৭ জুলাই, প্রদীপ জানা, আলমপুর, মেটিয়াবুরুজ#
শোল মাছের মতো দেখতে শাল মাছ। তার আকারটা বড়ো হয় এবং তার গায়ে মাথার পর থেকে চক্র-চক্র কালো দাগ আছে। আমাদের পাশের বাড়িতে একটা পুকুর আছে। সেই পুকুরে দেখেছি শাল মাছ এসেছে। শাল মাছ যে পুকুরে থাকে সেখানে চারা পোনা-টোনা থাকলে কিন্তু সর্বনাশ করে দেয়। খেয়ে নেয়। শাল মাছ কিন্তু সবাই খায় না। এখন অবশ্য শাল মাছ খুব উঁচুদরে বিক্রি হচ্ছে, তিনশো টাকা কেজি, হোটেলের ফিশফ্রাইতে চলে যাচ্ছে। ভেটকি মাছের দাম আরও বেশি। এমনি বসে থাকি, কাজকর্ম তো এখন নেই। আড্ডা আর কতক্ষণ মারা যায়। ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে দেখি পুকুরে শাল মাছটা ভাসছে। কটাদিন দেখি ও ঘুরছে ঘুরছে। হঠাৎ ভালো করে লক্ষ্য করে দেখি যে ও বাচ্চা দিয়েছে। শাল মাছ যে ডিমগুলো ছাড়ে, সুতোর মতো লম্বা একটা পাইপ, তার মাঝখানে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ডিমের কীট থাকে। মাছটা যখন প্রসব করে, তখন। তারপরে ওই পাইপটা ফেটে যায়, বাচ্চাগুলো বেরোয়। বেরোনোর পরে ওইখানে একটা মাকড়সার জালের মতো অংশে জলের ওপর বাচ্চাগুলো ভেসে থাকে। এরকম শোল মাছ, ল্যাটা মাছ, শিঙি মাছকে আমি ফলো করে দেখেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত ডিমগুলো পূর্ণাঙ্গ হয়ে বাচ্চা না বেরোচ্ছে, একেবারে সূক্ষ্ম, যেন সেই জলের পোকার মতো, খালি চোখে দেখাই যায় না। দশ-পনেরো দিন পরে বাচ্চাগুলো বড়ো হলে ওদের নিয়ে মাছেরা খেলে। শাল, শোল, ল্যাটা সবই একই প্রক্রিয়ায় বাচ্চাদের বড়ো করে। কৈ মাছ একটু দূরে থাকে। বাচ্চাদের মাঝখানে রাখে, ওদের ঘিরে মেয়ে আর ছেলে থাকে। মা কোনো কারণে মারা গেল কিংবা কেউ ধরে নিয়েছে, নাহলে মেয়ে আর ছেলে মানে বাবা-মা দুজনই থাকে। মা বাচ্চাকে পাহারা দেয় আর বাবা শত্রুপক্ষ আসছে দেখলে তাদের ধাওয়া করে। মা সবসময় ছোটো, বাবা আকৃতিতে বড়ো। শাল, ল্যাটা এরা পরপর দুবার ডিম পাড়ে। এদের শরীরের ভিতর দুটো ডিমের ছড়ি থাকে। বড়ো লাইনটা আগে ডেলিভারি হয়, এক-দেড়মাস পর ছোটোটা ডেলিভারি হয়। বছরে দুবার ডিম দেয়।
মাছ ধরতে ধরতে এগুলো বোঝা যায়। শাল মাছটাকে যখনই আমি অ্যাটাক করতে যাই, মা-টা গালে করে বাচ্চাকে নিয়ে অন্য জায়গায় চলে যায়, সেখানে নিয়ে ছেড়ে দেয়। ক-দিন ফলো করে করে ভাবলাম, না! ছেড়ে দিই, বাচ্চা আছে। মেরে দিলে বাচ্চারা অসহায়! যদি বাবা-মাকে ছিপ দিয়ে তুলে নিই বা মেরে দিই, এই বাচ্চাগুলো বাঁচবে না। ওদের যে শত্রুপক্ষ, কৈ ল্যাটা চ্যাঙ মাছ, বাচ্চাগুলোকে খেয়ে নেবে। অনেক বাড়িতে পুকুরে ল্যাটা বা শোল মাছের বাচ্চা থাকলে তারা মাছকে মারে না। যে জিনিসকে মারলে ভক্ষণ করা যায়, তাতে পাপ হয় না। বিনা কারণে মেরে ফেলে দেওয়া সবচেয়ে খারাপ। আমি এসব ভাবি। তবে সব যদি মায়া করে ছেড়ে দিই, আমি খাব কী? আমি একজন শিকারী, শিকার করতে গেছি। হাতের সামনে জলে মাছ ঘোরাঘুরি করছে, হাতে কোঁচ বা যন্ত্র আছে, না মেরে ঘরে চলে যাব, এমনটাও নয়।
অনেক সময় পুকুরে বাচ্চা আছে জানি না। অজান্তে বড়ো মাছ মেরে দিয়েছি। তেলাপিয়া, নাইলন-টিকা মাছের যখন ছোট্ট বাচ্চা থাকে, জলে ভাসছে, দেখতে পেল কোনো আঘাত আসছে, একটা সাপ আসছে, টুক করে মুখে নিয়ে অন্যত্র গিয়ে ছেড়ে দেয়। কারণ ছেড়ে না দিলে তারা বাইরের অক্সিজেন পাবে না। আমার কথাটা হল, মাছই শুধু নয়, প্রতিটা প্রাণী কীভাবে নিজের বাচ্চাদের লালন-পালন করে। মা বাচ্চাকে আগলে রাখে আর বাবা বাইরের শত্রুকে ধাওয়া করে। তবে একটা ল্যাটা মাছ তো আর শোল মাছকে তাড়া করতে পারে না। তাহলে সে ওর পেটেই চলে যাবে!
Leave a Reply