রামজীবন ভৌমিক, কোচবিহার, ১৫ জুন #
‘কোনটে গেইলে কান্দি কাটি না যাওয়া যায়। হাসি হাসি যাওয়া খায়।’ কথাটা বলেই ট্রেনের সীট হতে একজন মহিলা আমার পাশ দিয়ে দ্রুত চলে গেলেন। নয় দশ বছরের একটি থমথমে মেয়ের পেছনে পেছনে তার মা এসে আমার সামনের সীটে বসলেন। চোখের জল গাল বেয়ে নেমে আসছে। দুহাতে জল মুচছে আর কাঁদছে। বয়স ৩৫-৩৬ এর একজন মুসলীম মহিলা। বয়স পঁচিশের একজন সহযাত্রী প্রতিবেশি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ক্যাঁ ভাবি এলায় যান? ভোট বিরাইলে গেইলেন হয়’। উত্তরে মহিলাটি বললেন- ‘ভোট দিয়া হামারা কি করি? হামার মেলা ঋণ হয়া গেইচে। হামরা থাকমনা, হামার বারিত আইসেন বোল। দেখিযান বাড়ি খান।’ তারপর আরো জানতে চাইলেন ওনারা স্বামি-স্ত্রী দুজনে কোথায় যাচ্ছেন? ‘ধুবরি যামো। তিন্দিন বাদে আসিয়া তোমার বাড়ি দেখি আসমো।’ বলেই ছেলেটি ট্রেনে নিজের জায়গা ধরতে গেল।
সকাল সোয়া পাঁচটার পেলব জ্বলজ্বলে রৌদ্র। গ্রামটাকে আরো মায়াময় করে তুলেছে। নরম সূর্য্যালোক বিস্তৃত সবুজে ঠিকরে পড়ে ট্রেন সওয়ারিদের আরো বেঁধে ধরতে চাইছে গ্রামের মায়ায় । কোচবিহারের বামনহাট থেকে ট্রেন আবুতার হল্ট ষ্টেশন থেকে ছেড়ে আমাদের নিয়ে শিলিগুড়ির দিকে এগোতে লাগলো। যত এগোতে লাগলো মহিলার নীচের চোয়াল কেঁপে কেঁপে নীচে নেমে আসছিল। ঠোঁট দুটি মুচড়ে-বেঁকে হেচকি ওঠার মত বার বার শরীর ঝাঁকিয়ে বিদায় ব্যাথা সামলাচ্ছিল। নিরব, নির্বাক, নিয়ন্ত্রিত আওয়াজের কান্নায় গাল বেয়ে মোটা জলের ধারা এসে আঁচল ভিজিয়ে দিল।
‘কান্দেন না। গুয়া খান’ – সহযাত্রী প্রতিবেশি হিন্দু মহিলাটি (যে প্রথমে উঠেই সান্ত্বনা দিয়েছিলেন) দু-টুকরো কাঁচা সুপারি আর দুটি গাছ পান মহিলাটির হাতে গুঁজে দিলেন। বললেন, ‘হাসি হাসি যাও, আল্লাক ডাকো, উমঅরায় দেইখবে’। ‘বইন হামার বাড়িত আসিস বোল দেখিস বোল’ — ‘আসিম’ — আর্তিতে দু’জন দু’জনের হাত ধরলেন।
পাতলা, শুধু পেশি দিয়ে তৈরি কালো চিক্কন লোকটির বয়েস ৪০-৪২ হবে হয়তো। একটি চিকন জলের ধারা কখন যে ওনার গাল বেয়ে নামতে শুরু করেছে উনি বুঝতে পারেননি। স্ত্রী কন্যা নিয়ে এই প্রথম যাচ্ছেন বাইরে। জানলা বরাবর চুপচাপ তাকিয়ে আছেন সবুজ প্রান্তরে। পাশে সেই ধুবরিগামী ছেলাটি এসে ওনাকেও একই প্রশ্ন দিয়ে শুরু করলেন –
-‘হ্যাঁ দাদা ভোট বিরাইলে গেলু হয়?’ উত্তরে লোকটি ওনার স্ত্রী মতো উত্তর দিলেন
-‘হামরা এলা ঋণোত পরছি। মোর ভোট ভাল এ না লাগে। কি হইবে ভোট দিয়া?’
-‘হ্যাঁ সেইটা ঠিক-এ কথা। হামরা কি করি? কাক ভোট দ্যাঙ্গ আর কাক না দ্যাঙ্গ। তা ওটে যায়্যা ফোন করেন বোল।’
-‘তোর নম্বরখান দে। ওটে যায়্যা ফোন নেমো তার বাদোত তোক ফোন করিম।’
একটু পরে মেয়েটি মায়ের কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। মহিলাটিরও চোখ বুঁজে আসে।
লোকটিকে আমি জিজ্ঞেস করলাম —
-‘আপনারা কি কাজে যাচ্ছেন?’
-‘হ্যাঁ’
-‘কোথায় যাচ্ছেন?’
-‘ব্যাঙ্গালোর’
-‘ওখানে থাকবেন কোথায়?’
-‘কোম্পানি থাইকবার ব্যাবস্থা কইরবে। খাওয়া দাওয়া হামার নিজে জোগাড় করা খাইবে’।
-‘মেয়েটি কি করবে?’
-‘থাইকবে হামার সাথে। হামাক হেল্প করবে। সাইডের কাজ তো’।
-‘মজুরী কত করে দেবে?’
-‘২০০ টাকা’।
-‘কম হয়ে গেল না?’
-‘না, মজুরী ফর শো’ (for show) আসলে ঠিকাদারের কাছ থাকি কাজ কন্ট্রাক্ট নেমো। তাতে দুই হাজিরা-তিন হাজিরা পরি যাবে’।
-‘মেয়েটির পড়াশুনা?’
-‘ক্লাস ফোরোত পড়ে তো, মাষ্টারোক কয়া নিছি’।
-‘কাজ সেরে কতদিন পর ফিরে আসবেন?’
-‘ঝামলাত পইড়লে তাড়াতাড়ি আসমো, না হইলে কোন দিন আসম এলায় জানি না’।
Leave a Reply