তাপস কুমার ঘোষ, বেনিগ্রাম, মেমারি ২নং#
আমার এখন পাঁচ বিঘায় চাষ। সাড়ে তিন বিঘেতে আলু চাষ করেছি আর দশ কাঠায় সর্ষে দিয়েছি। বোরো চাষ করি না, ঠিকে-ভাগে দিই এক বিঘে। বর্ষার চাষ আমনটা করি। আমার বাঁধা লেবার আছে, তাদের পয়সা দিয়ে সারা বছর রাখতে হয়। এরা গ্রামের লোক। মজুরি ১৩০ টাকা অথবা দু-কেজি চাল আর ৯০ টাকা। কাজ ম্যাক্সিমাম ছ-ঘণ্টা। আটটা থেকে কাজে লাগে, সাড়ে বারোটা পর্যন্ত, তারপর খেতে যায়। রোয়ার সময় ছ-গন্ডা বীজ ভেঙে পুঁতে দেবে, একটা লেবারের মজুরি হয়ে গেল। সে কাজটা করতে ঘণ্টা তিনেক সময় লাগে।
অঘ্রাণ মাসের দশ তারিখ থেকে চারদিনে লাগিয়েছি। এবারে একটু লেট হয়ে গেল। বৃষ্টি হয়ে গেল। মাটিটা হালকা করে দিয়ে চাপান-টাপান দিয়ে হাত-লাঙলে টানা দিয়ে দিচ্ছে। ফাল্গুন মাসের ২০-২২ তারিখের পর থেকে আলু তোলা হয়েছে। কাঁচা আলু আমাদের হয় না। আমাদের হয় জ্যোতি, চন্দ্রমুখী। কাঁচা আলু হয় এস-ওয়ান, পোখরাজ বীজে, অল্প সময়ের মধ্যে হয়। ওগুলো স্টোরে রাখা যায় না, পচে যাবে। ওটা আছে কিছু কিছু মুন্সিডাঙা, আসাদপুর, শ্রীধরপুর, শঙ্করপুরে। মেমারিতে জ্যোতিটাই বেশি, চন্দ্রমুখী লোকে একটু-আধটু খাওয়ার মতো লাগায়।
বাইরে থেকে লেবার আগে আসত, এখন কম আসে। এখন একশো দিনের কাজ আছে। তখন ফাল্গুন মাসে কাজ থাকত না। পুরুলিয়া, নদিয়া, মালদা, মুর্শিদাবাদ থেকে ওরা নিজেরাই চলে এসে বাজারে বসে থাকত, সেখান থেকে লোকে সব নিয়ে যেত। যখন দাদা আর আমি একসঙ্গে চাষ করতাম, আমাদের বাড়িতে ওরা আসত। একবছর হয়তো এল, পরের বছর থেকে আসতেই থাকত। আসার জন্য বলতে হত না, ওরা ঠিক সময় মতো চলে আসত। এদের মধ্যে আদিবাসী আছে, পূর্ববঙ্গীয় আছে, মুসলিমও আছে। মহিলাও থাকত। বাঁশ-খড় দিতে হয়। ওরা ঘর বানিয়ে নেয়। এখন আর খুব একটা আসে না। রেট একই। জ্বালনটা দিতে হত। গ্রামের দোকান থেকে মশলাপাতি-তেল-নুন কিনে ওরা রান্নাবান্না করে নিত। আলু তোলা শেষ হয়ে গেল। চলে যেত। আবার বোরো ধান কাটার সময় আসত। ধান কেটে তুলে ঝেড়ে দিয়ে চলে যেত। এখন গ্রামের লেবারদের দিয়েই আলু তোলা হচ্ছে। আমার হয়ে গেল, তারপর আর একজনের কাটল, এইভাবে চলে। যখন মাঠের কাজটা চলে তখন একশো দিনের কাজ বন্ধ থাকে। পঞ্চায়েত থেকে প্ল্যানিং হচ্ছে, একশো দিনের কাজ তখনই করানো হবে, যখন চাষির কাজ নেই।
আলু ওঠার পর বাজার স্টার্ট হল ২৫০ টাকা/বস্তা থেকে। তখন খদ্দের নেই খদ্দের নেই রব। তখন তো বিক্রিবাটা হয়নি। এবারে বাজার কেটে কেটে ২০০ টাকায় এল। প্রতিদিন ১০ টাকা ২০ টাকা করে রেট নামিয়ে দিয়েছে। এবারে বিক্রি শুরু হল। এইভাবে ১৬৫ টাকা পর্যন্ত বাজার নামিয়ে দিয়েছে। সরকার কেনার কথা ঘোষণা করার পর ওই ১৬৫ থেকে আবার ১৯০-২০০ টাকায় রেটটা উঠল। তাতে আলুটা বিক্রি করে লস আটকানো গেল। তবে মেমারিতে সরকারের কাছে আলু কেউ বিক্রি করতে পেরেছে বলে জানা নেই
যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো, ক্যাশ পয়সা আছে, তার আলুটা রাখার ক্ষমতা আছে। সে কোল্ড স্টোরে যায়। তাতে তার কোনো কোনো বছর লাভ হয়, আবার কোনো কোনো বছর লোকসানও হয়। আমি ২০০৪ সালে লাস্ট স্টোরে আলু রেখেছিলাম। তার আগে দাদা করত, আমিও চোদ্দো বছর দাদার সঙ্গে ব্যবসা করেছি। লাইন-টাইন সবই জানা ছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে আমার বিরাট লোকসান হল। ৭ টাকা বস্তা আলু বিক্রি করতে হল। মালটা স্ট্যাক হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে আর স্টোরে আলু রাখি না।
Leave a Reply