চেনাজানা লোকেদের কাছ থেকে ‘ইনভেস্ট’ করার আহ্বান শুনতে হচ্ছিল বেশ কয়েকবছর ধরেই। বিশেষত, যাদেরই কোনো চাকরি আছে, এমনকী সঞ্চয় করার মতো রোজগার আছে, তার কাছে পড়ে যেত বিভিন্ন মানি মার্কেট কোম্পানির এজেন্ট, পরিচিতজনেরা। কেউ ভাইয়ের বন্ধু, কেউ বা আবার সরাসরি আত্মীয়। বেশি লাভ করবার আশার সাথে মিলেমিশে বিশ্বাস, সম্পর্ক — এক জবর খেলার জন্ম দিয়েছিল — যে খেলায় সবপক্ষই জেতে। এরকমই সোনালী ছিল এতদিন, প্রায় দশ বারো বছর ধরে চলা এই বাংলার মানি মার্কেট। স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল অস্বাভাবিক রিটার্ন।
সরকারের উন্নয়ন-শিল্পায়নের বাঁধা বুলির বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছিল এরা। লোকের আমানত পুঁজি নিয়ে রিয়েল এস্টেট থেকে পশু খামার, শপিং মল থেকে আইটি, ট্যুরিজম থেকে অ্যাগ্রো, সিনেমা থেকে মিডিয়া — কী নয়। সিবিআই-কে লেখা চিঠিতে সারদা গ্রুপের কর্ণধার তো বুক বাজিয়ে বলেই দিয়েছেন, ‘এসবই করেছি কোনো ব্যাঙ্ক থেকে কোনো লোন না নিয়ে’। এই তো উন্নয়নের তেজি ষাঁড়ের কায়দা!
২০০৮ সালে রিলায়েন্স পাওয়ারের শেয়ার কেনার হিড়িকের কথাটা শিক্ষিত লোকে নিশ্চয় ভুলে যায়নি। শেয়ার ণ্ণওপেন’ হওয়ার চারদিন আগে থেকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল, দেশের কোনো কোর্ট যদি স্থগিতাদেশও দিয়ে দেয় এই শেয়ার (আইপিও) প্রকাশের ওপর, তা গ্রাহ্য হবে না। ণ্ণওপেন’ হওয়ার দিন প্রথম মিনিটে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা তুলেছিল কোম্পানি, ছ-টা পাওয়ার প্ল্যান্ট বানানোর কথা দিয়ে। একমাস পরেই গল্পটা তেতো হয়ে যায়, শেয়ারটি বাজারে আসে সতেরো শতাংশ কম দামে। লক্ষ লক্ষ ছোটো আমানতকারী মুহূর্তের মধ্যে লুটে যায়। প্রমাণ নেই, কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলে সবাই মানে, রিলায়েন্স জেনেশুনেই কাণ্ডটা ঘটিয়েছিল, আজেবাজে প্রচার করিয়ে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে প্রকাশ করেছিল।
এবারেও এখন আস্তে আস্তে বেরোচ্ছে, এই ‘শিল্পায়ন’-এর বেশির ভাগটাই ভাঁওতা। স্রেফ জমি কিনে, তাই দেখিয়ে টাকা তোলার ধান্দা। করব বলে ঠেকিয়ে রাখা।
কেউ কেউ অবশ্য শিল্পায়নের আহ্বানেরও পরোয়া করে না। তারা পণ্যের ফাটকা বাজারে আমানত খাটিয়ে চড়া সুদ দিচ্ছে গ্রাহকদের। বেশি লাভ করা গ্রাহকরা সহ সমস্ত মানুষ ওই পণ্যের ফাটকা বাজারের প্রত্যক্ষ কুফল — জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ভোগ করছে। সামাজিকতাকে ব্যবহার করে বেশি লাভের কু-চক্র সমাজের ভেতরে আসন গেঁড়ে বসছে। তাতে কী? অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, তা সে যার মাধ্যমেই আসুক, শিল্পায়ন বা ফাটকায়ন। মানি মার্কেটের জন্য কড়া আইন আনছে রাজ্য, কেন্দ্র সরকার। চোর পালালে বুদ্ধি বেড়ে যাওয়ারই কথা। কিন্তু কড়া আইন বানিয়ে কি তেজি ষাঁড়ের গলায় দড়ি পরানো যায়? ওই ষাঁড়ই তো আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি!
Leave a Reply