১৫ মে, শাকিল মহিনউদ্দিন, হাজিরতন, মেটিয়াবুরুজ#
দু-পাশে চাষজমি আর খানাডোবা পুকুর, মাঝে সিমেন্ট বাঁধানো কঠিন পথ — প্রাকৃতিক পরিবেশের বুক চিরে আঁচড় কেটেছে আঁকাবাঁকা লম্বা রাস্তা। শহরের উপকণ্ঠে হয়েও নরম মখমলের মতো গাছগাছালি, মুঠোভরা আতিথেয়তা, আদর করার মতো ঠোঁটখোলা — এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হল পশ্চিম বলরামপুরের প্রতিটি নারী-পুরুষ। এই বৈশিষ্ট্যের কথা ডিসিআরসি-তেই জেনেছিলাম। বজবজ রোডের বড়ো রাস্তার মোড় থেকে অটোরিকশা ছেড়ে যেখানে নামলাম, তারপরেও আরও পনেরো-কুড়ি মিনিটের হাঁটা পথ। আঁকাবাঁকা পথ ধরে পৌঁছাতেই অনুভব করলাম সেই শহর-মুক্তির স্বাদ! ৪১ ডিগ্রি তাপমাত্রায়ও গ্রামবাসীর আতিথেয়তার খামতি নেই, খামতি নেই পাখির কলকাকলির। পোশাক-পরিচ্ছদে শহুরে ছাপ লক্ষিত হলেও মনটায় তাদের নরম স্নেহের ছটা। মা-মাটি-মানুষের মমতা বলতে যা বোঝায়, তার পুরোটাই পাওয়া গেল পশ্চিম বলরামপুরে।
একসময় এই বলরামপুরই ছিল কংগ্রেসের দুর্গ। এখন সেই দুর্গের আনাচে-কানাচে ঘাসফুলের ছড়াছড়ি। তবে বয়োজ্যেষ্ঠদের অভিজ্ঞতাটা — প্রবীণ হলেও জীবনসায়াহ্নে এসে এক অব্যক্ত পরিবর্তনের জন্য যেন ভীষণভাবে তাঁরা অস্থির হয়ে উঠেছেন। কৃষ্ণের বলরাম বা বলশালী রামের পূজায় নিবেদিত হল তাঁদের মূল্যবান ভোট। একটু খুঁচিয়ে দিতেই বের হয়ে এল তাঁদের মনোবাঞ্ছা — ‘অনেক তো দেখলাম, এখন নমো নমোই পার করতে পারে তরী’ বলেই একজন মুচকি হাসলেন। যেন স্বর্গের শান্তি। পীড়াপীড়ি করতেই বলে ফেললেন, আমাদের জীবন তো শেষলগ্নে, নতুন প্রজন্মের চাকরি-বাকরির কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত। আসলে তাঁরা চাইছেন একটা পাকাপাকি স্থায়িত্বের। চাইছেন দেশের গতানুগতিক গোলমেলে ব্যবস্থার পরিবর্তন।
ক্ষমতার গা ঘেঁসে থাকতে চায় আজকালকার কঠিন জীবনযুদ্ধে নাজেহাল হওয়া মানুষ। একটু সুবিধা, প্রশাসনের এতটুকু সুনজর। তারই চোরাস্রোত বয়ে গেল আমাদের বুথগুলোতে। তবে লালরঙও মাঝেমধ্যে নজরে এল। সবমিলিয়ে এক পারস্পরিক সহাবস্থান। কোনো হানাহানি-সন্ত্রাস নেই, নেই কোনো রাজনৈতিক রেষারেষি। নিজের নিজের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রয়োগ করতে দেখা গেল একের পর এক মানুষজনকে এবং বেমালুমভাবে। তবে একটু খোঁচা দিতেই বেরিয়ে এল — ‘স্যার, পঞ্চায়েত ভোট হলে এভাবে আপনাদের সঙ্গে গল্প মশকরায় সময় দিতে পারতাম না। তখন ভোটার উঠিয়ে আনতেই দিন কাবার হয়ে যেত।’
বজবজ-বাটার বুক চিরে বলরামপুরের অবস্থান। মুখটায় বারুদের গন্ধ থাকলেও পশ্চিমে তার লেশমাত্র নেই, নেই কলকারখানার দূষণ। গ্রামেই রয়েছে বামফ্রন্ট আমলে তৈরি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম বলরামপুর এফপি স্কুল। আরও পড়াশোনার জন্য হেঁটে যেতে হয় গ্রামের বাইরে। উন্নয়নে পিছিয়ে থাকলেও মুক্ত পরিবেশ আর টাটকা সবজির তরতাজা ভিটামিন এনার্জি জোগায় এখানকার মানুষজনকে। কাঁঠালের এঁচোড়, কুমড়োর বোঁটাঝরা টপটপে রস আর মুগ কড়াইয়ের ছড়াছড়ির মাঝে আমরাও লুটিয়ে পড়লাম। পাওয়া গেল অনেকটা শক্তি, যা ভোটের দিনে কাজের চাপ আর গ্রীষ্মের তাপদাহ থেকে মুক্তি দিল। পার্থপ্রতিম মণ্ডল (বিজেপি-র এজেন্ট, এলএলবি-র প্রথম বর্ষের ছাত্র) আর পুষ্প সরকারের (মিড ডে মিলের রাঁধুনি) আতিথেয়তা ভোলার নয়। ওই নবীন যুবক অনেক আশা নিয়েই রাজনীতির অঙ্গনে পা রেখেছে। কাঁধে হাত রেখে বললাম, চালিয়ে যাও, তোমাদেরকেই ধরতে হবে এ দেশের হাল। কথাটা শোনামাত্রই তার বুকের ছাতি মনে হয় বাহান্ন ইঞ্চি হয়ে গেল।
Leave a Reply