প্রথমে ৫০ টাকা দিয়ে সাহায্য করেন একজন রিক্সাচালক। আর ফেরেস্তার মতো এক সাংবাদিক সাহায্য করেন ৫০০ টাকা দিয়ে।
সুদর্শন। বগুলা। ১৩ জুলাই, ২০২০।#
লকডাউনের এটাই সুবিধা। টেলিভিশন খুললেই তাক লাগানো পরিসংখ্যান। চোখ ধাঁধানো পরিবেশন। সবই অবশ্য মুখ বেঁধে! এই বাঁধা ছকে আপনার মস্তিষ্কটাও কি স্থবির হয়ে ভুলে যায়নি নিজের প্রতিবেশীদের কথা?
তবু ‘শ্রমিকদের আগে আনা হয়নি কেন? এখন রোগটা ছড়িয়ে পড়ল আর রে রে করে তাদের ফেরানোর জো হল! রেশনে তো এখন সব পরিবারেরই দিব্যি চলে যাবে তবু ওই লেবারদেরকে ফেরানোর কোনো মানে হয়?’ – এসব তর্ক চৌমাথার মোড়ে দূরত্ব বজায় রেখেই আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের ঘরের কেউ নেই বলেই চালাতে পারছি। আমরা ভুলেই গেছি লকডাউনের এই উৎসব আবহে যে, প্রতিবছর ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ুর গঞ্জ এলাকার দরিদ্র মানুষগুলো কাতারে কাতারে নিজেদের ভিটে ছেড়ে চলে যায়। জলের অভাবে।
অথচ এই মজাদার সময়ে ওলা-উবেরের যুগে ২৬ দিন পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরবে ৪২ বছরের নারায়ণ বৈদ্য। বাড়ি নয় কোয়ারান্টাইনে! আর ৩০শে মে কোয়ারান্টাইন থেকে বাড়ি ফেরার দিনখানেক আগেই গ্রামময় গুজব ছড়াবে করোনা হওয়ায় তাকে ‘সরকারি’ এম্বুল্যান্সে বেলেঘাটায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঘটনাটা অবশ্য পুরনো। তিনি মহারাষ্ট্রে থাকতেই বেনালীর বৈদ্যপাড়ার সবাই জেনে গেছে নারায়ণ বৈদ্য করোনাক্রান্ত। তাই তার বাবাকে চাল ভাঙিয়ে দেয়নি স্থানীয় মিল থেকে। পরিবারের বাকিরা মধ্যযুগীয় বর্বরতার কিছুটা আঁচ পেয়েছে বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে।
মাস ছয়েক আগে নারায়ণ বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়ে পড়ে। বগুলা স্টেশনে গিয়ে দেখা হয় তিন বন্ধুর সাথে যারা ‘কাজের-অভাব-না-থাকা-রাজ্য’ থেকে স্বেচ্ছায় মহারাষ্ট্রে যাচ্ছিল কাজের, থুড়ি সময়কাটানোর সন্ধানে । আগুপিছু না ভেবেই তাদের সাথে গিয়ে ওঠে পুণের ডনে। সেখান থেকে নতুন কাজে হিঙ্গোলিতে। ইচ্ছা ছিল ছ-মাসের মজুরি একবারে পেয়ে ফেলে আসা ছোট্ট মেয়ের কাছে ফিরবে নারায়ণ। সব ঠিকই ছিল কিন্তু হঠাৎই এক ফেরিওয়ালা আবারও স্বপ্ন দিল ভেস্তে। লকডাউনের দু-দিন পর বাকিটা ভেঙে চুরমার হল যখন কাজের প্রধান ঠিকাদার বাপন (বুলডাঙ্গার বাসিন্দা) চম্পট দিল ছ’মাসের বকেয়া প্রায় ৭০ হাজার টাকা নিয়ে। শুধু যে তার একার টাকা নিয়ে ফেরার তা নয়, প্রত্যেক শ্রমিকের। নতুন কাজের কোনো দিশা নেই। তার স্ত্রী ‘দিদিকে বলো’তে তার স্বামীর ব্যাপারটা জানালেও টিকিট পাননি। মাথার উপর ছাদ আর পেটভর্তি শূন্যতা নিয়ে পথই ছিল একমাত্র পথ। সম্বল বলতে এতদিনের খাওয়া বাবদ পাওয়া টাকা থেকে সঞ্চিত যৎসামান্য ধন। সেটা নিয়েই সবাই রওনা দিল বাড়ি ফেরার নিরুদ্দেশের পথে। যে তিনজনের (তাঁরা অন্য জায়গায় কাজ করত) সাথে মহারাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছিল নারায়ণ, ইচ্ছা ছিল তাদের সাথে নিয়ে ফেরার কিন্তু তাদেরও একই দশা। বকেয়া পায়নি। ঠিকাদার শুধু কালস্বপ্ন দেখিয়ে চলেছে (যখন এটা লেখা হচ্ছে তখনও ওঁরা তিনজন টাকা পায়নি)। কথা ছিল ১৮ই মার্চ টাকা পেলে তারাও বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। কর্মস্থলের শেষ তিনজনের দু’জন অন্ধ্রে চলে যাবার পর নারায়ণ হিঙ্গোলি থেকে এক সপ্তাহ পর হেঁটে মাঙ্গোলিতে গিয়ে কিছুদিন কাজ করেন এবং এখানেও মজুরি মার যায়। শেষে মনস্থির করেন, আর দেরি নয়।
প্রথমে ভেবেছিল বিয়ারিং দিয়ে গাড়ি বানিয়ে রেললাইনে আসবে কিন্তু অন্যেরা ভয় দেয় RPF ও আইনের। অবশেষে গাড়ি বানিয়ে মালপত্র (পোশাক), এক হাঁড়ি ভাত আর একসমুদ্র আশা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পদব্রজে। বেরবার আগে তিনি হিসাব কষেছিলেন শুরু থেকে প্রায় ২৫০০ কিমি রাস্তা তিনি রোজ প্রায় ৫০ কিমি হেঁটে ৪২ দিনে বাড়ি পৌঁছাবে। অর্থাৎ হেঁটেই ভারতীয় রেলের চালভর্তি ওয়াগনের গতিবেগকে হার মানাবে। হ্যাঁ, FCI রেলের ওয়াগন ভাড়া করে কালাহান্ডির কেসিঙ্গা থেকে কটকের জগৎপুরে ৬০০ কুইন্টাল পৌঁছে দিতে সময় নিয়েছিল ২০-টা মাস। তারপর যা হয়েছিল তার খবর আমরা নারায়ণ বৈদ্যদের মতই নিতে ভুলে গেছি।
যাই হোক, রোজ সকাল চারটেয় উঠে ন’টা অবধি একটানা হেঁটে পথে যা জোটে তা পেটে দিয়ে একটু বিশ্রামের পর ১০টা-১২টা অবধি আবার হাঁটা। ২টো থেকে ৪টে পর্যন্ত কোনো গাছ বা কুটিরের ছায়ায় বেআব্রু বিশ্রামের পর রাতে যতক্ষণ না কোনো পান্থনিবাস পাওয়া যায় ততক্ষণ হেঁটে চলা। সেখানে কিছু জুটলে ভাল, না জুটলে … নক্ষত্রদের সাক্ষী রেখে চোখ বুজত — এই ছিল তার রোজনামচা। পথে সাহায্য পায়নি এমন নয় (নটেন্দ্রবাবুরা বোধহয় ভেবেছিলেন, লকডাউন আর সামাজিক দূরত্ব মানবিক দূরত্ব বাড়াতে পারবে)। প্রথমে ৫০ টাকা দিয়ে সাহায্য করেন একজন রিক্সাচালক। আবার ফেরেস্তার মতো এক সাংবাদিক সাহায্য করেন ৫০০ টাকা দিয়ে। এছাড়াও জলছত্র, সরবৎ ও খাবার নিয়ে মানুষ হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সিনেমার মতো কিছু পুলিশকর্মীরা অতিথি শ্রমিকদের জন্য করেছিলেন বিরিয়ানির ব্যাবস্থা। তবুও পথ যেন কমছিল না। এরমধ্যেই দাবানলের মতো ১২ জন শ্রমিকের রেললাইনে রক্তাক্ত ম্যাসাকারের ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এই ঘটনা যেন থামতে বলেছিল তাঁকে। পরদিন পথে সে দেখে এক হাতে এক মেয়ে, কোলে বাচ্চা, মাথায় বোঝা আর পেটে সিসিফাসের মতো আর একজনকে নিয়ে ভিটের টানে চলছে এক সন্তানসম্ভবা যা তাকে আর পিছনে তাকাতে দেয়নি।
এভাবে ২৬ দিন হাঁটার পর ছত্রিশগড় আর ওড়িশা কাছাকাছি রাস্তায় দেখা হয় তার ভাই শুভঙ্কর বৈদ্য’র সাথে। কনরাড বলেছিলেন, ভাইয়ের মতো মতো বন্ধু পৃথিবীতে দুটো নেই। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে তাদের তেমনই মনে হয়েছিল নিশ্চিৎ! মহারাষ্ট্রে এক বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করতেন শুভঙ্কর। সেখান থেকে কিছুটা হেঁটে কোলকাতাগামী এক লরিতে চাপেন ও পথে দেখা। সন্ধ্যায় তারা ওড়িশার কোনো এক হোটেলে থামে। সেখানে দুইভাই খাবার খেয়ে লরিতে ঘুমিয়ে জেগে উঠে দেখে যে মোবাইল নেই। ড্রাইভারের কাছে পুছতাছ্ করেও কোনো লাভ হয়না যেহেতু সে তখন মহুয়ার মদ খেয়ে নেশা ও ঘুমের ঘোরে চলে গেছে। পরে তার ঘুম ভাঙলে সে অস্বীকার করে। কিছুদূর এসে বাক্-বিতণ্ডা ও কিঞ্চিৎ হাতাহাতির পর ড্রাইভার তাদের মাঝরাতে জঙ্গলে নামিয়ে মালপত্রসমেৎ টাকা নিয়ে পালায়।
সেখান থেকে প্রায় ১০ কিমি রাতের অন্ধকারে হেঁটে তারা স্থানীয় থানায় এসে অভিযোগ জানায়। থানা থেকে বলা হয় গাড়ি এই পথে ফিরে আসলে তারা ব্যবস্থা নেবে কারণ এতক্ষণে নাকি সেটা তাদের ‘এক্তিয়ারের বাইরে’ চলে গেছে। এরপর কাকভোরে প্রায় ৪ ঘন্টা হেঁটে তারা সাঁতরাগাছি পৌঁছায়। ওড়িশা থেকে এতবধি তাদের কেউ কোনো সাহায্য করেনি। সাঁতরাগাছি থেকে লাল ঝান্ডার লোকেরা তাদের কাছ থেকে বিস্তারিত শুনে বাড়ি ফেরার ট্যাক্সি ভাড়া করে দেয়। গাড়ি ভাড়ার ২০০০ টাকা তারা দেয় ও স্থির হয় যে বাকি ১০০০ টাকা দুইভাই বাড়ি গিয়ে মিটিয়ে দেবে। পথে কল্যাণীর জাগুলিয়ায় পুলিশ গাড়ি আটকায় এবং ৩০০ টাকা নিয়ে ছাড়ে। অবশেষে তারা বিকালে হাঁসখালী পৌঁছালে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। কোয়ারেন্টাইন থেকে বাড়ি ফিরেও যেন কিছুতেই বাড়ি ফেরা হয় না তার। কারণ এই নারায়ণ বৈদ্যই পাড়ার আরও কয়েকজনকে উস্কে দিয়ে প্রাচীন এক আশ্রমের জায়গা জমিহাঙরদের কেড়ে নেওয়া থেকে বিরত করেছিল। এই নারায়ণ বৈদ্যই নদীর(চূর্ণী) পাড়ের খাসজমি জলের দামে বিক্রি হবার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এবং অবশ্যই শেষ ভুলটা করেছিল সংবাদমাধ্যমকে এই ব’লে যে বাড়ি ফেরার পর সে বা তার পরিবার কেন্দ্র বা রাজ্য কোনো সরকারের থেকেই কোনো সাহায্য পায়নি। ফলতঃ পরিযায়ী শ্রমিকদের তালিকায় নাম আসেনি। মিডিয়াও দেখা যায়নি, বিরোধিরা এর বিরোধিতা করেছে বলে। ভবিষ্যতে কী করবে তারও ঠিক নেই। নতুন কিছু শুরু করতে গেলে অন্তত কিছু পুঁজির দরকার। মরার উপর খাড়ার ঘা’র মতো আমপানে তাদের কাঁচা ঘর গেছে ভেঙে। সাহায্য বাবদ অবশ্য মিলেছে মাত্র একটা তাঁবু। অথচ নারায়ণ বৈদ্যের স্ত্রী খুকুমণি বৈদ্যরায় ময়ূরহাট ২নং পঞ্চায়েতে শাসক দলের সদস্যা। এরপরেও নাকি নিন্দুকেরা বলেন মাননীয়া স্বজনপোষণে ব্যস্ত। আসন্ন বিধানসভায় এই সততা কি তার দলের কাছে রোল মডেল হবে?
Leave a Reply