শান্তনু ভট্টাচার্য, মেটিয়াবুরুজ, ৩০ অক্টোবর#
আটশো থেকে সাতশো, ছশো হয়ে শেষ পর্যন্ত পাঁচশোয় রফা। পাঁচশোতেই ওরা রাজি। রাজি না হয়ে বোধহয় উপায়ও ছিল না। আর পার্টি নেই। এটাকে নামিয়ে দিতে পারলে আজকের দিনটা শেষ। শুধু যে ওরাই মথুরাপুর বা ক্যানিং থেকে এসেছে, তা তো নয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার অন্যত্র থেকেও এসেছে অনেকে। একটু ঝুঁকি ও সাহস মূলধন করে দুদিনে বেশ কিছু পয়সা হাতে আসে। ছোটো ছোটো দলগুলোর মধ্যে তাই থাকে নীরব প্রতিযোগিতা। বঙ্কিমচন্দ্রের মূর্তি মাঝখানে রেখে ওপাশে বাবুঘাট, এপাশে গোয়ালিয়র ঘাট। আমরা গোয়ালিয়র ঘাটে। লরি, ম্যাটাডোর, ট্রেলারের ওপর সারি দিয়ে শৈল্পিক দুর্গাপ্রতিমা। ঘড়িতে রাত দেড়টা। মধ্যরাতের প্রাত্যহিক নিস্তব্ধতার বদলে আজ এখানে উৎসবের আলোকিত উল্লাস। রোল, চাউমিন, ভুট্টা, চা, ঝালমুড়ির ছড়ানো ছেটানো পসরা। খাঁকি-সাদা পুলিশি তীক্ষ্ণ নজরদারি। জলে সতর্ক জলপুলিশ, লাইফবোটের প্রহরা। জলে পড়ছে ফুল-বেলপাতা আর বাঁশের রুক্ষ কাঠামো। জলখাওয়া এই কাঠামোটি বড়ো মূল্যবান। জীবনের চাইতেও। তাই ওরা সন্ধ্যের পর থেকে জলেই থাকে। বয়স চোদ্দো, পনেরো কিংবা ষোলো।
হই হই করে কুড়ি-বাইশ জনে দড়ি বেঁধে লরি থেকে প্রতিমা নামালো। এরা চব্বিশ-পঁচিশ-ছাব্বিশ। তারপর বাঁশের দুটি মোটা কঞ্চির ওপর বসিয়ে তা এগিয়ে নিয়ে চলল। মাঝখানে রেললাইন। আবার ওরা গলায় রব তুলল এবং হাতের ওপর প্রতিমা। রেললাইন ডিঙিয়ে ঘাটের কাছে, তারপর মাটি মাখামাখি পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে জলের প্রান্তে। ওপর থেকে দড়ি ধরে দুজন। জলে নামিয়ে দিল মৃন্ময়ী মূর্তিকে। ঝপাং স্বরে কেঁপে উঠল নদী।
কী নিখুঁত পদ্ধতি! আমরা দেখলাম। নিরাপদ দূরত্ব থেকে। পুলিশও দাঁড়িয়ে, নিরাপদ দূরত্বে। এক অফিসারকে জিজ্ঞাসা করলাম কোথা থেকে আসে এই মুটেরা। অফিসার বললেন, মথুরাপুর-ক্যানিং; দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।
জিজ্ঞাসা করলাম, সরকারকে এরা কোনো টাকা দেয়? অফিসার বললেন, তেমন কিছু না। থানায় এসে নাম ঠিকানা জমা দেয়। তারপর কাজে নেমে পড়ে। মতামত জানালাম আমি, ভালোই তো রোজগার হয়। অফিসার হাসলেন, দুটো দিনের তো ব্যাপার। ঝুঁকি কি কম! কারুর মাথা ফাটছে, হাত ভাঙছে, পা মচকে যাচ্ছে। আমি হিসাব কষলাম, আমরা পাঁচশো দিলাম। আঠারো, কুড়ি বা বাইশ দিয়ে পাঁচশোকে ভাগ, তাহলে এক-একজনের হাতে …
চারপাশটা ফাঁকা হয়ে এসেছে বেশ কিছুটা। পুলিশের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে আজকের মতো এখানে তাদের কর্তব্য সারা হয়ে গেছে। আমরাও ফিরছি। আমি গাড়ির ভিতরে, গাড়ির পিঠে আমার পাড়ার ভাইরা-দাদারা। ক্যানিং-মথুরাপুর থেকে আসা ওরাও হয়তো জল থেকে উঠে হাত পায়ের কাদা ধুয়ে নিচ্ছে। ওরাও কারুর ভাই, কারুর দাদা।
আমাদের গাড়ি দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে উঠে পড়ছে দ্রুত। নিচে চলে যাচ্ছে আমাদের শহর। কলকাতা। শহরটার দিকে আমরা সবাই তাকিয়ে থাকি। যে শহরটাকে একদিন গ্রাম দিয়ে ঘিরে ফেলার স্বপ্ন দেখেছিল কেউ কেউ!
হিসাবের রোগটা আবার আমার মাথায় ফিরে এল। পাঁচশোকে আঠারো, কুড়ি বা বাইশ দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু …।
Leave a Reply