চিহ্ন নেই। ঝোরার বুকে পাথরের ফাঁকে কিছু মদের বোতল, খালি ঠান্ডা পানীয়র ক্যান, এবং কুড়কুড়ের ছেঁড়া প্যাকেট বানের জলে ভেসে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। ঝোড়ার ওপর পাকা সেতু। সেতুর কাছে একটা এঁদো পচা কুয়ো চোখে পড়ল। পুরোহিত বিষাদগ্রস্ত মনে কুয়ো থেকে জল তুলছেন। মন্দিরের এই তিন সেবায়েত ক্যামেরা হাতে আমাদের উপস্থিতি পুরোপুরি উপেক্ষা করে একমনে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছেন। হ্যাঁ, এখানে মহাকাল বাবা উপজাতিদের মতো সহজ সরল। কতগুলি কালো কালো বড়ো পাথর। ওপরের দিকে একটু সরু। পরপর দু-তিন সারিতে সাজানো। উপজাতিদের মতো বাবাও ণ্ণদীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী দীর্ঘ বরষ মাস’ বৃষ্টিতে ভেজেন আর রোদে পোড়েন। হাতি, বাইসন রাতে এসে বাবার মাথায় শ্বাস ফেলে পুজো দিয়ে যায়। সারাদিনরাত ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর পাখির সংগীত ভজন চলতে থাকে। ভাগ্যিস বাবার মাথায় কোনো ছাদ নেই। চারপাশে কোনো বেড়া নেই। কীট পতঙ্গ সাপ পাখি চিতা সকলেই বাবার সাথে সখ্যতা করতে পারে। এমনকী কেরল কলকাতা কোচবিহারের উচ্চবর্ণের পর্যটকরাও।
মূর্তি নদীর ওপর ব্রিজ ভেঙে মেরামতির কাজ চলছে। বাইক নিয়ে ওপারের খুনিয়া জঙ্গলে যাওয়া যাবে না। মন খারাপ করে নদীর ধারের গাছের ছায়ায় গিয়ে দু-জনে বসলাম। চারপাশে দুপুরের প্রখর রৌদ্র। শেষ বৈশাখের নদীর শ্রীহীনতার দিকে তাকিয়ে আরও মন খারাপ লাগল। নদীখাত এখানে আন্দাজ পঞ্চাশ মিটার প্রশস্ত আর বারো চৌদ্দ ফুট গভীর হবে। কিন্তু পাঁচ ছয় মিটার প্রশস্ত জলের ধারা এক ফুট গভীরতা নিয়ে বইছে। বাঁশের খাঁচা দিয়ে স্রোতের গতিকে বাধা দিয়ে চারটি উপজাতি মেয়ে মাছ ধরছে। একটু দূরে ব্রিজের ডান দিকে কিছু মানুষ নদী বক্ষ থেকে গোল গোল পাথর (বোল্ডার) তুলে দু-তিনটি ট্রাকে ভর্তি করছে। খানিকক্ষণ বাদে সাহস করে মূর্তি নদীর স্রোত বাইক চালিয়ে পার হয়ে গেলাম। আগে মূর্তি নদী ভয় দেখাতো। স্রোত পাথরে আছড়ে পড়ে প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠত। উছলে ওঠা জলের নাচে সূর্যালোক পড়লে ঝলমলে গহনা পোশাক পড়া ছটফটে ছোটো রাজকন্যার মতো লাগত নদীকে। পর্যটকরা ভয়ে ভয়ে রাজকন্যাকে পাশে নিয়ে ফটোশুট করত। উদাত্ত স্রোতের গান নেশা ধরাতো পর্যটকদের। আজ আমরা ছাড়া বাইরের কোনো পর্যটক নজরে পড়ল না।
আমরা মূর্তি পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি। চারদিক শান্ত নিস্তব্ধ। দু-পাশে শুধু পাখির ডাক, বন্য জন্তুর চিৎকার। শুধু আমাদেরই বাইক ধীরে চলছে। হাতির পাল বা অন্যান্য পশুদের একটু দূর থেকে দেখার জন্য আমি রাস্তার ডানদিকের জঙ্গলে আর অমিতাভ বাঁদিকের জঙ্গলে নজর রেখে চালাচ্ছে । রাস্তার পাশে একটু পর পর কেটে কেটে রাখা বড়ো বড়ো গাছের লগ। কয়েকদিন আগের কালবৈশাখী ঝড়ের দাপটের চিহ্ন।
নির্জন বনে পাতলা লম্বা একজন সাঁওতাল মানুষ কিছু একটা খুঁজছেন বলে মনে হল। সাহস পেয়ে বাইক থামিয়ে দাঁড়ালাম। বন থেকে বেরিয়ে সাইকেল নিয়ে লোকটি সামনে এলেন। আমাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে সাইকেলে ঝোলানো দু-টি নাইলন ব্যাগ ফাঁকা করে দেখালেন। একটি ব্যাগে অনেকগুলি মাশরুম আর অপরটিতে বেশ কিছু ছোটো ছোটো কাঁকড়া। ওনার ভাষা আমরা কিছু বুঝতে পারলাম না। কথার আর্তি শুনে মনে হল, এটাই ওনার মূল রোজগার।
রাস্তা আর রাস্তার পাশের সবুজ ঘাসের ওপর রাশি রাশি চিলোনি গাছের ঝরে পড়া সাদা ফুল ছড়ানো। সহস্রাব্দ থেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত ফুল সজ্জা। ঝোপ জঙ্গলে গাছের ডগায় পিঁপড়ের বাসা। বড়ো বড়ো সজীব পাতা দিয়ে বানানো নিঁখুত আর্কিটেক্ট কালবৈশাখী ঝড়কে ফাঁকি দিয়ে দিব্বি আছে। কিছু লতানো গাছ সুন্দর প্যারাবোলিক প্যাঁচ তৈরি করে ঝুলছে। গাছের গুঁড়ির মতো মোটা আর এত বড়ো বড়ো লতানো লুপ গুলি আমাদের চোখ টানছিল। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর খুকড়ি হাতে বয়স্ক রাখালকে গরু চরাতে দেখলাম। অমিতাভ আলাপ জমালো। জনমানব শূন্য গভীর জঙ্গলে হাতি আর অন্যান্য ভয়ঙ্কর পশুদের দুনিয়ায় একাকী গরু চরিয়ে জীবন বুড়ো করে দিয়েছেন। আমার কাছে বেশ দুঃসাধ্য ঠেকলো। বুঝলাম, ছোটো বেলায় শোনা রাখাল ও বাঘের গল্প নীতি শিক্ষার জন্য জোর করে তৈরি হয়নি।
খুনিয়া জঙ্গলের বনানী যথেচ্ছ ধ্বংস করে চালসামুখী প্রশস্ত পাকা সড়ক তৈরি হয়েছে। মূর্তি জঙ্গল থেকে এই হাইওয়েতে আসতেই শত কিলোমিটার বেগে চলা শত শত ট্রাক, বাস, বাইকের মাঝে পড়লাম। নির্জনতার প্রশান্তি মুহূর্তেই গতি আর হর্নের আক্রমণের মধ্যে পড়ল। রাস্তা থেকে অনেকটা সরে বন ঘেঁষে এক সারিতে ১৫-২০ জন সাঁওতাল মহিলা মাথায় দু-মণের মতো করে জ্বালানি কাঠ নিয়ে হাঁটছে।
চালসা মোড় থেকে মেটলি, মালবাজার, ময়নাগুড়ি এবং আলিপুরের বাস সবসময় পাওয়া যাচ্ছে। পাশেই শিলিগুড়ি আলিপুর সংযোগী চালসা রেল স্টেশন। কৃষ্ণচুড়ার থোকা থোকা লাল ফুল স্টেশন চত্বর জুড়ে। চালসা বাজারে বেশ ভিড়। ক্রেতারা এক দোকান থেকে বেরিয়ে অন্য দোকানে কেনাকাটা করছে। ভুল টার্ন নেওয়ার জন্য ট্রাফিক পুলিশ বাইক আরোহীদের চোখ রাঙাচ্ছে। আমাদের বাইকের পলিউশন সার্টিফিকেট ল্যাপস হয়ে গেছে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অটো এমিশন টেস্টিং সেন্টারে যেমন অভিজ্ঞতা হয় এখানেও তাই হল। শুধু বাইকের নম্বর প্লেটের একটা ছবি তুলে ধোঁয়া পরীক্ষা না করে সঠিক রিনিউড পলিউশন সার্টিফিকেট দিয়ে দিল।
চালসা থেকে মেটলির রাস্তা ধরতেই খানিকটা খাড়া পাহাড়ঢাল। এর পর ঢাল বেড়েছে খুব ধীরে। সমতল বলে ভ্রম হতে পারে। সামসিং অবধি দু-ধারে শুধু চা বাগান আর চা বাগান । চোখের সীমাহীন তৃপ্তিতে হৃদয় হালকা বেলুনের মতো দুলে দুলে ভেসে উঠে যায় মেঘের রাজ্যে। রাস্তার দু-পাশে সুবিশাল রেইনট্রি গাছের সারি। ঝিরি ঝিরি পাতার মাঝে অসংখ্য ছোটো ছোটো সুতোর পাপড়ির গোলাপী ফুল। মোটা মোটা ডালগুলি পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের সুন্দর পাতা আর রঙ বেরঙ ফুল দিয়ে মুড়িয়ে সাজানো। রাস্তার দু-পাশ থেকে আসা একটি ডাল অপর ডালের ওপর দিয়ে গিয়ে নয়নাভিরাম তোরণ তৈরি করে আমাদের সুস্বাগতম জানাচ্ছে।
চালসা থেকে মেটলি যাওয়ার প্রায় অর্ধেকটা পথ এসে গেছি। বাঁদিকে কিছুটা দূরে পাহাড় ঢালের নিচে বেগুনি জারুল ফুলের সারি সারি সমারোহ। মাঝে মাঝে শাঙ্কবাকার কুন্দরাজ গাছ জুড়ে সাদা ফুল ফুটেছে। যেন বেগুনি ফুলের রাজ্যে ছোটো ছোটো তুষার চূড়া মাথা তুলেছে। আমরা কিছুক্ষণের জন্য নিচে নেমে এলাম। জারুল বনের সামনে দিয়ে যাওয়া ঝোরার ওপর কালভার্টে দাঁড়ালাম। কয়েকটা বেনে বউ পাখির বউ-কথা-কও ডাক চারদিকে প্রতিধ্বনিত হয়ে বাতাস ভরিয়ে তুলেছে। পাশেই একটা পুখরীতে চারটি তেরো চৌদ্দ বছরের ছেলে নিরাবরণ শরীরে বিচিত্র জলের খেলা খেলছে। অমিতাভ ওদের জল ক্রীড়া ক্যামেরা বন্দী করছে। পথচলতি মানুষ এত বড়ো চারটি ছেলের ভ্রূক্ষেপহীন উলঙ্গ জলকেলিতে বিভিন্ন মজার টিপ্পনি কেটে হেসে হেসে যাচ্ছে। এমনই একদল সাঁওতাল মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম, \
— আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?\
— মেটলি।\
— এখানে আশপাশে টুরিস্টদের দেখার কী আছে?\
— আমরা চা বাগানে থাকি কিছু বলতে পারব না। \
— এটা কোন চা বাগান? \
— গুডরিকের আইবিল লুকাস লাইন চা-বাগান। \
— বাগানে চা শ্রমিকদের মজুরি কত করে দেয়?\
— দিনে ২৭-২৮ কেজি চা পাতা তুললে ৫৫ টাকা। কম তুললে পয়সা কাটি নেয়। বেশি তুললে এক কেজিতে একটাকা বেশি দেয়। কিন্তু দুই পাতা এক কুড়ির জন্য সবাই বারো চোদ্দ কেজি তোলে। পিএফ কাটিয়ে মাসে এগারোশো বারোশো টাকা হয়। \
— চার-পাঁচজনের পরিবারে বারোশো টাকায় কীভাবে চলে?\
— চলে না, অর্ধেক খেয়ে চালিয়ে নিতে হয়। \
— বাগানের অন্য কোনো সমস্যা আছে?\
— আমাদের সমস্যাই সমস্যা। আমাদের অসুখের জন্য মালবাজার চালসা হাসপাতালে যাইতে হয়। বাগানে কোনো ব্যবস্থা নাই। রান্নার লকড়ি কম। রেশনে মাসে এক লিটার কেরোসিন তেল দেয়। সরকারিভাবে ইলেকট্রিক লাইন আছে। দুটো একটা আলো জ্বললে তিন মাসে পনেরোশো থেকে বাইশশো টাকা অবধি ইলেকট্রিক বিল আইসে। কখনও কখনও মেয়েরা রেপ হয়ে মরে যায়। \
— এত টাকা ইলেকট্রিক বিল তো শহরেও আসে না। আপনারা কি রান্না করেন কারেন্টে? মিটার আছে?\
— না না রান্না করি না। পয়সা নাই তাই এক দুটা বালব কিনে লাগাই। মিটার আছে। \
— সমাধানের কোনো ব্যবস্থা নাই?\
— আমরা ইলেকট্রিক অফিসে লাফড়া করলাম। অফিসার বলল, ল্যান্ডের টাকা, কয়লার টাকা — দুনিয়া ভর হিসেব লাগু আছে। মিটারের হিসেবের সাথে আবার নিচে এক্সট্রা টাকা নেয়।
মন ভার হয়ে থাকল। মেটলি ছেড়ে আমরা সামসিং-এর রাস্তা ধরলাম। একটু ভয় ভয় হচ্ছিল। পাকদণ্ডি বেয়ে এই প্রথম বাইক চালাচ্ছে অমিতাভ। লড়ঝড়ে পুরোনো বাইকে সামসিং পাহাড়ের ওপর উঠে এলাম। বাঁয়ে সুনতালে খোলা যাওয়ার রুট রেখে কিছুদূর এগোতেই ডানে রকি আইল্যান্ডের রাস্তা। কিছুটা উঠে আবার নিচে নেমে গেছে। দুটো জায়গাতেই দেশি বিদেশি পর্যটকদের ভিড়। শীতের সময়ে পিকনিকের ঢল নামে। এখানে লোকবসতি খুবই কম। নাতিদীর্ঘ ঘন বনে শুধুই শত শত ঝিঁ ঝিঁ পোকার সমবেত তীক্ষ্ণ ডাক। গুচ্ছ করাত কলের মিলিত আওয়াজের মতো। কান ঝালাপালা করে দেয়।
মণ্ডলগাঁও অনেকটা পাহাড়ের ওপর। ক্যালেন্ডারের ছবির মতো সাজানো। দুটো পাহাড়ের ঢাল অবতল কোল তৈরি করে মিশেছে। অবতল কোলের দু-পারে ছোটো ছোটো রঙিন পাহাড়ি বাড়ি। মাঝখানে ধাপ চাষের কতগুলি ধাপ ধাপ সবুজ জমি। ডানদিকে কিছুটা উঁচুতে শিব মন্দির। আজ পঁচিশে বৈশাখ, অমিতাভ ধাপ-চাষ জমির আলে বসে গলা ছেড়ে ‘কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে’ গাইছে। চালসা থেকে সামসিং অবধি বাস আছে। তারপর একদিন ট্রেক করলেই মণ্ডলগাঁও। দু-দিনের জন্য তাঁবু খাটালে বেশ কাটবে — পাহাড়ি মানুষ, ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া ধুধু সবুজ বন আর নিস্তব্ধতার সাথে।
Leave a Reply