শ্রীমান চক্রবর্তী ও দীপক বসু, হাতিবাগান, ২৮ মার্চ। ছবি প্রত্যুষা জানার তোলা
২২শে মার্চ বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে উত্তর কলকাতার অন্যতম পুরোনো হাতিবাগান বাজার বিধ্বংসী আগুনে প্রায় আশি ভাগ পুড়ে গেল। বিধান সরণির দিকের বিল্ডিং-এর পশ্চিম অংশে এই আগুন লাগে এবং নিমেষের মধ্যেই তা বাজারের পুরো দক্ষিণ-পশ্চিম, পশ্চিম ও মধ্যভাগকে পুড়িয়ে দেয়। বাজারের ভিতরের প্রায় ৬০০ দোকান পুড়ে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে। হাতিবাগান বাজারের ভিতরের বিল্ডিং-এ বিধান সরণির ফুটপাতে বসা বিভিন্ন দোকানদারদের মালপত্র রাখা থাকত। এই বিধ্বংসী আগুনে সেইসব ফুটপাতে বসা হকারদের জিনিসপত্রেরও ক্ষতি হয়েছে। এরকম ক্ষতি হওয়া হকারদের সংখ্যা প্রায় ১০০। পঞ্চাশ বছরের ওপর এই ফুটপাতে দোকান করেন কেষ্টদা (আগে বেল্টের দোকান ছিল, এখন গেঞ্জির দোকান), তাঁর ক্ষতি হয়েছে অনেক টাকার। খাদিম-এর সামনের ফুটপাতে গেঞ্জি-জাঙ্গিয়া, ছোটো প্যান্ট নিয়ে বসা গোপাল সাহা জানালেন, তাঁর প্রায় ৭০ হাজার টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। নৈহাটি থেকে আসা এই হকার জানালেন চৈত্রের সেলের মুখে বাজারটাই নষ্ট হয়ে গেল। এর পাশেই বসা প্রবীর সাহা জানালেন, তাঁর ক্ষতি ৭-৮ হাজার টাকার মতো। তিনি উল্টোডাঙায় থাকেন, বাড়িতেই কিছু মাল রাখেন বলে তিনি বেঁচে গেছেন।
কথায় কথায় জানা গেল চৈত্র মরশুমে এইভাবে ক্ষতি হওয়ায় অনেককেই ব্যবসা বন্ধ করতে হচ্ছে। কারণ মহাজনরা বছরের অন্য সময়ে বাকি দিলেও, চৈত্র মাসে ধার দেয় না। পুজোর পর এই সময়টাই ছিল বড়ো বিক্রির একটা সময়। এখানে বসা হকাদের কারো বাড়ি উল্টোডাঙা, বাগুইহাটিতে। সোদপুর, নৈহাটি, বনগাঁ থেকেও আসেন অনেকে।
বাজারের ভিতরে পশ্চিম দিকে বিল্ডিং-এ কাপড়ের দোকান ছিল মছলন্দপুরের বাসিন্দা মহাদেব কুণ্ডর। আগুনে তাঁর দোকান ফাল্গুনী বস্ত্রালয় সম্পূর্ণ ছাই। আগুন লাগার সময় বাজারের ভিতরে উত্তর দিকে একটি দোকানে তিনি শুয়েছিলেন। তাঁর ঘুম ভাঙে আগুনের দাপটেই। তিনি জানান রাত আড়াইটে নাগাদ আগুন লাগলেও, দমকল আসতে দেরি করে। দেড়-দু ঘন্টা লাগে দমকল আসতে। ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। মহাদেববাবুর চোখের সামনেই সব পুড়ে গেছে। নিজের পরনের জামাকাপড় ছাড়া কিছুই বাঁচাতে পারেননি। প্রাণ নিয়ে বাঁচাই ছিল তখন মূল লক্ষ। চশমা থেকে নিয়ে পরনের জামাকাপড়, সবই তাঁর গেছে। ক্ষতি প্রায় ৪-৫ লক্ষ টাকা। ওঁর কারবার মূলত নগদেই, তাই ক্ষতি সামলানো কঠিন হবে।
বাজারের মধ্যিখানে সবজির দোকান ছিল বাবুয়া প্রসাদের। ১২ বছর বয়সে এই বাজারে এসেছিলেন, প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এখানে বসেন। কেষ্টপুরে বাড়ি। ক্ষতি হয়েছে কয়েক হাজার টাকার। গত বুধবার থেকে সকালে দু-ঘণ্টা করে বাজারে বসতে দিচ্ছে। তাতে ক্ষতি হচ্ছে। ২ ঘণ্টায় সবজির বাজার হয় না। মাল কিনলে বিক্রি করা যাচ্ছে না। তাই ক্ষতির ওপর ক্ষতি। বাবুয়া প্রসাদের বাজারে আরেকটা দোকান আছে।
বাজারের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ভাড়ায় চায়ের দোকান চালান অতীন্দ্র দাস। ৫০ বছর ধরে তিনি এই বাজারে কাজ করেন। আগুন লাগার সময় তিনি তাঁর দোকানের পাশেই শুয়েছিলেন। আগুন লাগলে তিনি কয়েকটা জিনিস বাঁচিয়ে বের করার পরই এসে দেখেন নিমেষেই আগুনের তাপ ছড়িয়ে গেল সমগ্র বাজারে। দ্রুত আগুন ছড়িয়ে যায় হলকার মতো।
পুরসভার থেকে এখন ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ চলছে। ভাঙা হচ্ছে বিল্ডিং-এর বিপজ্জনক অংশ। বিধান সরণির সামনের দিকে বিল্ডিং -এ ক্ষতি কম হয়েছে। অনেকে মঙ্গলবার থেকে দোকান খুলেছে। কিন্তু কোনো বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। ধ্বংসস্তূপ সরানোর সময় অনেক দোকানদার নিজ নিজ দোকানের অংশটি গিয়ে কিছু খুঁজে বার করছে। কেউ কেউ বসে আছে নিস্পলক দৃষ্টিতে। সকলেরই আশা তাদের এই দুর্দিনে সরকার পাশে থাকবে। বাজারের ভিতরের অনেকেরই কোনো বীমা করানো নেই, তাই ক্ষতি পূরণের সম্ভাবনা কম। অনেকে ওখানেই বসে আছে এই আশায় যে তাদের নিজ নিজ অংশটা যাতে বুঝে নিতে পারে। বাজারের মালিকরা চায় বাজারের জমিকে কোনো প্রমোটারের হাতে তুলে দিতে। পুড়ে যাওয়া বাজারের মধ্যে লাগানো পোস্টার ব্যানারে ব্যবসায়ীদের সেই অভিযোগই উঠে আসছে।
Leave a Reply