সাজিশ জি পি, কেরালা, ২৭ অক্টোবর। লেখক জুন ২০১৩ বিপর্যয়ের আগে ৬ বার গেছেন কেদারনাথ, ট্রেকার পর্যটক হিসেবে। বিপর্যয়ের পর ১৩ অক্টোবর তিনি ফের যান কেদারনাথ। ফিরে এসে ২৭ অক্টোবর তাঁর ব্লগে (http://indiegenous.blogspot.in/2013/10/context-picturesque-uttarakhand-state.html) ইংরেজিতে লেখেন এইবারের যাত্রার সচিত্র বর্ণনা, ‘ব্যাক টু কেদারনাথ, এ ভ্যালি অব ডেথ’। এখানে তার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে, লেখকের অনুমতিক্রমে। অনুবাদক শমীক সরকার। #
১|
৫ অক্টোবর থেকে উত্তরাখণ্ড সরকার দৈনিক সর্বাধিক ২০০ জন মানুষকে কেদারনাথ যাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। আমি ট্রেকার তিলক-এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলাম, কেদারনাথ যাওয়া যায় কি না তার জন্য। এই সুযোগে রওনা দিলাম। ১৩ অক্টোবর আমরা গুপ্তকাশী পৌঁছালাম, সেখানে পারমিট নেওয়া এবং স্বাস্থ্য চেকআপের বন্দোবস্ত ছিল। আমরা মোট ৭ জন ছিলাম, তার মধ্যে একজন ছিল ১৭ জুনের ধ্বংসকাণ্ডে কেদার থেকে বেঁচে ফেরা, নাম সুশান্ত।
গুপ্তকাশী পর্যন্ত আসার পথটিও ভালো ছিল না, বিপর্যয়ের চিহ্ন ছড়িয়ে ছিল সেখানকার সর্বত্র। যাই হোক, গুপ্তকাশী থেকে সকালে রওনা দিয়ে এগারোটার মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম রামপুর, গৌরীকুণ্ড (আগে যেখান থেকে কেদারনাথ যাওয়ার জন্য ১৪ কিমি হাঁটা শুরু হত) থেকে কিছুটা আগের একটি মিনি শহর। রামপুরে নজরে পড়ল পরিত্যক্ত দোকানপাট, সেলুন। একটু উঁচুতে সীতাপুরে পার্কিং লটে পড়ে রয়েছে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া গাড়ির কঙ্কাল। কেদারনাথের জন্য পায়ে হাঁটা পথ এখন শুরু হচ্ছে শোনপ্রয়াগ থেকে, যা গৌরীকুণ্ডর সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার আগে। তাই মোট হেঁটে যেতে হবে ২০ কিলোমিটারের কিছু বেশি।
শোনপ্রয়াগে পড়ে রয়েছে ভাঙাচোরা গাড়িগুলো, গায়ে ‘লাপতা’ লাগানো পোস্টার। এখান দিয়ে যেতে যেতে আমার নাকে বিশ্রী গন্ধ লাগছিল। ভাবলাম আমার মনের ভুল, তাই পাশের তিলক আর বিজেন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলাম। ওরাও বলল, গন্ধ পাচ্ছে। অর্থাৎ এখানেও ধ্বংসস্তূপের নিচে কিছু মরা মানুষ বা পশু রয়ে গেছে এখনও, ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে সেগুলোকে যথাযথভাবে সমাধিস্থ করা হয়নি। এই গন্ধ গোটা যাত্রাপথেই আমার নাকে লেগে ছিল।
শোনপ্রয়াগ হল দুটি নদীর সঙ্গমস্থল — বাঁদিকে রয়েছে শোনগঙ্গা, আর ডানদিকে মন্দাকিনি। সেখানে একটা বিশাল লোহার ব্রিজ ছিল। এখন তার চিহ্নমাত্রও নেই। আমরা শোনপ্রয়াগ থেকে ট্রেক শুরু করলাম দুপুর ১২টায়। আগে গাড়ি চলার রাস্তা ছিল গৌরীকুণ্ড পর্যন্ত। এখন রাস্তাটার বেশিরভাগটাই আর নেই। শোনপ্রয়াগ থেকে আমরা পায়ে হেঁটে এলাম গৌরীকুণ্ড পর্যন্ত সেই রাস্তা ধরে, যেটা দিয়ে আগে খচ্চরদের নিয়ে যাওয়া হত গৌরীকুণ্ড। বিপর্যয়ের আগে সিজনে দিনে পাঁচ থেকে দশ হাজার খচ্চর জড়ো হতো গৌরীকুণ্ডে। গাড়ি যাওয়ার রাস্তার থেকে আলাদা একটি রাস্তা তৈরি করতে হয়েছিল এত খচ্চর নিয়ে যাওয়ার জন্য। যারা হাঁটতে পারে না বা চায় না, তাদের এই খচ্চরে করে কেদারনাথ অবধি পরিবহণের ব্যবস্থা ছিল। খাড়া উঠে যাওয়ার কারণে এই রাস্তাটা ট্রেকারদের পক্ষেও সহজ নয়। গৌরীকুণ্ডের দিকের গাড়ি রাস্তা, যার বেশিরভাগটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, সেটাতে দূর থেকে দেখলাম, কিচু পরিত্যক্ত বাস ও প্রাইভেট গাড়ি। ভাঙাচোরা, এবরো খেবরো। এদের হৃদয় থাকলে এরা বলে উঠত, কিছুই তো হয়নি আমাদের। কারণ হাজার হাজার গাড়ি এই রাস্তা থেকে ভেসে গেছে।
গৌরীকুণ্ড পৌঁছে দেখলাম, অর্ধেক শহরটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। গরম জলের ফোয়ারাটা নেই। মন্দিরগুলো নেই। পড়ে আছে কিছু পরিত্যক্ত দোকানপাট। এই গৌরীকুণ্ডে হাজার হাজার মানুষ চলে ফিরে বেড়াত। রাস্তায় জায়গা পাওয়া দায় হত। ভক্তিমূলক গানে ম ম করত জায়গাটা। দোকানে দোকানে বিক্রি হত ‘চারধাম ডিভিডি’, শীতের পোশাক, খাদ্য, পান, অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং আরও কত কী। এখন কানে তালা ধরা নৈঃশব্দ। আরেক অর্থনৈতিক দুঃস্বপ্ন। কয়েকটা খচ্চর শুধু প্রস্তুতি নিচ্ছে ওপরে যাওয়ার জন্য। বেলা দুটোয় আমরা গৌরীকুণ্ড পৌঁছালাম। দু-ঘন্টায় পাঁচ কিমি চড়াই, খারাপ নয়। আমরা আজ পৌঁছাব ভীমবালি। আরও ৭ কিমি দূর। আগে লোকে গৌরীকুণ্ড থেকে কেদারনাথের জন্য হাঁটতে শুরু করে থামতে হত রামবড়াতে। এখন রামবড়া নয়, থামতে হচ্ছে ভীমবালিতে। রামবড়াতে কিছু ডুলির ধংসাবশেষও দেখা গেল। কেদারনাথ যাওয়ার জন্য কেউ হাঁটত, কেউ ঘোড়ায় চাপত। কেউ আবার যেত এই পালকিতে। চারজন বয়ে নিয়ে যেত একজনকে।
গৌরীকুণ্ডে একটুখানি চা বিস্কুট খেয়ে নিয়ে পরের ধাপের জন্য রওনা দিলাম। দূরে দেখা যাচ্ছে কেদারনাথের পুরোনো ট্রেক রুট। রাস্তায় ইতিউতি পড়ে থাকতে দেখা গেল, খোলা প্রণামী বাক্স, পুজোর উপাচারের লাল থানকাপড়ের অংশ। আর পুরোনো রাস্তার আশেপাশে আগে যে ধাবাগুলো ছিল, যেখানে ট্রেকাররা খাওয়া দাওয়া করত, তার ধ্বংসাবশেষও নজরে এল। দূরে একটা ঢালু পাথরের মাঝখানে নজরে এল একটা আটকে পড়া জ্যান্ত ভেড়া। কীভাবে ওখানে চলে গেছে! নিশ্চয়ই বাসা খুঁজে পাবে। এক কিলোমিটার যাওয়ার পরে আমাদের পুরোনো ট্রেক রুট-টা ছাড়তে হল। কারণ ওটার আর অস্তিত্ব নেই। বেশ কিছুটা চড়াই ভেঙে নয়া ট্রেক রুটে পৌঁছাতে আমাদের বেশ কষ্টই হচ্ছিল।
রাস্তায় আমরা দেখলাম, উদ্ধারকারীদের একটি হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ। এখানে ভেঙে পড়েছিল কপ্টারটা। কপালজোরে খাদের মধ্যে না পড়ে রাস্তার ওপর পড়েছিল বলে সওয়ারীরা বেঁচে যায়। পাহাড়ে তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে হয়ে যায়, সন্ধ্যে নেমে আসছিল। চারদিকে যেদিকেই চোখ যায়, ভূমিধসের চিহ্ন সর্বত্র। তবে গত কয়েক মাসে, অথবা কয়েক লক্ষ বছরে যা বদলায়নি, তা হল হিমালয়ের সৌন্দর্য। আমার মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব হচ্ছিল, কেন এসেছি আমি, হিমালয়ের সৌন্দর্যের টানে, নাকি কেদারনাথে কী হয়েছিল তা খুঁজে পাওয়ার টানে। দুটোই। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যে ছ-টার সময় আমরা পৌঁছালাম ভীমবালি ক্যাম্পে। এখান থেকে একটা নধর ভুটিয়া কুকুর আমাদের সঙ্গী হয়েছিল।
২|
এই ভীমবালি ক্যাম্পের যেখানে আমরা ছিলাম, সেটার যে মালিক সে গুপ্তকাশির লোক। এই তল্লাটের বেশ কয়েকটি হোটেল আর দোকানের মালিক ছিল সে। এখন সে কেবল এই ক্যাম্পটি চালায়, আর তার খুব একটা কিছু পড়ে নেই। আমি তাকে চিনতে পারলাম, আজই সকালে গুপ্তকাশিতে তার ওষুধের দোকান থেকে কয়েকটা পেনকিলার কিনেছিলাম। ভীমবালিতে একটা হেলিপ্যাডও নজরে এল।
ভীমবালিতে আমরা মোট তিরিশ জন মতো ছিলাম সেই রাতে। একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো, স্বামী সুশান্ত। আমাদের সঙ্গেই এসেছে গুপ্তকাশী থেকে। ১৭ জুনের সকালে যখন কেদারের ওপর ৭০ ফিটের জল-পাথরের পাহাড় নেমে এসেছিল, সে ছিল সেখানে। মন্দিরের সামনের নন্দী স্ট্যাচু আঁকড়ে ধরে সে এবং আরও কয়েকজন বেঁচে গিয়েছিল। সবচেয়ে বড়ো ঢেউটা চলে যাওয়ার পর কী হয়েছিল বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর চোখে জল চলে এল। চারিদিকে দেহ আর চিৎকার। কিন্তু তাঁর যেটা সবচেয়ে বেশি মনে আছে, ধ্বংসস্তুপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা একটা হাত আর চিৎকার। তাঁর কথায়, ‘আমি তাকে বাঁচাতে পারতাম না কোনওভাবেই। কেবল পরম করুনাময়ের কাছে এই প্রার্থনা করতে পেরেছিলাম, লোকটা যেন দ্রুত মারা যায়’।
ভীমবালিতে থাকা খাওয়া ফ্রি, সরকারি উদ্যোগে। নিরামিশ রান্না। সে রাত্রে তাঁবুতে শুয়ে মনে হলো, আমি রেডক্রশের তাঁবুতে শুয়ে আছি। খুব সম্ভবত রেড ক্রশ এই তাঁবুটি দিয়েছিল, ওই বিপর্যয়ের সময়ে। এই ‘সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা’র তীর্থযাত্রায় তা কী করছে? আমি রাতের আশ্রয় পেয়েছি, তাই নিন্দা করতে চাই না, কিন্তু সরকার তার মুখোজ্জ্বল করার জন্য কত নিচে নামবে?
পরদিন সকাল ৬টার মধ্যে উঠে পড়লাম সকলে। ঠিক করলাম তিন কিলোমিটার দূরে লিনচৌলি-তে প্রাতরাশ করব ঠিক করলাম। কয়েকশ’ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছলাম রামবরা, যে শহরটা একসময় কয়েক হাজার লোককে ধারণ করত। যেদিন বিপর্যয় হয়েছিল, সেদিন হাজার তিনেক লোক এখানে ছিল বলে অনুমান। এখন এখানে কোনও কিছুর চিহ্নমাত্র নেই। সমস্ত শহরটি উৎপাটিত হয়েছে এবং নিচের নদীতে পড়ে গেছে। ১৬ জুন রাত্রির বিপর্যয়ে এর পতন শুরু হয়। পরদিনের সকালের বিপর্যয়ে শেষ হয়। যারা বেঁচে গিয়েছিল, তারা ওপরে উঠে গিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের বেশিরভাগই মারা গেছে ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, ঠাণ্ডায়, ভূমিধ্বসে … কেউ তার হিসেব রাখেনি। বেশিরভাগ তীর্থযাত্রীই গরীব। তাদের কাছে সেরকম কোনও শীতবস্ত্র নিশ্চয়ই ছিল না। পুরনো ট্রেকিং রুটের দুদিকই ভেঙে গিয়েছিল। ফলে যারা ওপরের জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়ার জন্য গিয়েছিল, তাদের ওপরে ওঠার বা নিচে নামার কোনও পথ ছিল না। রামবরা থেকে নতুন রাস্তাটি সম্পূর্ণ আলাদা, আমরা মন্দাকিনি নদী পেরিয়ে এপারে চলে এলাম, একটা কোনওমতে দাঁড় করানো সেতু পেরিয়ে। নতুন রাস্তায় বেশ কয়েকটা খাড়া চড়াই রয়েছে। লিনচৌলিতে পৌঁছলাম সকাল দশটায়। ওখানেও আশ্রয় নেওয়ার জন্য রেডক্রশের তাঁবু। পুলিশ এবং শান্তি কুঞ্জ ফাউন্ডেশন যাত্রীদের খাওয়াচ্ছে। প্রশাসন সম্ভবত শান্তি কুঞ্জ ফাউন্ডেশনকে বলেছে, একটু কমসম করে খাওয়াতে, নাহলে সরকারকে তাদের কৃতিত্বের ভাগ দিতে হয়। নয়া ট্রেকিং রুট ধরে চলতে চলতে আমরা দু-তিন জায়গায় ডিনামাইট ব্লাস্টিং-এর শব্দ পেলাম, এই নয়া রুট তৈরির কারণে ব্যবহার হচ্ছে। মনে হল, পুরো এলাকাটাই তাতে কোনদিন উড়ে যেতে পারে। আস্তে আস্তে চূড়াগুলো স্পষ্ট হচ্ছিল, রাস্তায় যেতে যেতে দূরে উপত্যকায় নজরে এল একটি হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ।
অনেকক্ষণ চলার পর একটা খাড়া চড়াই টপকাতেই সোজা রাস্তা। রাস্তায় পড়ল একটা সুন্দর ছোটো জলাশয়। গ্লেসিয়াল লেক। দুপুর একটায় পৌঁছলাম কেদারের এক কিলোমিটার আগের চূড়ান্ত ক্যাম্পসাইটে। ক্যাম্পে ব্যাগ রেখে আমি আস্তে আস্তে কেদার শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে গত কয়েকদিন ধরে আমরা যা শুনেছি, তা মনে পড়ছিল। বাসুকি তালের দিকে নাকি কয়েকশ’ মৃতদেহ এখনও পড়ে রয়েছে। কেদারের আশেপাশের পাহাড় ডিঙিয়ে যারা পালাতে গিয়েছিল, তাদের মৃতদেহ। সম্ভবত কোনওদিনই সেগুলো পরিষ্কার করা হবে না। কিছু মানুষ নাকি আশ্রয় দেবার বিনিময়ে যৌনসম্ভোগ করতে চেয়েছে, টাকা চেয়েছে। হোটেল মালিকরা কেদারের হোটেলের ধ্বংসস্তুপ পরিষ্কার করতে এসে গাদাগাদা মৃতদেহ পেয়েছে। এক সাধুবাবা হেলিকপ্টারে নিরাপদ আশ্রয়ে আসার সময় তার ঢোলোকটা ফেলে আসতে চায়নি (পুলিশ সন্দেহবশত ওই ঢোলোকটি ছিঁড়ে ফেলতেই কোটি কোটি টাকা পায় তার মধ্যে)। বাবা-মায়ের কাছ থেকে ছেলে মেয়েদের নেওয়া হয়েছে, টাকা নেওয়া হয়েছে, হেলিকপ্টারে করে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, এই আশ্বাস দিয়ে। কিন্তু তারপর নাকি আর তাদের খোঁজ মেলেনি। একজন পশুপালক নাকি একটি মেয়েকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে ধর্ষণ করে গেছে, তারপর একদিন মেয়েটি তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। কিছু মানুষ নাকি মৃতদেহগুলি তন্নতন্ন করে হাতড়েছে, মূল্যবান সোনা বা অন্যান্য ধাতুর খোঁজে। একজন লোক নাকি একটা আঙটির জন্য একটি মৃতদেহের আঙুল কেটে নিয়েছিল, একজন পাপ হবে বলাতে সে বলেছিল, ‘ও আরও বেশি পাপী, তাই মরে গেছে’। কিছু এনজিও ট্রাক নাকি যেখানে দরকার নেই, সেখানে ত্রাণসামগ্রী ফেলে চলে গেছে। সুশীল নামে একজন জিজ্ঞেস করছিল, ‘কি করে মানুষ এই বিপর্যয়ের সময়ে এত নিচে নামতে পারে?’ নিশ্চয়, বিপর্যয়ের সময়ে মানবিক সহযোগিতাই বেশি। এবং এগুলো সব ব্যতিক্রম। কিন্তু ব্যতিক্রমগুলোও ভাবায়। মানুষ তো মানুষ, শেষ বিচারে।
ওপরের ছবিতে বাঁদিকে একটা মোড়ের মতো অংশটি থেকে ওপরের দিকে গেলে চোরাবারি তাল তথা গান্ধী লেক। ওখান দিয়েই ১৭ জুন সকালে নিচের কেদার শহরের ওপর নেমে এসেছিল বিপর্যয়। অনেক লোক পালিয়ে চলে গিয়েছিল ভৈরব মন্দিরের দিকে। তারা বেঁচে যাওয়ার কথা। কেদারের বাঁদিক দিয়ে ছোট্টো দুধ গঙ্গা নদী গেছে। সে বাঁদিক থেকে ধাক্কা মেরেছিল। সামনাসামনি এসেছিল মন্দাকিনি। আর ডানদিক দিয়ে সরস্বতী। এই সরস্বতী নদীটি ছিল লিকলিকে সরু। কিন্তু জুনের বিপর্যয়ে এটি বদলে গেছে, ফুলে ফেঁপে উঠে প্রবাহিত হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। এভাবেই ভূগোল তৈরি হয়, তার সাথে ইতিহাসও। আগে যতবার কেদার এসেছি, মন্দাকিনি নদীর ওপরের লোহার বিশাল ব্রিজটা পেরিয়ে, সেই ব্রিজের ওপরের লোহার ঘন্টাটা বাজিয়ে কেদার শহরে ঢুকেছি। এবার ঢুকলাম আমি সরস্বতী নদীর ওপরে বানিয়ে নেওয়া একটা পলকা ব্রিজ পেরিয়ে, যেটা একসাথে একাধিক লোক পেরোলেই ভেঙে যাবে বলে মনে হলো। শহরে ঢুকতেই আমার মনটা বদলে গেল।
৩|
ভেবেছিলাম, এই শহরটার ধ্বংসস্তুপ সরানো হয়েছে বুঝি। মৃতদেহ খুঁড়ে বের করে সৎকার করা হয়ে গেছে। আসার পথে অনেকেই বলেছিল, ওসব কিছুই হয়নি। কিন্তু এই অবস্থা হয়ে আছে, তা ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারিনি। কি করে কেউ এই ধ্বংসস্তুপে তীর্থ যাত্রা পুনরারম্ভ করে? হোটেল এবং ধর্মশালাগুলোর একতলাগুলো বালি ভর্তি। এবং সেখানে লোকের মৃতদেহ রয়েছে। দূর থেকে যখন মন্দিরটিকে দেখতে পেলাম, আশেপাশের দিকে তাকিয়ে একটা কথাই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, কবরখানা।
দেড়টা নাগাদ যখন মন্দিরে পৌঁছলাম, তার একটু আগেই মন্দির ঘন্টাধ্বনি হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। আমার দর্শন বাদ দিয়েই। বাহ্ । একজন পুরোহিত মন্দিরে পুজো দেওয়াতে অস্বীকার করল, কারণ আমাদের কারোর গায়েই পুজো দেওয়ার জন্য পবিত্র পোশাক পরা ছিল না। হিন্দু ধর্ম! আমি মনে মনে বললাম, যথেষ্ট শিক্ষা তোমার হয়নি কি এখনও? প্রকৃতি (অথবা ঈশ্বর, তুমি যদি তা বলতে চাও) মানুষে মানুষে ফারাক করে না, যখন সে তার ধ্বংসের রূপে নেমে আসে। মনে হয় টাকা দিয়েই এই ধর্মীয় আচার টপকানো গেল সে যাত্রা। পুজোর একধারে আমি বসেছিলাম, যা দেখছি তা সম্পর্কে ভাবছিলাম। তিলক পবিত্র পোশাকে ‘হাভান’ দিল (আগুনের সামনে বসে ধ্যান)।
পুজো শেষ হলে মন্দিরের উল্টো দিকে গেলাম, ‘পবিত্র পাথর’ দেখতে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘দিব্য শিলা’। ঐ পাথরটার জন্যই মন্দিরটা ধ্বংস হওয়া থেকে বেঁচে গেছে। বোল্ডারগুলি আটকে গেছে ওটাতে। তাই ওটাকে লোকে ভাবছে, মন্দিরটাকে বাঁচানোর জন্য দেবতার পাঠানো পাথর। আমি দেখলাম। ওই বড়ো পাথরটার আর মন্দিরের মাঝখানে অনেকগুলো ছোটো ছোটো পাথর। তার মানে, ওই ছোটো পাথরগুলোই বড়ো পাথরটাকে আটকেছে, না হলে ওই বড়ো পাথরটা মন্দিরটাকে গুঁড়িয়ে দিত। আমি ভুল হতে পারি, কিন্তু এটাও ঠিক, বিশ্বাসে পদার্থবিদ্যার স্থান নেই। কয়েক শতাব্দী আগেই গ্যালিলিও তা আবিষ্কার করেছিলেন।
কেদার মন্দিরটা আশেপাশের মাটি থেকে চার পাঁচ ফুট ওপরে ছিল। এখন সেটা সমান হয়ে গেছে, মানে চার পাঁচ ফুট মাটি-পাথর এখানে জমেছে। গোটা শহর মোটামুটি পাঁচ ফিট বালি-পাথর-মাটির নিচে। হতেই পারে, এর নিচে রয়ে গেছে মৃতদেহ। সমস্ত বিল্ডিং-এর একতলা বালি পাথরে ঠাসা। সেখানেও থাকতে পারে মৃতদেহ। কেউ যদি মনে করে, আমি বানাচ্ছি, না। মন্দিরের মূল রাস্তার থেকে একটু দূরের বাড়িগুলো থেকে এখনও পচা গন্ধ আসছে। কোনো লুকোছাপা নেই।
আমরা একটু ঘোরাঘুরি করতেই কিছু লাশ (হাড়গোড়) নজরে এল। নিচের ছবিতে এরকমই একটি লাশ, সম্ভবত কোনও মহিলার, কাপড় চোপড় দেখে সেরকমই মনে হচ্ছে। মনের রাখুন, আমরা কিন্তু মোটেই মাটি খুঁড়িনি, কেবল ঘোরাঘুরি করেছি মাত্র। একজন হোটেলওয়ালা এখানে এসেছিল, তার হোটেলের একতলার মাটি খুঁড়ে সরাতে। একটা মৃতদেহ সেখানে দেখে সে পিঠটান দিয়েছে। আরেকজন হোটেলওয়ালার সঙ্গে পরিচয় হলো। তার হোটেলটি এখানে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। আট হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে সে।
সবাই চারটের মধ্যে মন্দির চত্বর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আমি আরও কিছুক্ষণ বসেছিলাম। ফেরার পথে লস এঞ্জেলেস টাইমস পত্রিকার প্রাক্তন সাংবাদিক রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আমরা রাতে যে তাঁবুতে ছিলাম, সেখানে সেও ছিল। আমরা কতগুলি বিষয়ে একমত হলাম, প্রকৃতি তো সবার প্রতিই সমান নির্মম। আরও খারাপ হলো, যারা বেঁচে আছে তাদের সঙ্গে আমরা কি ব্যবহারটা করছি। আরও খারাপ, যারা মারা গেছে, তাদের সাথে আমরা কি ব্যবহার করছি। তাদের মৃতদেহর ওপর দিয়ে আমরা তীর্থযাত্রা শুরু করে দিয়েছি।
৪|
১৯৯৮ থেকে আমি কেদারে আসছি। আর কখনও যাব বলে মনে হয়না। প্রশাসনের প্রতি আমার তিনটে সাজেশন : ১) এই তীর্থযাত্রার ঢেঁড়া পেটানো বন্ধ করো। ২) আর্মি/ বিআরও/এনআইএম -কে এলাকাটা ছেড়ে দাও। তারা সমস্ত অপ্রয়োজনীয় বিল্ডিংগুলো মাটিতে মিশিয়ে দিক, জায়গাটা পরিষ্কার করুক। মৃতদের সৎকার করো। জ্যান্তদের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দাও। তারপর সারা পৃথিবীকে জানাও, আমরা করেছি। ৩) ক’জন মারা গেছে, তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করার চেষ্টা করা হোক। সব খুঁরে ফেলার আগে মৃতদেহ গোনা বন্ধ কোরো না। আমার কথা — মৃত ২০ হাজারের বেশি।
আমার ভবিষ্যৎবাণী, ২০১৪ সালের বর্ষা আরও ভয়ঙ্কর হতে চলেছে। দুটি নদী দু-দিক থেকে এলাকাটিকে আঘাত করবে। আর যারা কেদারনাথে আসার কথা ভাবছেন, তাদের জন্য আমার একটা উপদেশ — এটা কেদার নাথ নয়, কবরস্থান … ।
Sajish says
Hi Samik Sarkar,
Thank you so much for taking the time to translate my blog. I hope the message reaches a lot more people through your effort. It’s important that people know what’s happening out there.
Thanks again,
Sajish
Shamik Sarkar says
Hi Sajish,
The print fortnightly has carried a part on 1 november issue, and the rest will be on 16th novemebr issue. Will e-mail you scanned copies. Regards.
Shamik