সোহিনী রায়, কলকাতা, ১৪ জুন#
একদম একলা অনেকটা রাস্তা যাওয়ার সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দু-ধরনের মানুষের মুখোমুখি হতে হয়। এক, যারা একলা মেয়ে যাচ্ছে ভেবে অতিরিক্ত নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করেন, অযাচিত সাহায্য করেন। আর দুই, যারা অকারণেই দুর্ব্যবহার করেন — একজন মেয়ের একদম একা-একা যাওয়ার ‘ঔদ্ধত্য’ তাদের ‘অসহ্য’ লাগে বলে মনে হয়। এবারেও ট্রেনে ওঠার আগে পর্যন্ত খাওয়ার দোকানে, মিনারেল ওয়াটারের দোকানে এই ধরনের ব্যাখ্যাতীত দুর্ব্যবহার পেয়েছি।
আমার বহু বান্ধবীদের কাছ থেকে শুনেছি যে, একদম একা দূরে কোথাও যেতে দূরপাল্লার ট্রেনে চড়তে নাকি খুব একঘেয়ে লাগে। ভালো লাগে না। একধরনের নিরাপত্তাবোধের অভাবে সহযাত্রীদের সাথে বেশি কথা বলা যায় না। ফলে নাকি সময়টা কাটতে চায় না। আমার অভিজ্ঞতা খানিক অন্যরকম। আমি পাঁচবারের মতো একদম একলা অনেক দূরে গিয়েছি।
বাকস্ফূর্তির সময় থেকেই যারা খানিক বেশি কথা বলে, মানে এই আমাদের মতো মানুষদের ক্ষেত্রে বাসে-ট্রেনে-ট্রামে-জলে-জঙ্গলে একলা হওয়ার জো-টি থাকে না। শিয়ালদা স্টেশনে টুকটাক অকারণ খারাপ ব্যবহার পেয়ে মনটা তেতো হয়েইছিল। উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে আমার একদম নিচের সিট ছিল অর্থাৎ জানলার ধারটা আমার পাওয়ার কথা ছিল। মনে মনে ভাবলাম, ‘আহ্ বেশ হাওয়া খেতে খেতে একলা যাওয়া যাবে’ — ভেবেই মনটা ভালো হয়ে গেল। ট্রেনে উঠে আমার নির্ধারিত সিটের সামনে গিয়ে দেখলাম জানলার ধারে একজন সাদা চুল পৃথুলা। পাশে একজন সাদা-চুল ভদ্রলোক। আমি ভদ্রলোকের পাশে গিয়ে বসলাম। মনে মনে ভাবলাম, ‘ট্রেন ছাড়লে জানলার ধার দখল করা যাবে খন’। আমার মাত্র একটাই ব্যাগ ছিল পিঠের। পিঠ থেকে ব্যাগ খুলে আরাম করে বসলাম। আমার গন্তব্য কুচবিহার, নামব নিউ কুচবিহার স্টেশনে। ট্রেনসযাত্রী ও তাকে বিদায় জানাতে আসা লোকজনে ঠাসা। নড়া-চড়া করা যাচ্ছে না বিশেষ। মে-শেষের গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। খানিক বাদে দেখলাম, পাশে বয়স্ক ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা এতক্ষণ ধরে যে ভাষায় কথা বলছিলেন, সেটা বাংলা নয়, হিন্দিও নয়। কিন্তু সেটা কি ভাষা বুঝতে পারিনি। ভদ্রলোক উঠে দাঁড়াতেই আমি ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ইয়ে মেরি সিট হ্যায়’। ভদ্রমহিলা খানিক অবাঙালি টানওয়ালা বাংলায় জানালেন যে, উনি সেটা জানেন। খানিকক্ষণের জন্য বসেছেন। তারা ভারতীয় রেলকে দোষারোপ করে বললেন যে, ভারতীয় রেলের এমন অবস্থা যে ওনার মতো একজন বয়স্কাকে দিয়েছে একদম ওপরের বার্থ আর আমার মতো কম বয়সীকে একদম নিচের। যথারীতি আমি বদলে নেওয়ার প্রস্তাব দিলাম। উনি খুব খুশি। উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কোথায় নামব? নিউ কুচবিহার শোনার সাথে সাথে সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোক বাংলায় বলে উঠলেন, ‘এই তো সঙ্গী পেয়ে গেলে, বাহ্ ভালোই বলো। পুরো রাস্তাটা তোমার সাথে থাকবে।’ বুঝলাম, ভদ্রলোক ভদ্রমহিলাকে তুলতে এসেছেন। এ যাত্রায় ভদ্রমহিলা আমার সফর সঙ্গী হলেন। আমার আর একলা যাওয়া হলো না!
ট্রেন ছাড়ার পর বুঝলাম, মুখোমুখি ছ’টা সিটের ছ’টায় মেয়েদের দখলে। মনে পড়ল, কোনো টিকিট না পেয়ে আমি ‘মেয়েদের’ কোটায় টিকিট কেটেছিলাম। এখানে সবাই তার মানে সেভাবেই কেটেছেন। আমি আর ওই ভদ্রমহিলা বাদ দিয়ে আর সবক’জন মেয়েরই ‘চ্যাপ্টা নাক চেরা চোখ’-এর মঙ্গোলিয়ান মুখ। তারা কলকাতায় কেউ পড়ে, কেউ চাকরি করে। জলপাইগুড়ি দার্জিলিং ফিরছে — বাড়িতে। আমার সফর সঙ্গী ভদ্রমহিলা জানলার ধার দখল করে বসে রইলেন। আশ্বস্ত করলেন যে, বাকিরা সবাই জলপাইগুড়ি নেমে যাবে। আমি তখন উল্টোদিকে জানলাটা পেয়ে যাবো। ট্রেনটা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে নিউ কুচবিহার অবদি সময় নেয় তিনঘন্টার মতো। অর্থাৎ আমার জন্য মাত্র তিনঘন্টা জানলার ধার বরাদ্দ। ওনার সাথে কথা শুরু হওয়ার পর উনি আমার যাবতীয় তথ্য জেনে নিলেন। আমার জীবন নেহাত-ই একরঙা। আমাকে জানার জন্য সামান্য কিছু তথ্য জানাই যথেষ্ট। কিন্তু ভদ্রমহিলা দেখলাম একজন ‘জীবন্ত ভ্রমণকাহিনী’। যে ভদ্রলোক তুলতে এসেছিলেন তিনি ওনার স্বামী। ভদ্রলোক বিড়লা সিমেন্টে চাকরি করেছেন। গোটা চাকরি জীবন কলকাতায় কাটিয়েছেন। চাকরি শেষে রাজারহাটে ফ্ল্যাট কিনে স্বামী স্ত্রী থাকেন। ভদ্রমহিলার বাপের বাড়ি কুচবিহার। একশ’ বছর ধরে ওনারা কুচবিহারে আছেন। উনি আমাকে জানালেন, কুচবিহারের রাজকুমারী গায়ত্রী দেবীর সঙ্গে রাজস্থানের রাজার বিয়ে হয়েছিল। তথ্যটা যদিও সর্বজনবিদিত, তবুও ওনার মুখ থেকে শুনতে বেশ অন্যরকম লাগছিল। কারণ ওনার দাদু গায়ত্রীদেবীর বিয়ে দেখেছেন। কুচবিহারের রাজবাড়ির কাছেই ওনাদের বাড়ি। ওনার মা অসুস্থ, তাই মাকে দেখতে যাচ্ছেন এখন। কুচবিহারের বাড়িতে ওনার মা-দাদা-বৌদি-ভাইপোরা থাকেন। কুচবিহারে ওনাদের পৈতৃক ব্যবসা জামাকাপড়ের দোকান বললেন বলে মনে হলো। ওনার শ্বশুরবাড়ি হলো সিকিমের জোরথাং-এ। ওনার ভাসুরের বা দেওরের ছেলে একটি ডিপার্টমেন্টাল দোকান খোলায় সেখানেও একখানা বাড়ি কেনা হয়েছে। জানালেন যে, বিয়ের পর প্রথম প্রথম শ্বশুরবাড়িতে খুবই অসুবিধা হতো। তখন সেখানে ইলেকট্রিসিটি আসেনি। হ্যারিকেন জ্বালতে হতো। শীতকালে সব কাজ করতে, জল গরম করতেও অসুবিধা হত। আমি ভাবলাম যে, উনি নিশ্চয়ই শ্বশুরবাড়িতেও যাবেন। আমার ভুল ভেঙে দিয়ে জানালেন যে, এক মাস আগেই উনি পনেরোদিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি ঘুরে কলকাতা ফিরেছেন। আমাকে উনি আরো জানালেন যে, ওনার বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি — দুটোরই আদিবাড়ি হলো রাজস্থানের বিকানীর। বুঝলাম, আমার প্রাথমিক আন্দাজ ঠিক, ওনারা মারোয়ারী। সেখানেও ওনাদের কিছু আত্মীয় স্বজন আছে। ওখানে ওনাদের ‘খেতিদারি বেওসা বেওসা’ আছে। এই বিকানীরে ‘দেশের বাড়ি’-তেও উনি বছরে অন্তত একবার যান। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, ‘বিকানীর! সে তো অনেকদূর!’ ওনার নির্বিকার উত্তর, ‘এমন আর কি। ট্রেনে চাপলেই পৌঁছে যাওয়া যায় আজকাল। আগে তো খুব কষ্ট হতো।’ সামান্য গর্বের সাথে জানালেন, এই সিকিম, কুচবিহার, বিকানির — এই সবকটা বাড়ির দায়িত্ব মূলত ওনার। ফলে সমস্ত জায়গাতেই ওনাকে বছরে কমকরে একবার যেতেই হয়। কলকাতার বাড়ির তো বটেই কারণ সে বাড়ি ওনার খোদ নিজের। সন্তানসন্ততি সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় আরো নতুন জায়গার কথা উঠে এল। দেশের বাইরে — আমেরিকায়। ওনার একটি ছেলে, একটি মেয়ে। বললেন যে, দুজনেই ইউএসএ থাকে। মেয়ের দিকে নাতি-নাতনি আছে। মেয়ে একা সামলাতে পারে না তাই উনি সেখানেও যান বছরে একবার। রাত্রে সামান্য মিষ্টি খেলেন শুধু। জানালেন, ট্রেনে উনি বেশি কিছু খান না। একটা মাঝারি মাপের কিটব্যাগ মাথার কাছে নিয়ে শুলেন। ওতে ঠাকুরের প্রসাদ আছে। তাই মাটিতে নামালেন না। আমি আপার বার্থে উঠে গেলাম নিজের মতো করে খানিকক্ষণ কাটাবো বলে। সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ কুচবিহার পৌঁছলাম। স্টেশনে আসার খানিকক্ষণ আগে আমার চোখ লেগে এসেছিল। স্টেশন এলে নিজেই ডেকে দিলেন। আমি নেমে গেলাম। উনি অপেক্ষা করছিলেন — ওনার ভাইপো ওনাকে নিতে আসবেন বলে। ষাটোর্ধ এই মারোয়ারী মহিলার জীবনযাত্রা অথবা ‘যাত্রা’জীবন, কোলকাতা-কুচবিহার-সিকিম-বিকানীর-ইউএসএ পাঁচটি সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা ওনার টুকরো টুকরো জীবনের ছবি; সাবেকী মাড়োয়ারি গৃহবধূর মোড়কে সাবলীল, আলাপী, স্বচ্ছন্দ, বুদ্ধিমতী এক ব্যক্তিত্ব — গোটা কুচবিহার যাত্রায় আমার অন্যতম ঝকঝকে স্মৃতি হলো ওনার সাথে সময় কাটানো।
mitra chatterjee says
chhotto sunder lekha..porte bhalo lage