অমিতাভ সেন, কলকাতা, ১৪ সেপ্টেম্বর#
ভাদ্রের পচা গরম। বাসের ভিতরে সবার গলদঘর্ম অবস্থা। ভিড় ঠাসা বাস। আর বাসে-গাড়িতে সবকটা রাস্তা ঠাসা। বাস যতক্ষণ চলছে তার দ্বিগুণ সময় থেমে থাকছে। চলছেও ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে — কলকাতার সবকটা রাস্তা জ্যাম। পুজোর বাজার করে হাঁসফাঁস করতে করতে দুই হাতে কাঁড়িকাঁড়ি ব্যাগ নিয়ে উঠেছে একদল মহিলা। গড়িয়াহাট মোড় থেকে। তাদের কলর বলর পিছনের সিট থেকে কম শোনা যাচ্ছে। কারণ পিছনের সিটের ওপরে বাসের মাইকে এফএম রেডিওতে জোর গান চালিয়ে দিয়েছে ড্রাইভার। গান হচ্ছে, ণ্ণআজকে তোমার জন্মদিনে কী দিই উপহার / বাংলায় নাও ভালোবাসা হিন্দিতে নাও পেয়ার।’ — এরকম আরও কীসব হাবিজাবি পদের গান, তার সঙ্গে জগঝম্প বাজনা, কানে তালা লেগে যাচ্ছে। কেউ কিছু বলছে না। ওরকম ভয়ানক ভিড়ে গানটাকে অত্যাচার মনে হচ্ছে আমার। ওমা! ওপাশে সামনের সিটে জানলার ধারে বসা প্রবীণ ভদ্রলোক বাসের গায়ে হাত দিয়ে গানের তালে তাল ঠুকছেন।
পাশে বসা যুবকের হাতে বিরাট সাইজের মোবাইলে বারবার খবর আসছে — সম্ভবত তার বান্ধবী — একটা রিনরিনে মেয়ের গলা; যুবকটি বারবার প্রবোধ দিচ্ছে — এই তো আর একটুখানি, এই তো তিনটে স্টপ, কী করব জ্যামে পড়ে গেছি, আর একটু দাঁড়াও, এসে যাচ্ছি, এক্ষুনি এসে যাচ্ছি। পিছনের মোবাইলে বয়স্ক লোকের নাটকীয় চিৎকার — আমি বলছি মামনির ফোনে স্বপন হাত দেয় না তো, বলছি স্বপন ওর ফোনে হাত দেয় না তো, তুমি ছাড়ো, আমি দেখছি। তারপর একটু নীরবতার পর সেই ভদ্রলোকের গলা শুনে বোঝা গেল তিনি তাঁর মামনিকে ফোন করেছেন — কী ব্যাপার বলতো? কাল সারাদিন তোকে ফোন করলাম, একবারও ধরলি না, অথবা এনগেজ্ড, সারাদিনে একটা ফোন করতে পারলি না, কী ব্যাপার বলতো, তোরা কি আমায় মেরে ফেলবি? এই পর্যন্ত উত্তেজিত স্বরে বলে ভদ্রলোক হঠাৎ সতর্ক হয়ে চাপা গলায় বললেন, ঠিক আছে বুঝেছি বুঝেছি, বলতো, নাম্বারটা বলতো, হ্যাঁ, নাইন এইট ….
কে জানে মামনির কী হয়েছে। তার কথা ভাবার অবকাশ কই? সামনের সিটে বসা লোকটা খালি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বারবার পান পরাগের পিক ফেলছে। বাস থামলেই ফেলছে, তবুও আমায় সবসময় নজর রাখতে হচ্ছে — যদি গায়ে এসে লাগে। একবার বারণ করেছি — শুনছে না। এদিকে এক আধুনিক দম্পতি তাদের বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে ভিড় ঠেলে বাসের পিছনের দিকে চলে এসেছে। তাদের ট্যাক্সি না পাওয়ার সশব্দ আপশোশের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ভিড় বাসে ওঠার কষ্ট ও বসার জায়গা না পাওয়ার বিরক্তি। একদম পিছনের টানা সিটের একজন যাত্রী ওদের জায়গা দেওয়ায় মা ছেলেকে কোলে নিয়ে বসল। জিনস্-টপ পড়া মা, ছেলের হাতের লম্বা বেলুন সামলাচ্ছে, ছেলেকে বলছে, ঠিক করে ধরো, লোকের গায়ে না লাগে। ছেলে বলছে বাস কেন চলছে না। মা বলছে, সামনে সব গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে না — বাস, কার; তারপর ছেলেকে ভোলাচ্ছে, তোমার আজ কত জিনিস হল — বেলুন, ঘড়ি — হ্যান্ডওয়াচ। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা সংশোধন করে দিল — হ্যান্ডওয়াচ না রিস্টওয়াচ। তারপর সে মোবাইলে ফোন করে বলতে শুরু করল, হ্যালো, খাল ধারে ঝুনুদার ফ্ল্যাট থেকে বলছি, সোমদেব রায়, হ্যাঁ একটা ম্যাকডোয়েল, একটা প্লেন, ঘন্টা খানেক বাদে দিলেই হবে।
এই শুয়ার কা বাচ্চা, একদম ঢুকিয়ে দেব, যেখানে বলবি সেখানে ঢুকিয়ে দেবো — পাশের গাড়ির ড্রাইভার আমাদের গাড়ির ড্রাইভারকে খিস্তি করছে — আমাদের গাড়িটা ওকে ওভারটেক করে একটু তেরছা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের ড্রাইভারও চেঁচাচ্ছে –যা বে যা, তোকে ভয় পাচ্ছি না। ট্রাফিক সিগন্যাল উঠে যেতেই আমাদের বাসটা বেশ জোর চালিয়ে চলে এল। এই শেষ মুহূর্তে এসে রাস্তা একটু ফাঁকা হয়েছে। বাস থেকে নেমে নতুন পাড়ায় ঢুকে দেখলাম দু-জায়গায় ঘটা করে গণেশ পুজো হচ্ছে। তারস্বরে মাইক বাজছে। অবাক লাগছে না। যাদের পয়সা আছে বা পয়সা তোলার ক্ষমতা আছে তারা এমন অনেক পুজোর জাঁক করবে। আর যাদের তা নেই তাদের একটা অংশ পুজোর প্রসাদের ভাগও পাবে। এই তো সামনের মোড়ে বাঁক নিয়ে রুটির দোকানের বৌদির কাছে দশটা রুটি অর্ডার দিয়ে বসে আছি। দেখলাম কলোনির থেকে তিনটে বাচ্চা ছেলে একটা সাইকেলে চেপে এসে মোড়ের মাথায় বসে থাকা রুটির দোকানের দাদাকে জিজ্ঞেস করছে, গণেশ পুজো কোথায় হচ্ছে? দাদা হেসে বললেন, প্রসাদ খাবি, যা, ওই তো বাঁদিকে আরেকটু এগিয়ে। ছেলেগুলো খুশি হয়ে চলে গেল। বৌদি তখন রুটি সেঁকতে সেঁকতে গজগজ করছে — এই লোকটাকে দেখলেই গা জ্বালা করে, একা হাতে আমি কত সামলাবো, খালি বেরিয়ে যায়, একটা কাজ করতে বললেই বলে শরীর খারাপ, কই বার বার বেরোতে তো শরীর খারাপ হয় না?
Leave a Reply