শমীক সরকার, কলকাতা, ৩০ ডিসেম্বর। তথ্যসূত্র ই-পাও ডট নেট এবং মন্থন সাময়িকী সেপ্টেম্বর অক্টোবর ২০০৪ সংখ্যা#
মণিপুরের বিধানসভায় জনপ্রতিনিধিরা সর্বসম্মতভাবে পাশ করেছিল ‘গোবিন্দজী মন্দির (তৃতীয় সংযোজনী) বিল ২০১৪’, ২৫ জুলাই ২০১৪ তারিখে। এই বিল অনুযায়ী ‘উমঙলাই’দের যেকোনো প্রথা পালনের জন্য পণ্ডিত লোইসাং-এর অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এই পণ্ডিত লোইসাঙ গোবিন্দজী মন্দির বোর্ডের ব্যক্তি, যার মানে দাঁড়ায়, ‘উমঙলাই’দের কোনো প্রথা পালন করার জন্য এবার থেকে গোবিন্দজী মন্দির বোর্ডের অনুমতি নিতে হবে। প্রসঙ্গত, উমঙলাই-রা মণিপুর উপত্যকার নিজস্ব মৈতেয়ী সংস্কৃতি-ধর্মাচরণ-প্রথামাফিক বেশ কিছু আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে মণিপুরের সবচেয়ে বড়ো লোক উৎসব ‘লাই হারৌবা’ চলাকালীন, তাদের কেউ কেউ গোবিন্দজী মন্দির বোর্ডের অনুমতি নেয়, আবার কেউ কেউ নেয় না। এ প্রসঙ্গে আরো বলা যেতে পারে, মণিপুর উপত্যকার প্রাচীন সংস্কৃতি জ্বালিয়ে বিসর্জন দিয়ে বৈষ্ণব-হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতিকে বরণ করে নেওয়া শুরু হয়েছিল এক মণিপুরী রাজা, গরিব নওয়াজ-এর আমলে, ১৭৩৭ সালে। কিন্তু মণিপুরী সমাজের বড়ো অংশ তা গ্রহণ করেনি। গোবিন্দজী মন্দির সেই বৈষ্ণব-হিন্দু ধর্মের মূল প্রতিষ্ঠান। মণিপুরের রাজনীতিক-প্রশাসক-ব্যবসায়ী-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যারা কুলীন, তাদের একটা বড়ো অংশ এই গোবিন্দজী মন্দির এবং বৈষ্ণব-হিন্দু ধর্মের প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে যুক্ত। ফলে এই ধর্মটি মণিপুরে এখন প্রায় রাজধর্মের মতো। মণিপুর উপত্যকার মৈতেয়ী সমাজের মধ্যে এই বৈষ্ণব-হিন্দু ধর্ম এবং প্রাচীন ধর্মের বিভাজন এখন প্রায় আড়াআড়ি।
আগস্ট মাস থেকেই মণিপুরের উমঙলাইদের নেতৃত্বে বহু নাগরিক সংগঠন উমঙলাই কানবা আপুনবা লুপ বা সংক্ষেপে উকাল এই বিলের বিরোধিতা শুরু করেছিল। সেই বিরোধিতায় সরাসরি বলা হয়েছিল, এই বিল আদিবাসী সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে হিন্দু সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা মাত্র। এই বিলের ২ এবং ১৭ নম্বর ধারা মধ্যে দিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে সেবা পূজা ও অন্যান্য অনুষ্ঠান পালনে কঠোরভাবে সবাই হিন্দু ধর্মের বিধানকেই মেনে নেয়। উকাল রাজ্যপালকে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে বলেছিল, উমঙলাই-রা সানমাহি ধর্মের, ফলে তাদের আচারে হিন্দু স্তোত্র কখনোই উচ্চারণ করা হবে না, সানমাহি স্তোত্রই পাঠ করা হবে। এই বিল লাগু হলে যা করা যাবে না। স্মারকলিপিতে রাজ্যপালকে আবেদন করা হয়েছিল, তিনি যেন কিছুতেই এই বিলে স্বাক্ষর না করেন। এই বিল ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারাগুলির বিরোধী বলেও দাবি করা হয়। একটি সভাতে অ্যাডভোকেট সানাসাম সরত অভিযোগ করেন, এই বিল আদিবাসীদের বিলুপ্ত করে হিন্দুত্বকরণের একটি চক্রান্ত।
মৈতেয়ী সমাজের মধ্যে এই পরিমাণ বিরোধিতা দেখে মণিপুরের রাজনৈতিক সমাজের টনক নড়ে। কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী ওকরাম ইবোবি সিং-এর নেতৃত্বে তারা বলতে শুরু করে, এই সংযোজনী বাতিল করা হবে।
অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর মণিপুরের রাজ্যপালের সচিব জানান, রাজ্যপাল এই বিলটি স্বাক্ষর করেননি, ফলে বিলটি বিধানসভায় পাশ হয়ে গেলেও খারিজ হয়ে যাচ্ছে।
Leave a Reply