কুশল বসু, কলকাতা, ১৪ জানুয়ারি#
মার্কিন যুবক আরন সোয়ার্জ তার নিজের বাড়িতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
ছাব্বিশ বছর বয়সী আরন একজন খ্যাতনামা ইন্টারনেট-সমাজকর্মী। এই প্রতিভাধর কম্পিউটার প্রোগ্রামার গড়ে তুলেছিলেন একাধিক ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ্লিকেশন যা এখন দুনিয়াজোড়া মানুষ ব্যবহার করে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল, আরএসএস বা ‘রিচ সাইট সামারি’ অ্যাপ্লিকেশন, যা লক্ষ লক্ষ ওয়েবসাইট ব্যবহার করে, গ্রাহকদের কাছে ওয়েবসাইটে সদ্য যোগ করা নতুন তথ্যের সংক্ষিপ্তসার পৌঁছে দেওয়ার জন্য; ইনফোগামী নামে একটি ওয়েবসাইট, যা পরে রেড্ডিট নামক ওয়েবসাইটের সাথে যুক্ত হয়ে যায়, যেখানে সদস্যরা তাদের পছন্দের কোনও খবরের লিঙ্ক বা খবরটি কয়েক লাইনে লিখতে পারে, তারপর ওয়েবসাইটটির অন্যান্য সদস্যরা সেটাকে ভোট দেয়, এবং এভাবেই সেটি অনেক ভোট পেলে তবে ওয়েবসাইটটির সামনের পাতায় চলে আসতে পারে; ‘ওয়েব পাই’ বা কম্পিউটার ভাষা পাইথন-এ লেখা একটি মুক্ত ওয়েব পরিকাঠামো, যা ব্যবহার করে যে কেউ নিজের ওয়েবসাইটকে আরও উন্নত করতে পারে; ‘ওপেন লাইব্রেরি’ ওয়েবসাইট, যা দুনিয়াজোড়া সমস্ত বইয়ের সন্ধানে সক্ষম একটি ওয়েবপাতা তৈরির স্বপ্ন দেখে, বই কেনার চেয়েও লাইব্রেরি থেকে বই ধার করে পড়া বা ইন্টারনেটে বই পড়ে নেওয়াকে মদত করে।
বিখ্যাত ইন্টারনেট জ্ঞানকোষ উইকিপিডিয়া-তে যে কেউ যে কোনও তথ্য যোগ করতে পারে — এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠা করার পেছনে ছিলেন আরন। ২০০৬ সালে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন নিজের ওয়েবসাইটে, ‘কে লেখে উইকিপিডিয়া?‘। উইকিপিডিয়ার স্রষ্ঠা জিম্বো ওয়ালেস-এর ধারণা হয়ে গিয়েছিল, উইকিপিডিয়া-তে অনেকে অংশগ্রহণ করলেও, কাজের কাজটি করে উইকিপিডিয়ার নিজস্ব সম্পাদকরাই। বাকিরা আজেবাজে কথা লেখে। এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন কুড়ি বছরের আরন। তিনি নিজে একটি প্রোগ্রাম তৈরি করে, উইকিপিডিয়া-র কয়েক লক্ষ প্রবন্ধে সে প্রোগ্রাম ব্যবহার করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, উইকিপিডিয়ার বেশির ভাগ শব্দই এসেছে সেইসব অংশগ্রহণকারীর হাত থেকে, যারা খুব কম সময়ের জন্য উইকিপিডিয়াতে ঢুকে কিছু তথ্য সরবরাহ করে চলে গেছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা ওয়েবসাইটটির ‘অংশগ্রহণকারী’ বা ইউজার হিসেবে নামও নথিভুক্ত করেনি। উইকিপিডিয়ার নিজস্ব সম্পাদকরা মূলত সেইসব তথ্যই এদিক ওদিক করে সাজিয়েছে বা দেখনদার করেছে মাত্র। উইকিপিডিয়া একদিকে যেমন জ্ঞানকোষ, একইসাথে তা কোটি কোটি অখ্যাত অজ্ঞাত অংশগ্রহণকারীর জ্ঞানে সমৃদ্ধ। আরন বলেছিলেন, এই অখ্যাত অজ্ঞাত ইউজারদের অবহেলা করলে এটা আর জ্ঞানকোষ থাকবে না।
” |
আমরা কথা বলতাম ঘন্টার পর ঘন্টা, কীভাবে সংগঠনগুলো পুনর্গঠন করা যায়, কীভাবে অস্ত্র ছাড়া দমন পীড়ন আটকানো যায়, আমাদের মতো লোকেদের হাতে ভার থাকলে তিন দশক পরে পৃথিবীর চেহারা কেমন হত … |
প্যাট্রিক স্মিট, আরনের সহকর্মী |
২০১০ সালে আরন তৈরি করেছিলেন ‘ডিমান্ড প্রগ্রেস’ নামে একটি সংগঠন, যা উইকিলিকসের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ২০১২ সালে মার্কিন সরকার যখন কুখ্যাত ‘সোপা’ আইন এনে ইন্টারনেটকে কর্পোরেটদের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত করতে চেয়েছিল, তখন তার বিরুদ্ধে মাইক হাতে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন আরন। আকাদেমিক গবেষণাপত্রের প্রকাশনার কর্পোরেট সংস্থাগুলির বিরুদ্ধেও জেহাদ শুরু করেছিলেন তিনি। এরকমই একটি দানব ‘জেস্টোর’-এর ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি মার্কিন আইনের চোখে ঘৃণ্য অপরাধীতে পরিণত হন। এক মার্কিন কোর্টে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়, এবং তিনি কিছুদিন আগে গ্রেপ্তার হন। ওই মামলায় তার ৩৫ বছরের জেল অবধি হতে পারত। কিছুদিনের মধ্যেই সেই মামলার শুনানি শুরু হবার কথা ছিল।
তাঁর মৃত্যুর পর তার বন্ধু এবং আত্মীয়রা একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলে, ‘আরনের মৃত্যু একটি নিছক ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা নয়। এটি (মার্কিন) অপরাধী বিচার ব্যবস্থার বাড়াবাড়ির ফল। ম্যাসাচুসেটস-এর আইনব্যবস্থা এবং ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি এই মৃত্যুর জন্য দায়ী।’
গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে ‘মুক্ত সফটওয়র আন্দোলন’ কম্পিউটারের দুনিয়াকে একচেটিয়া ব্যবসার কলুষমুক্ত করতে প্রতিরোধের সূচনা করেছিল। সেই আন্দোলনের ধারা বেয়ে এই শতাব্দীতে কিছু কুলীন ‘জ্ঞানী ব্যক্তি’র কব্জা থেকে জ্ঞান-কে মুক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। বহু মানুষের সম্মিলিত জ্ঞান, তথ্য, সংবাদেই যে বিশ্বের গণতান্ত্রিক জ্ঞানভাণ্ডার গড়ে উঠতে পারে, তার নমুনা আজ আমরা দেখছি সর্বত্র। এই আন্দোলনের মধ্যে কেউ কেউ সেগুলি নিয়েও ব্যবসা করতে নেমে গেছেন, যেমন সম্প্রতি একটি কর্পোরেট সংস্থা হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে ফেসবুক। তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রীয় এবং কর্পোরেটের দখলমুক্ত এবং লোকজ্ঞান নির্ভর ইন্টারনেটের সামাজিক পরিসর তৈরিতে অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব তরুন আরন ‘শহীদ’ হলেন ১১ জানুয়ারি।
Leave a Reply