ইন্ডিয়া টুডেতে যুগল পুরোহিতের প্রতিবেদন, ২৬ জুন#

মঙ্গলবার। ১৮ জুন। তখন বিকেল, আমরা আকাশপথে কেদারনাথ টাউন থেকে দেড় কিলোমিটার নিচে নামলাম। আমি ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকাবার সাহস করলাম। এই ধ্বংসকাণ্ড আমাকে আমার টিম নিয়ে আসতে বাধ্য করেছে। গত রাত আমরা কাটিয়েছি আমাদের বেস-ক্যাম্প গাজিয়াবাদে। সেটা ছিল হিমালয়ের বরফের ওপরে। চোখের সামনে যা দেখছিলাম সবই ধ্বংসস্তুপ আর বোল্ডার। হেঁটে হেঁটে উঠতে শুরু করলাম। এক ঘন্টা হেঁটে আমরা কেদারনাথ টাউনে পৌঁছানোর দেড় কিলোমিটার পথ অতিক্রম করলাম। যখন আমরা কেদারনাথে পৌছালাম, তখন বুঝতে পারলাম, আমরাই রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারের পক্ষ থেকে আসা প্রথম উদ্ধারকারী দল যারা এখানে এসে পৌঁছেছি। এখানে কিছু স্থানীয় অধিবাসী আর কিছু পর্যটক ছিল।
আমরা দ্রুত পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা ভাবলাম। মৃত আর জীবিতদের আলাদা করা এবং জীবিত মানুষের খোঁজে লেগে পড়লাম। আমরা ছিলাম ৪৭ জন। আমি প্রথমে ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশে কাজ করতাম। এখন গত তিন বছর যাবৎ ন্যাশানাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্সে কাজ করছি। আমি সিকিমের ভূমিকম্পের ধ্বংসকাণ্ড দেখেছি। এছাড়াও অনেক ছোটোখাটো বিপর্যয় সামলেছি, কিন্তু এমন বীভৎসতা আগে কখনও দেখিনি।
প্রকৃতি যেন কেদারনাথে হত্যাযজ্ঞ সাঙ্গ করেছে। দেহগুলি ফালাফালা করে চিড়েছে, মাথাগুলি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে। এটা দেখে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা কাঁপুনি খেলে গেল। এখানে কিছু বহুতল দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের প্রথম কাজ প্রতিটি বহুতলের ঘরগুলি খুঁজে দেখা, কেউ বেঁচে আছে কি না।
এইসব দৃশ্য আমার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মনে থাকবে। আমার ধারণা এত লোকের মৃত্যু মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে হয়ে গিয়েছিল।
এখানে আকাশে শকুন উড়ছে। কিছু শকুন আর কুকুর মৃতদেহের মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে। আমরা এক ঝলকে ৬০টি মৃতদেহ কেদারনাথ টাউনে দেখতে পেলাম। মৃতদেহের মাংসগুলি বেশ পচে উঠেছে। গণচিতা জ্বালানো ছাড়া উপায় নেই। আজকের মতো আমাদের দলের ডিউটি থেকে অব্যাহতি পেলাম। আমাদের সাথি দল নেমে পড়ল মৃতদেহগুলিকে শনাক্ত করতে।
আমরা জানি, আমাদের দলের কাজ শেষে রাতে আমরা চারদিকে কিছু মৃতদেহের বেষ্টনীতে ঘুমাতে যাচ্ছি। আর সাথিরা তাদের নিয়ে নাড়াঘাঁটা করছে। এছাড়া আমাদের কিছু করার নেই। এটা একটা অদ্ভুত অনুভূতি। বেশিরভাগ দিনই আমরা বিস্কুট খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। আজ কিছুটা পুরি-সবজি হেলিকপটার করে দিয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু সেসব গন্ধ ছড়াচ্ছিল। তাই পুরিগুলোকে ফেলে দিতে হল। ভাগ্যক্রমে আমরা একটা ক্ষতিগ্রস্ত খাদ্যভাণ্ডার খুঁজে পাই। তাতে প্রচুর নুডলস এর প্যাকেট ছিল। এখন আমি ফিরে এসেছি। কিন্তু আমার খিদে তৃষ্ণার অনুভূতিগুলি যেন উধাও।
আমি জানি এটা একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তবুও আমি রেগে যাচ্ছি। কারণ বেশ কিছুদিন ধরেই টানা বৃষ্টি হচ্ছিল, তবুও কেন রাজ্য সরকার বা মন্দির কর্তৃপক্ষ কেউই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না? আমি সিকিউরিটি ফোর্সে কাজ করি, মূলত পাহাড়ই আমার কর্মস্থল। তাই এটা আমার সাধারণ জ্ঞান যে যখন পরপর কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হতে থাকে, তখন এই ঘটনার একটা ভয়াবহ পরিণতি অবশ্যই থাকে। স্বাভাবিকভাবেই সরকার এবং মন্দির কর্তৃপক্ষের অবশ্যই পর্যটক প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া উচিত ছিল ক’দিনের জন্য। কিন্তু কিছুই হয়নি। কিছুই না।
কেদারনাথে শনিবার ১৫ জুন রাজ্য সরকারের পক্ষে একজন ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেট আর তার একটা ছোটো দল পৌঁছায়। কিন্তু দুর্যোগ মোকাবিলায় তাদের কোনো ভাবনা ছিল না। তারা যেন অপেক্ষা করছিল জলপ্রলয় শুরু হওয়ার জন্য।
আমার মা বাবা চারধাম যাত্রায় ঘুরিয়ে নিয়ে আসার জন্য আমাকে মাঝে মাঝেই খুব জোর করত। কিন্তু আমি তাদের বিরত করেছি সবসময়। কারণ কী জানেন? ইন্দো টিবেটান বর্ডার পুলিশের কর্মচারী হিসেবে দেখেছি, তীর্থস্থানগুলির করুণ অবস্থা। দেখে আমার সবসময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা হত। যেকোনো সময় একটা বড়ো দুর্যোগ নেমে আসতে পারে। যা হল, তাতে আমার সন্দেহই সত্যি হল।
আমি আমার মা বাবা ছেলে মেয়েদের কখনও কেদারনাথের মতো জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যেতাম না।
Leave a Reply