আকাশ মজুমদার, জলপাইগুড়ি, ২৯ এপ্রিল#
অবশেষে যা ঘটার তাই ঘটল। সারদা গোষ্ঠীর দ্বারা নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত মানুষ একরাতে সর্বস্বান্ত হল। আর তা ছাড়া নাকি উপায়ও নেই। কারণ কারোর কিছু করবার নেই। নাকি কেউ কিছু করতে চায় না?
বাবা-মার কাছে শুনেছি, তাঁদের সময় থেকে এই লুঠ চলছে। এর আগেও বেশ কিছু কোম্পানি, ওভারল্যান্ড, সঞ্চয়িতা এরকমভাবে মার্কেট থেকে প্রচুর টাকা তুলে পালিয়েছে। তারপরেও ক্ষুদ্র আমানতকারীদের সুরক্ষিত করার কোনো ব্যবস্থা হল না। কারণটা কী? বিগত যত বছর ধরে এই লুঠ চলছে, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রচুর সময় ছিল ক্ষুদ্র আমানতকারীদের আমানত সুরক্ষিত করার, কিছু করার। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে কিছুই হয়নি। আসলে চূড়ান্ত উদাসীনতা। এই গরিব ক্ষুদ্র আমানতকারীদের টাকা সুরক্ষিত থাকল কিনা, তাতে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের, না কোনো রাজনৈতিক দলের, না কোনো কর্পোরেট মিডিয়ার কারোর কোনো মাথা ব্যথা নেই। যদি থাকত, তবে এতদিন ধরে এই লুঠ চলত না। বরঞ্চ এরা বিভিন্নভাবে এই চিটফান্ডগুলির টাকায় পুষ্ট। তাই জন্যই এদের এত বাড়বাড়ন্ত।
কয়েকজন উঁচু র্যাঙ্কের এজেন্টের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, নিয়মিত ঘুষ দেওয়ার মাধ্যমে বা উঁচু পদ দিয়ে কিছু রাজনৈতিক দাদাদের হাতে রাখা হয়। একইভাবে প্রশাসনের নির্দিষ্ট জায়গায় ঘুষ দেওয়া হয় এবং ছোটো বড়ো কর্পোরেট মিডিয়াতে রেগুলার বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের হাতে রাখা হয়। তবে তোমার চিটফান্ড কোম্পানি নিশ্চিন্তে চলবে। কেউ তোমার পেছনে লাগবে না। যদি কোনো অসুবিধা হয়, এরাই তা দেখে নেবে। বাকি আমানতকারীর টাকা দেওয়া নিয়ে অত চিন্তা না করলেও চলবে। এভাবে মার্কেট থেকে বিশাল পরিমাণ টাকা উঠে গেলে, হঠাৎ একদিন ঝাঁপ ফেলে দেওয়া।
এই মানি মার্কেটে পশ্চিমবঙ্গে শয়ে শয়ে কোম্পানি আছে। প্রত্যেকের এজেন্ট অন্য কোম্পানির নামে বলে, সে ভাঁওতাবাজ। আর সাধারণ মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা আনার জন্য এরা এজেন্টদের ফাইলের মধ্যে দরকারে কমার্স ক্লাসের বইয়ের পাতা পর্যন্ত গুঁজে দেয়। কেউ বলে, আমাদের সরকারের কাছে টাকা জমা রাখা আছে, যেগুলোর পোশাকি নাম সিকিওরড ডিবেঞ্চার বা প্রেফারেন্সিয়াল ডিবেঞ্চার, অতএব টাকা মার যাবার কোনো ভয় নেই। কিন্তু হয়তো সরকারের কাছে যে টাকা রেখেছে, তার কয়েকগুণ তুলল। কেউ দেখার নেই। কোম্পানিগুলোর ভেতরের খটোমটো কথা বোঝার সাধ্য এমনকী বাঘা বাঘা এজেন্টদেরও থাকে না। সাধারণ আমানতকারী তো দূরস্থান। সাধারণ ক্ষুদ্র আমানতকারী এজেন্ট চেনে, কোম্পানি চেনে না।
সবাই বলে, আমাদের কোম্পানি অ্যাসেট ভিত্তিক। জমি, শিল্প সব আছে। টাকা মার যাবে না। কিন্তু কে তা নজরদারি করবে? আমাকে একবার একটা কোম্পানি নিয়ে গেছিল জলপাইগুড়ি থেকে কোচবিহারে, তাদের প্রজেক্ট দেখাতে। যাতে আমি তাদের বিশ্বাস করি। কোচবিহারের নাককাটা বিলে আট কিলোমিটার জুড়ে আমাকে দেখাল ফিশারি প্রজেক্ট। এবার ওই ফিশারি কত বছরের জন্য লিজ নেওয়া, কী কী শর্তে লিজ নেওয়া, তা কে জানবে? কেউ কেউ রাস্তার পাশে জমি দেখায়, শপিং মল দেখায়, নার্সিং হোম দেখায়। একটা বিশাল জমিতে প্ল্যাকার্ড লাগানো। কিন্তু এগুলোর তথ্য কী? কোথায় গেলে তার তথ্য পাওয়া যাবে? সরকারের উচিত এইসব নজরদারির বন্দোবস্ত করা।
অনেকে আবার বকলমে এনজিও-র নামে চিটফান্ড চালায়, টাকা নিজে তোলে না। যেমন আমি অ্যালকেমিস্ট নামে একটা সংস্থার কথা জানি, যারা নিজেরা টাকা তোলে না আমাদের এখানে।
আর তাছাড়া সরকারি নেতা, আমলা, পুলিশকর্তাদের দেখিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশ্বাস অর্জন করা তো আছেই। এখন সব মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানি। মিডিয়ায় বারবার বিজ্ঞাপন দিলে তার প্রভাব কিন্তু মানুষের ওপর পড়বেই। লোকে সেগুলোকে সত্য বলে ভাবে। অনেক বড়ো বড়ো এজেন্টের সঙ্গে কথা বলেও আমি এই মানি মার্কেট কোম্পানিগুলির হিসেবের তল পাইনি।
লোকে ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিসে না গিয়ে এই সব মানি মার্কেট কোম্পানিতে টাকা রাখে। একটা বড়ো কারণ তো, এই সব মানি মার্কেট কোম্পানিতে ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিসের মতো অ্যাকাউন্ট খোলা এসবের হ্যাপা নেই। এজেন্টরা বাড়ি বয়ে এসে টাকা দিয়ে যায়, নিয়ে যায়। আর একটা বড়ো কারণ সুদের হার। অনেকেই মনে করে, সরকার যা সুদ দেয় তা কম। একথার যথেষ্ট যুক্তি আছে। পোস্ট অফিস, ব্যাঙ্ক, এলআইসি যা সুদ দেয়, তা এমনকী বাৎসরিক দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির হারের চেয়েও কম। অর্থাৎ, আমি যদি টাকা জমাই, তাহলে সেই আসলটিই কমে যায় আসলে। অর্থাৎ আমার আমানতের লাভটি ভোগ করে ব্যাঙ্ক বা ওইসব প্রতিষ্ঠানগুলো। সেখানে মানি মার্কেট অনেক বেশি সুদ দেয়। অনেকের মতে, আমানতের সঠিক ফেরত পাওয়া যায় কেবল মানি মার্কেটে টাকা রাখলে।
আমার মনে হয়, মানি মার্কেট বন্ধ করে দেওয়া উচিত নয়। আমানতের ওপর ন্যায্য আয়ের অধিকার ছোটো বড়ো সবার আছে। কিন্তু যাতে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তার জন্য সমস্ত বিষয়ে কড়া সরকারি নজরদারির ব্যবস্থা জরুরি।
Leave a Reply