প্রদীপন ও রঞ্জিত, শিলিগুড়ি, ২৯ নভেম্বর#
“ |
প্রশাসন যদি আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে আমরা আর কী করব বলুন। আমরা কেউই তো প্রশাসনের ঊর্ধ্বে নই |
রঞ্জিত, শ্রমিক |
শিলিগুড়ি শহরের সেবক রোডে ‘বাজার কলকাতা’ কাপড়ের দোকানের শো রুম স্থাপিত হয়, ২০০৭ সালের ১৯ মে। ২০ জন পার্মানেন্ট এবং ৭ জন ক্যাজুয়াল কর্মচারী নিয়ে চলা এই শিলিগুড়ি শো রুম টি ২০১৩ সালের ১২ আগস্ট আচমকা বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকদের বকেয়া বাকি রেখে এবং তাদেরকে অথই জলে ফেলে দিয়ে রাতের অন্ধকারে মালিকপক্ষ পালিয়ে যায়।
অগ্নিমূল্য বাজারে নামমাত্র বেতন, আন্দোলনের সূত্রপাত
বাজার কলকাতার কর্মচারীরা নিজেদের শত দুর্দশা সত্ত্বেও একমাত্র কোম্পানির ব্যবসার স্বার্থেই নামমাত্র বেতনে কাজ করত। ন্যূনতম ২৪০০ টাকা এবং সর্বাধিক ৫৪০০ টাকা বেতনে কর্মচারীরা দিন রাত পরিশ্রম করত। কর্মচারীদের মুখ থেকে শোনা গেল যে — এই বাজারেও কারো ৬ হাজার টাকা বেতনও হয়নি। কর্মচারীরা ম্যানেজমেন্টকে বারংবার অনুরোধ করেছিল যে তাদের বেতন বাড়ানো হোক। কিন্তু তাদের এই দাবির প্রতি কর্ণপাত করা হয়নি। তাও তারা মুখ বুজে ছিল। একমাত্র ম্যানেজমেন্ট-এর প্রতি আস্থা রেখে। কিন্তু যখন তারা দেখল, কোম্পানির ব্যবসা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন ৩১ মে ২০১৩ তারিখে তারা কতগুলো ন্যায্য দাবির ওপর ভিত্তি করে একটি ডেপুটেশন দেয় ম্যানেজারকে। দাবিগুলি হল বাজারদর অনুযায়ী বেতন দেওয়া, আটঘন্টা কাজের মেয়াদ স্থির করা, জাতীয় ছুটির দিনগুলোতে ছুটি দেওয়া। ইনসেনটিভের পরিমাণ বৃদ্ধি করা।
মালিকের হয়ে পুলিশের চোখ রাঙানি
শ্রমিকদের আন্দোলন যখন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকল, তখন নেমে আসল মালিকপক্ষের হামলা, এবং তাতে যুক্ত হল পুলিশ প্রশাসন। পুলিশ সরাসরি মালিকের হয়ে কাজ করল। শো রুমে গিয়ে শ্রমিকদের হুমকি দিল এবং আন্দোলন থেকে বিরত থাকতে বলল। শ্রম দপ্তরও মালিকপক্ষের হয়ে কাজ করল, এবং নির্লিপ্ত থাকল।
শ্রমিকেরা এই ত্রিমুখী হামলার মুখে দাঁড়িয়েও কিন্তু লড়াই থেকে সরে দাঁড়ায়নি। তারা নিজেদের সংগঠিত করে এবং বারংবার তারা প্রশাসনকে ডেপুটেশন দেয় এবং আন্দোলনের অন্যান্য রাস্তাগুলি অবলম্বন করতে থাকে, কিন্তু বধির প্রশাসনের কানে শ্রমিকদের আর্তনাদ পৌঁছল না।
আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে রাতের অন্ধকারে মালিকপক্ষের পলায়ন
জুলাই মাসের কুড়ি তারিখ যখন শ্রমিকেরা দ্বিতীয়বার ডেপুটেশন দেয়, তখন মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা ২৭ জুলাই আলোচনার প্রস্তাব দেয় শ্রমিকদের। শ্রমিকরাও রাজি হয়ে যায় মালিকপক্ষের এই প্রস্তাবে। কিন্তু মালিকপক্ষের গোপন উদ্দেশ্য শ্রমিকেরা বুঝতে পারেনি। ১২ আগস্ট ভোরবেলা মালিকরা দোকানের সমস্ত জিনিস সরাবার তোড়জোড় শুরু করে, শো-রুম বন্ধ করার জন্য। ক্যান্টিনের কর্মী অখিলেশ শিকদার বাধা দিতে যাওয়ায় মালিকপক্ষের লোক অতীশ সরকার এর নেতৃত্বে গুণ্ডাবাহিনী অখিলেশকে খুনের চেষ্টা করে এবং নির্মম প্রহার করে। তাকে বলে, ‘তোকে তুলে নিয়ে গিয়ে ফারাক্কায় ফেলে দেব’। তার এটিএম কার্ড, দিদির চিকিৎসার কাগজপত্র, নগদ টাকা সবই ছিনতাই করে নেয় মালিকপক্ষের গুণ্ডাবাহিনী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই অখিলেশ শিকদার দীর্ঘ সাত বছর বাজার কলকাতায় কর্মরত ছিলেন। শিলিগুড়ির সবচেয়ে ব্যস্ত রাজপথ সেবক রোডে এইভাবে শোরুম বন্ধ করাটা যে প্রশাসনের অগোচরে হয়েছে, তা কিন্তু বলা যাবে না। পরদিন অর্থাৎ ১২ আগস্ট শ্রমিকেরা বাজার কলকাতার সামনে জমায়েত হয় এবং অখিলেশ শিকদারের ওপর হামলাকারীদের শাস্তির দাবিতে এবং বাজার কলকাতার মালিকের গ্রেফতারের দাবিতে সোচ্চার হয়।
আজ নভেম্বর মাস শেষ হতে চলল, শ্রমিকদের করা এফআইআর-এর ওপর ভিত্তি করে পুলিশ কাউকে অ্যারেস্ট করেনি। শ্রমিকদের বেশিরভাগই অন্যান্য জায়গায় কাজে ঢুকেছে। বেশিরভাগ কাপড়ের লাইনেই ঢুকেছে। ২-৩ জন এখনও বেকার রয়েছে।
বর্তমানে অ্যালান সোলিতে কর্মরত, বাজার কলকাতার পুরোনো কর্মী রঞ্জিত জানালেন, ‘প্রশাসন যদি আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে আমরা আর কী করব বলুন। আমরা কেউই তো প্রশাসনের ঊর্ধ্বে নই।’
Leave a Reply