দীপংকর সরকার, হালতু, ১৯ সেপ্টেম্বর#
কলকাতা থেকে ২২৫ কিমি দূরে রামপুরহাট, রামপুরহাট থেকে ১৫ কিমি দূরে সুরুচিয়া মোড়। বাংলা ঝাড়খণ্ড সীমানা। ট্রেকারে করে আসা যায়। যে রাস্তায় রামপুরহাট থেকে বিহারের দুমকা বাসে যাওয়া যায়। সুরুচিয়া মোড় থেকেই হিন্দি সাইনবোর্ডের ছড়াছড়ি। এই মোড় থেকে বাঁদিকে ১০ কিমি দূরে এক আদিবাসী জনপদ এলাকা মুলুটি গ্রাম। শান্ত, স্নিগ্ধ গ্রামীণ পরিবেশ। পূর্বে নাম ছিল মল্লহাটি। যোগাযোগহীন ও লোকচক্ষুর অন্তরালে, বহুদূরে। সুরুচিয়া মোড় থেকে মুলুটি আসতে গেলে কোনো গরুর গাড়ি, সাইকেল ভ্যান, অটো, ট্রেকার বা বাস পাওয়া যায় না। মুলুটি আসতে গেলে স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে আসতে হয়। গণদেবতা এক্সপ্রেসে রামপুরহাট গিয়ে সুরুচিয়া মোড় পর্যন্ত ট্রেকারে যাওয়ার পর আর কোনো যোগাযোগের মাধ্যম নেই। মুলুটি যেতে গেলে তাই অনেকেই গাড়ি ভাড়া করে স্টেশন থেকে। আমি সুরুচিয়া মোড় থেকে বাঁদিক ধরে কেবল এগিয়ে চলেছি। চারিদিকে শুধু ধুধু প্রান্তর। দূরে একটি সরু পাকা রাস্তা দেখা যায়। এই স্থানে বহু বছর আগে এয়ারপোর্ট এলাকা ছিল। অনেকক্ষণ হাঁটার পর প্রধান সড়ক রাস্তায় উঠলাম। এক হোটেল মালিকের সাথে দেখা হল। তিনি মুলুটি গ্রামে থাকেন। তাঁর সাহায্যে এক বাইক আরোহীর পিছনে বসে পৌঁছে গেলাম মা মৌলীক্ষার মন্দির।
শ্রী শ্রী মাতা মৌলীক্ষার মন্দির। ASI দ্বারা সংরক্ষিত ও পরিচালিত। মৌলীক্ষা তারাপীঠের তারামায়ের সহোদরা ছিলেন বলে কথিত আছে। মৌলীক্ষা কথাটির উৎপত্তি দুটি শব্দ থেকে, মৌলী (মাথা) ও ইক্ষক্স (দৃশ্যমান)। মৌলাক্ষী মায়ের কোনো শরীর নেই, শুধু একটি লাল রঙের মাথা ল্যাটেরাইট পাথর দিয়ে তৈরি মন্দির গৃহের মেঝেতে শায়িত আছে। এখানে ভক্তরা পুজো দেয়। মন্দির প্রাঙ্গণে একটি শিবমন্দির, একটি বামাখ্যাপার সাদা মূর্তি বসানো মন্দির ও আর একটি মন্দির আছে। এই প্রধান মন্দিরের আশেপাশে সমগ্র মুলুটি গ্রামে ১০৮টি শিবমন্দির ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, এক মাইল এলাকা জুড়ে। বর্তমানে ৭২টি মন্দির অবশিষ্ট আছে। আমি কেবল ৪০টি মন্দিরই দেখতে পারলাম। শরীরে দিচ্ছিল না।
মুলুটি গ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে ১৫ শতকের গৌড়ের অধিপতি আলাউদ্দিন হুসেন শাহ-এর নাম বিশেষভাবে জড়িয়ে আছে। একবার গৌড়ের সুলতানের পোষা বাজপাখি হারিয়ে যায়। এই অঞ্চলের বসন্ত নামে এক যুবক সুলতানের সেই হারিয়ে যাওয়া পোষা বাজপাখিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। প্রতিদান স্বরূপ সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ মুলুটি গ্রাম বসন্তকে দান করেন। তখন থেকে সেই যুবক বসন্ত ‘বাজ বসন্ত’ নামে পরিচিত হন। বসন্তের উত্তরাধিকারীগণ পরে নিজেদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করে নেয় এবং নিজ নিজ সাধ্যমতো গুচ্ছ গুচ্ছ মন্দির নির্মাণ করতে থাকে। এখন ৭২টি মন্দিরের অবশিষ্টাংশই দেখতে পাওয়া যায়। মন্দিরগুলির গায়ে টেরাকোটার ছাঁচের কাজ রয়েছে। সেখানে রামায়ণের কাহিনীর বিভিন্ন মুহূর্ত তুলে ধরা হয়েছে, রয়েছে দেবী দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনী ও ছিন্নমস্তার মূর্তির চিত্রও।
আদিবাসী অধ্যুষিত এই গ্রামে অন্য ধর্মাবলম্বীদের বসবাস নেই বললেই চলে। তবে এখানে বাংলা ও হিন্দি যৌথ ভাষার মানুষ বসবাস করে। কার্তিক মাসের কালী পুজোর সময় বহু ভক্তের আগমন ঘটে। গ্রামের বসবাসকারী যারা কাজের জন্য বাইরে থাকে তারা ফিরে আসে এই সময় উৎসবের আনন্দ নিতে। গ্রামের অধিকাংশ বাড়িই মাটির তবে টিনের চাল দেওয়া।
ফেরার পথে এক দোকান মালিক জিজ্ঞাসা করলেন আমি ফিরব কী করে? আমি বললাম, দেখি, কোনো বাইক আরোহী পাওয়া যায় কিনা। তখন তিনি এক পণ্য পরিবাহী ম্যাটাডোর ভ্যানের চালককে বললেন আমাকে হস্তিনাকাদাপুর পৌঁছে দিতে। সেখান থেকে এক চলমান বাইক আরোহীর পিছনে বসে মল্লারপুর স্টেশনে পৌঁছে ২-৪০ মিনিটে বামদেব লোকাল ধরে বর্ধমান। সেখান থেকে ব্যাণ্ডেল হয়ে হাওড়া। বাড়ি ফিরতে প্রায় সাড়ে ন-টা হয়ে গেল।
ইতিহাসের কোলে হারিয়ে যেতে বসা এই মৌলীক্ষার মন্দিরগুলি দেখলে মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে।
Leave a Reply